Ajker Patrika

জাহান্নামের দরজা খুলে গিয়েছিল

এ আর চন্দন, ঢাকা
জাহান্নামের  দরজা খুলে গিয়েছিল

আলোচনার নামে কালক্ষেপণের আড়ালে কার্যত বাঙালিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছিল ইয়াহিয়া-চক্র। চক্রের আরেক পাণ্ডা লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেছেন, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া প্রাদেশিক গভর্নরদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাতে যোগ দেন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল ইয়াকুবও। ওই বৈঠকেই সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা অনুমোদন পায়। ইয়াহিয়ার নির্দেশেই প্রথমে ‘অপারেশন ব্লিৎস’ এবং পরে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ তথা গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়।

আর সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমর-শক্তি বাড়ানোর প্রমাণ আছে পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের তখনকার পিআরও মেজর সিদ্দিক সালিকের জবানিতে। সিদ্দিক সালিক পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে এক দুর্ঘটনায় পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়।

‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, রাওয়ালপিন্ডি থেকে ফিরে লে. জেনারেল ইয়াকুব তাঁর স্টাফকে নির্দেশ দেন ‘ব্লিৎস’ নামের অপারেশন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পিআইএর বিমানযোগে ঢাকায় আসতে শুরু করে ২৭ বালুচ ও ১৩ ফ্রন্টিয়ার্স পদাতিক ব্যাটালিয়নের সেনারা।

১৯৭১ সালের ২ আগস্ট নিউজ উইক সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই নেতা (ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমান) আলোচনা শুরু করলে বাঙালি ও বিশ্বের সবার নজর পাকিস্তানের টিকে যাওয়ার অনুকূল একটি আপসরফার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেও সেনাবাহিনী সরঞ্জাম সাজাতে নিয়োজিত থাকে। ওই সময় দক্ষিণ ভারতীয় দীর্ঘ সমুদ্রপথের ওপর দিয়ে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭০৭ বিমানে করে সেনাবাহিনী বাংলায় তার শক্তি দ্বিগুণ করে ৬০ হাজার সেনার সমাবেশ ঘটায়। আর টিক্কা ‘সবকিছু তৈরি’ বলে জানালে ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে চলে যান।

সে রাতেই সেনাদের লেলিয়ে দেন বেলুচিস্তানের কসাই নামে কুখ্যাত টিক্কা খান। একাধিক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার জবানিতেই একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের ভয়াবহ নৃশংসতার বিবরণ আছে। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয়ে গেল অ্যাকশন। পরিকল্পিত এইচ আওয়ার (আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন মুছে গেল। খুলে গেল জাহান্নামের সব দরজা।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘চার ঘণ্টা যাবৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম সেই বীভৎস দৃশ্য। সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—আগুনের শিখা আকাশকে বিদ্ধ করছিল। একসময় ছড়িয়ে পড়ল অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধূম্রকুণ্ডলী, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠল আগুনের লকলকে শিখা।… এক রাতেই অসাড় করে দেওয়া হলো ঢাকাকে।’ একই রকম বর্ণনা আছে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজির লেখায়ও। নিয়াজি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে আঘাত হানলেন জেনারেল টিক্কা খান। শান্তিপূর্ণ রাতটি পরিণত হলো দুঃস্বপ্ন, আর্তনাদ আর জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাতে।’ একই রাতে চট্টগ্রামেও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে হানা দিয়ে এক হাজারের বেশি বাঙালি নবীন সেনাসদস্যকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানের ২০ বালুচ রেজিমেন্টের বর্বর সেনারা। বাঙালি সেনাসদস্যদের আবাসিক ভবনে হামলা চালিয়ে নারী-শিশুদেরও হত্যা করেছিল তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে।

রাতে সেনাবাহিনী যখন আক্রমণ শুরু করে, ঠিক তখনই একটি কমান্ডো দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে। ওই দলের দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার) জহির আলম খান, যিনি জেড এ খান নামে পরিচিত ছিলেন। দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ বইয়ে জেড এ খান লিখেছেন, নিজের কমান্ডো দলকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে সেনাদের ন্যস্ত করেন মেজর বিলাল, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও ক্যাপ্টেন সাঈদের অধীনে। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে শেখ মুজিবের বাড়ির আশপাশ রেকি করেন ক্যাপ্টেন সাঈদ। রাত ১১টায় দলটি বিমানঘাঁটি থেকে রওনা হয়। পরে কয়েকটি ব্যারিকেড সরিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছায়। 
বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন। সেই ঘোষণা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়েছিল ওয়্যারলেসের মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমেও পরে তা প্রচারিত হয়েছিল। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য টাইমস ২৭ মার্চ, ১৯৭১ শিরোনাম করেছিল ‘হেভি ফাইটিং অ্যাজ শেখ মুজিবুর ডিক্লেয়ার্স ইস্ট পাকিস্তান ইনডিপেনডেন্ট’। একই দিনে নিউইয়র্ক টাইমসে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপা হয়।পাশেই লেখা হয়, ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক’

২৫ ও ২৬ মার্চের ঢাকায় হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার চাক্ষুষ বর্ণনা প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। ৩০ মার্চ, ১৯৭১ ডেইলি টেলিগ্রাফ ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রকাশ করে সাইমন ড্রিংয়ের প্রথম প্রতিবেদনটি। এতে বলা হয়, ‘আল্লাহ আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার নামে ঢাকা আজ ধ্বংস ও ভীতির নগরী। পাকিস্তানি সেনাদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর ওই নগরীর ৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।...সামান্যতম অজুহাতে লোকজনকে গুলি করে মারা হচ্ছে। নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর। ঠিক কত নিরীহ মানুষ এ পর্যন্ত জীবন দিয়েছে, তার সঠিক হিসাব বের করা কঠিন। তবে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোরের হিসাব যোগ করলে এ সংখ্যা ১৫ হাজারে দাঁড়াবে; যা পরিমাপ করা যায় তা হলো, সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা। ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে তাদের বিছানায়, বাজারে কসাইদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের দোকানের পেছনে, নারী ও শিশুরা জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে, একসঙ্গে জড়ো করে মারা হয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়িঘর, বাজার, দোকানপাট।’ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলার বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একদিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত হয়, তখন শহরের অন্যদিকে আরেক দল সেনা আক্রমণ করে রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর। প্রথমে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। পরে সেনারা ঢুকে পুলিশের ব্যারাকগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, ওই সব ব্যারাকে তখন পুলিশ সদস্যরা ঘুমিয়ে ছিল। এ হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল, তার সঠিক হিসাব যদিও জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হয়, ওই সময় সেখানে অবস্থানকারী ১১০০ পুলিশের মধ্যে অল্প কয়েকজনই রেহাই পেয়েছিল।’

দলিলপত্র থেকে জানা যায়, ৫৭ ব্রিগেডের অধীন ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বালুচ, ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি সমন্বিত দল ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে নিরস্ত্র ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের হত্যা করে মাঠে বড় বড় গর্ত বানিয়ে সব লাশ ফেলে মাটিচাপা দেয়।৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যা করে কয়েক শ পুলিশকে। ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা নবাবপুর, শাঁখারীবাজারসহ পুরান ঢাকায় হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু লোককে হত্যা করে; জ্বালিয়ে দেয় হিন্দুদের অনেক বাড়ি। ২২ বালুচ পিলখানা আক্রমণ করে প্রায় ৯০০ বাঙালি ইপিআর সদস্যকে হত্যা করে। ওই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার বিবরণ দিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট সংখ্যায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার পুরোনো অংশে সেনারা প্রথমে দাহ্য পদার্থ ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।পরে আগুনের বেষ্টনী থেকে বেরোনোর চেষ্টারত হাজার হাজার মানুষের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতম মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ভয়াবহ গণহত্যার বিবরণ দিয়ে অসংখ্য টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরে। ২৮ মার্চ, ১৯৭১ পাঠানো একটি টেলিগ্রামের শিরোনামই ছিল ‘Selective genocide’ বা বেছে বেছে গণহত্যা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রশিক্ষণ ছাড়াই মাঠে ৪২৬ সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা

গ্রাহকের ২,৬৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৪৬ বিমা কোম্পানি

‘এই টাকা দিয়ে কী হয়, আমি এত চাপ নিচ্ছি, লাখ পাঁচেক দিতে বলো’, ওসির অডিও ফাঁস

১০০ বছর পর জানা গেল ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রত্যঙ্গটি নারীর প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়: তিন দফা দাবিতে সোমবার মাঠে নামছেন শিক্ষার্থীরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত