Ajker Patrika

‘ঝরে পড়াদের ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার’

সাখাওয়াত ফাহাদ, ঢাকা
আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২২, ১২: ২৪
‘ঝরে পড়াদের ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার’

করোনাভাইরাস সংক্রমণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগে রাজধানীর মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত আরিফুল ইসলাম লিমন। তার বাবা নাইমুল ইসলামের নন্দীপাড়ায় একটি চায়ের দোকান ছিল। করোনার বাড়াবাড়ি শুরু হলে এর সংক্রমণ ঠেকাতে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। ছোট্ট লিমন তার বাবার চায়ের দোকানে কাজ শুরু করে। করোনার সংক্রমণ কমে এলে সারা দেশের বন্ধ বিদ্যালয়গুলো আবার খোলা হয়। কিন্তু লিমন আর বিদ্যালয়ে ফেরেনি। প্রায় দুই বছর কাজ করার পর সে পুরোদস্তুর দোকানি হয়ে গেছে। লিমন এখন তার বাবার সেই চায়ের দোকান একাই সামলায়।

লিমনের মতো সারা দেশের প্রাথমিকের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী করোনার থাবায় ঝরে পড়েছে। বিদ্যালয়ের মাঠে কিংবা শ্রেণিকক্ষে তারা আর ফিরে যায়নি।

এই যেমন কেরানীগঞ্জের সামিয়া আক্তার। সে বাঘাপুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। সামিয়ার বয়স যখন চার বছর তখন সামিয়ার বাবা মারা যান। আর সামিয়ার মা শিরিন আক্তার গৃহকর্মীর কাজ করতেন। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বাসার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ছোট্ট সামিয়াকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন তিনি। একসময় করোনা মহামারি কমে আসে। কিন্তু ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মায়ের সঙ্গে সামিয়াও গৃহকর্মীর কাজে যুক্ত হয়।

লিমন ও সামিয়ার মতো ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। ছাত্রীদের অনেকে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। ঝরে পড়া এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্টজনদের অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, শিক্ষা এই শিশুদের মৌলিক অধিকার। এদের আবার স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সৈয়দপুর চন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিল্লাল মাহমুদ মানিক বলেন, ‘করোনা মহামারির আগে আমাদের বিদ্যালয়ে ৩৮০ জন শিক্ষার্থী ছিল। বর্তমানে ৩৫১ জন শিক্ষার্থী আছে।’ তিনি বলেন, করোনায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এলাকায় অনেক মাদ্রাসা হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী সেখানে চলে গেছে।

কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক শাহিনুর আল-আমীন বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ৩ হাজার ১০০। করোনার পর এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজার ৩০০-তে নেমে গেছে।’

ঢাকার নবাবপুরের লালচান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুরাইয়া আমীন বলেন, ‘করোনার সময়ে অনেকেই কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে পরিবারসহ অন্য জায়গায় চলে গেছেন। অনেক শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। অনেক ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। প্রতিটি স্কুলেই অন্তত ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার পর আর ফিরে আসেনি।’

সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের একটি গবেষণায় বলা হয়, করোনা মহামারির কারণে প্রায় ১৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হয়। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৪৩ লাখ শিক্ষার্থী ফেরেনি। এ সময়ের মধ্যে প্রাক্‌-প্রাথমিকের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং প্রাথমিকের ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী কমে গেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৩ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৩ দশমিক ২ শতাংশ।

ব্র্যাকের গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, করোনায় কওমি, হাফেজিয়া ও নূরানি মাদ্রাসাগুলোর ৫ থেকে ১০ বছর বয়সের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১ শতাংশ। এ ছাড়া ৬ থেকে ১০ বয়সের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ।

এদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনায় ১০ থেকে ১৫ বছরের ৭ হাজারের বেশি ছাত্রী পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।

গবেষক সামির রঞ্জন নাথ বলেন, ‘বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হতে বিলম্ব হওয়া, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিক্ষায় অনাগ্রহ, শিক্ষা বিরতি কাটিয়ে ওঠার ভয়, মাদ্রাসাশিক্ষায় যুক্ত হওয়া, বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পড়া ও বাল্যবিবাহের কারণে শিক্ষার্থীরা করোনা-পরবর্তী সময়ে আর বিদ্যালয়ে ফিরে যায়নি। তাদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করা প্রয়োজন।’

প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ফেরাতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তালিকা তৈরির কাজ শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি। ফলে প্রাথমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তার কোনো সরকারি হিসাবও নেই।

মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বিস্তারিত তথ্য নিচ্ছি। তাই সময় দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিকের নিয়োগ নিয়েও অনেকে কিছুটা ব্যস্ত। তবে প্রাথমিকে তালিকা তৈরির পাশাপাশি অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মিড ডে মিল চালু হয়েছে।’ উপবৃত্তির টাকা সরাসরি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) মো. মুহিবুর রহমান বলেন, ‘ব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জরিপ করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার যে হিসাব দিয়েছে, আমার মনে হয় না এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী হবে। আমাদের তালিকা তৈরির কাজ এখনো চলছে। এ ছাড়া প্রতিবছরই কিছু শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। তারা কোথায় গেছে, কেন গেছে, কোথায় ভর্তি হয়েছে, জানার চেষ্টা করছি। তালিকাটি এখনো শেষ হয়নি বলে আলাদা করে তাদের ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। পুরো বিষয়টি হিসাবায়ন করে তারপর আমরা উদ্যোগের বিষয়ে মনোযোগ দেব।’

ইতিমধ্যেই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করাসহ যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ সম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিত, তাহলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা আমরা খুব সহজেই পেতে পারতাম। তার ওপর এই সংখ্যাটা যদি কম হয়, তাহলে তা নির্ধারণ করা তো আরও সহজ।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন ভবিষ্যতের নাগরিক লেখাপড়া ছাড়া অন্ধ হয়ে থাকলে শুধু নিজের জন্য ক্ষতি না, পুরো দেশ ও পৃথিবীর জন্য ক্ষতি। তার কোনো দক্ষতা, যোগ্যতা থাকবে না। তার বিবেক তৈরি হচ্ছে না, মৌলবাদী শক্তিসহ যে কেউ তাকে ব্যবহার করতে পারবে। এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ একটা বড় ধরনের বিপদের মধ্যে আছে। তাদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে যা যা প্রয়োজন, সেই পদক্ষেপ দ্রুত নেওয়া দরকার।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত