Ajker Patrika

ময়নার জনযুদ্ধে রক্তাক্ত আম্রকাননে হেলার ছাপ

ইমাম হাসান মুক্তি, লালপুর (নাটোর)
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২২, ১২: ১৩
Thumbnail image

নাটোরের লালপুরের ময়নার আম্রকাননের যুদ্ধ দিবস আজ ৩০ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সম্মুখযুদ্ধে রক্তাক্ত প্রান্তরে সাঁওতাল তিরন্দাজসহ প্রায় ৪০ জন শহীদ হন। মুক্তিপাগল জনতা, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত ২৫ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়। যার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে জনযুদ্ধে প্রথম বিজয় অর্জিত হয়।

গতকাল মঙ্গলবার ময়নার আম্রকানন যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দেখা যায় অবহেলার ছাপ। শহীদ স্মৃতিসৌধের ৫ শতাংশ জায়গার আশপাশে আবর্জনার স্তূপ। সংগ্রহশালা ও পাঠাগারের জন্য নির্ধারিত ২ শতাংশ জমিতে লাউগাছ লাগানো হয়েছে। জীবন্ত স্মৃতিসৌধে বুলেটবিদ্ধ আমগাছটি মৃতপ্রায়। সাতজন শহীদের গণকবর অরক্ষিত জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

নাটোর জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রউফ সরকার বলেন, ২৫ মার্চ কালরাতে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হত্যাযজ্ঞে রাজশাহীতে অবস্থানরত লালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট বীরেন সরকার, শিল্পব্যাংকের ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান ও জাতীয় পরিষদ সদস্য মো. নাজমুল হক সরকারসহ (চারঘাট-লালপুর-বাগাতিপাড়া-বড়াইগ্রাম) অনেকে শহীদ হন। পাবনায় ২৭ মার্চ মুক্তিবাহিনী ও জনতার প্রতিরোধে ৮০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহতের ঘটনার পর রাজশাহীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার মেজর রাজা আসলাম ২৮ মার্চ অবশিষ্ট সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য আসেন। দুটি পিকআপ, চারটি জিপ ও দুটি ট্রাকে ২৯ মার্চ প্রায় ৪০ জন সেনাসদস্য রাজশাহীতে রওনা দেন। পথিমধ্যে নাটোর ও দাশুড়িয়ায় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে কাঁচা রাস্তায় লালপুরের দিকে যাত্রা করেন। গোপালপুর রেললাইনে ওয়াগন দিয়ে ব্যারিকেড ও ইছামতী খালের সেতুর রাস্তা কেটে প্রতিরোধে ময়না গ্রামে সৈয়দ আলী মোল্লা ও নওয়াব আলী মোল্লার বাড়ি দখল করে চারটি মেশিনগান স্থাপন করেন তাঁরা। এ সময় ধরে এনে একটি আমগাছের সঙ্গে বেঁধে ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিপাগল হাজারো মানুষ ময়না প্রান্তরে একত্র হয়ে গ্রাম ঘিরে পুলিশ, ইপিআর ও আনসার সদস্যদের নিয়ে একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন। দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষণ করলে জনতা তীর-ধনুক, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। জনতা ইছামতী খালের ওপর সেতু ভেঙে ফেলেন।

সেনাদের উদ্ধারে ৩০ মার্চ কয়েকটি হেলিকপ্টার থেকে অসংখ্য গুলি ও বোমাবর্ষণ করা হয়। প্রতিরোধকারীরা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে রাইফেল দিয়ে গুলি করেন। অবরুদ্ধ সেনারা আখখেতে আত্মগোপন ও পালানোর সময় অনেককে পিটিয়ে হত্যা করেন। পরে একটি জঙ্গলে পালিয়ে থাকা মেজর রাজা আসলামকে ধরে এনে লালপুর শ্রী সুন্দরী পাইলট হাইস্কুল মাঠে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়।

লালপুরের ময়নার আম্রকাননে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করলে সাত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তা দেখাচ্ছেন স্থানীয় এক ব্যক্তিআমগাছটি ‘জীবন্ত স্মৃতিসৌধ’
ময়নার আম্রকাননে একটি গাছের সঙ্গে আট বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বেঁধে গুলি করলে সাতজন শহীদ হন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আব্দুস সামাদ নামের একজন। পরে তিনিও মারা যান। গায়ে বুলেটের চিহ্ন নিয়ে গাছটি এখনো বেঁচে আছে। অভাবের কারণে গাছটির মালিক আবু রায়হান মোল্লা বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। উপজেলা আওয়ামী লীগ গাছটি কিনে ২০১৪ সালের ৩০ মার্চ এটিকে ‘জীবন্ত স্মৃতিসৌধ’ ঘোষণা করে। অমূল্য সম্পদ গাছটি যত দিন বাঁচবে, রায়হানের পরিবার গাছের ফল ভোগ করবে, কিন্তু কাটতে বা বিক্রি করতে পারবে না।

ময়না যুদ্ধে শহীদের কয়েকজন হলেন সৈয়দ আলী মোল্লা, মসলেম আলী মোল্লা, আবুল কাশেম মোল্লা, আয়েজ উদ্দিন মোল্লা, খন্দকার নুরুন্নবী মন্টু ওরফে রাঙা, কেরামত আলী শেখ ওরফে কিয়ামত, খাইরুল আনাম ছাত্তার, বকস সরদার, করম আলী, আবেদ আলী, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল কুদ্দুস, কালু মিয়া, সেকেন্দার আলী, আছের উদ্দিন, জয়নাল আবেদিন, কেরু ফকির, নুরুন্নবী, ইয়াছিন আলী, যুধিষ্ঠির, শৈলেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী ওরফে মঙ্গল, সায়ের উল্লাহ মুন্সী, আব্দুল লতিফ মুন্সী, আব্দুল গফুর, নুরুল ইসলাম সরদার, তইজ আলী, জাহাঙ্গির হোসেন, সাদের আলী, নাসির উদ্দিন, কালু শেখ, কুদ্দুস শেখ, সামাদ শেখ, সাবেদ আলী প্রমুখ।

যুদ্ধে ময়না গ্রামের শহীদ সৈয়দ আলী মোল্লার ছেলে মো. ইদ্রিস আলী মোল্লা (৭২) বলেন, ময়নার যুদ্ধে শহীদ ও যুদ্ধাহত কেউ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। নিজ অর্থায়নে ১৯৯৮ সালের ৩০ মার্চ ‘ময়না শহীদ স্মৃতিসৌধ’ উদ্বোধন করেন সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মমতাজ উদ্দিন। প্রতিবছর এখানে তাঁরা আলোচনা সভা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

লালপুর ইউএনও শামীমা সুলতানা বলেন, গণকবর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ করছে প্রশাসন।

লালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইসাহাক আলী বলেন, ময়না প্রান্তরে জনযুদ্ধে ২৫ নম্বর রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে গণকবর সংরক্ষণ, স্মৃতিসৌধ, সংগ্রহশালা ও পাঠাগার নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

নাটোর-১ আসনের সাংসদ শহিদুল ইসলাম বকুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

বিয়ে করলেন সারজিস আলম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়ছে শ্রীলঙ্কা, ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কোথায় দেখবেন

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট কারে ধাক্কা, জাবিতে ১২ বাস আটকে ক্ষতিপূরণ আদায় ছাত্রদলের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত