Ajker Patrika

এভারেস্টের চেয়েও কি উঁচু কোনো পর্বত আছে

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬: ৪১
এভারেস্টের চেয়েও কি উঁচু কোনো পর্বত আছে

শিরোনামটাই নিশ্চয় চমকে দিয়েছে আপনাকে। হিমালয় পর্বতমালার মাউন্ট এভারেস্টকেই তো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ বলে জানি আমরা। এটা নিয়ে নতুন করে আলোচনার কারণ কী? তাহলে কি রাতারাতি এর চেয়ে উঁচু কোনো পর্বত কিংবা পর্বতচূড়া আবিষ্কার হয়ে গেল? এত দিনের জানা কি তবে মিথ্যা?

এভারেস্টপ্রেমীরা ভয় পাবেন না, সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গের খেতাব এভারেস্ট থেকে কেড়ে নেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আপনি যদি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দু কিংবা সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত চূড়ার কথা বলেন তাহলে কোনো সমস্যাই নেই। কিন্তু যদি পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বত বা সবচেয়ে উঁচু পর্বতের প্রসঙ্গ আসে তখনই একটি কিন্তু আছে। সে জন্যই আপনাকে মাউনা কেয়ার গল্পটা শুনতে হবে।

যে পাঁচটি আগ্নেয় পর্বত মিলে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের জন্ম—এর একটি মাউনা কেয়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ৭৯৬ ফুট (৪ হাজার ২০৫ মিটার) উঁচু এ পর্বত শুধু হাওয়াই দ্বীপ নয়, গোটা প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার সর্বোচ্চ পর্বত। এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ৪ হাজার ২০৫ মিটার উঁচু পুঁচকে এক পর্বতের সঙ্গে মাউন্ট এভারেস্টের তুলনা আসে কীভাবে? এভারেস্টের উচ্চতা তো ৮৮৪৮.৮৬ মিটার বা ২৯০৩১.৬৯ ফুট।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যে পর্বত যত উঁচুতে অবস্থিত তাকেই তার উচ্চতা ধরে নেওয়া হয়। পর্বতের উচ্চতা পরিমাপের এই প্রচলিত নিয়ম মেনে চললে মাউন্ট এভারেস্টই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত বা পর্বতশৃঙ্গ। এ ক্ষেত্রে মাউনা কেয়ার এভারেস্টের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তো দূরে থাক, এর ধারেকাছে ভেড়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু গোড়া থেকে চূড়া পর্যন্ত দূরত্ব হিসাব করে যদি পর্বতের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয়, তবে মাউনা কেয়াই পর্বতের রাজা।

হিমালয় পর্বতমালার অংশ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা তো ৮৮৪৯ মিটার।তা কী করে সম্ভব? মাউন্ট এভারেস্ট, গডউইন অস্টিনের মতো বিখ্যাত পর্বতগুলোর মতো মাউনা কেয়ার শুরুটা সাগর-সমতল নয়, বরং প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর তলদেশে। সেখান থেকে খাড়া ওপরের দিকে উঠে গেছে এটি। পর্বতটির যে অংশ পানির নিচে, এর উচ্চতাই ১৯ হাজার ফুটের বেশি। গোড়া থেকে হিসাব করলে মাউনা কেয়ার উচ্চতা দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ৫০০ ফুট কিংবা ১০ হাজার ২১১ মিটার। মাউন্ট এভারেস্টের (৮৮৪৯ মিটার) কী সাধ্য তাকে ছোঁয়।

আর এ কারণেই পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতের খেতাবটা অনেকেই মাউনা কেয়াকে দিতে চান। এই সুযোগে বলে রাখি পর্বতের উচ্চতা মাপার আরেকটি অপ্রচলিত পদ্ধতি আছে, সেটা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চূড়ার দূরত্ব হিসাব করে। সে হিসাবে কিন্তু এভারেস্ট কিংবা মাউনা কেয়া দুটোকেই টেক্কা দিয়ে সর্বোচ্চ পর্বতচূড়ার মুকুট মাথায় চাপিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের আগ্নেয় পর্বত চিম্বোরাজো। অবশ্য পর্বতের উচ্চতা মাপার সাধারণ নিয়মে এর উচ্চতা খুব বেশি নয়, ৬২৬৩ মিটার বা ২০৫৪৯ ফুট।

মাউন্ট এভারেস্ট, গডউইন অস্টিনের মতো বিখ্যাত পর্বতগুলোর মতো মাউনা কেয়ার শুরুটা সাগর-সমতল নয়, বরং প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর তলদেশে।শুনে আশ্চর্য হবেন, মাউনা কেয়ার উচ্চতা আরও বেশি হতে পারত। আগ্নেয় প্রক্রিয়ায় তৈরির পর এর শরীরের একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে সাগর তলের ভূত্বকের নিচে দেবে যায়। এই তলিয়ে যাওয়া অংশের পরিমাণ কত শুনবেন? ৩৫ হাজার ফুট।

হাওয়াইয়ান শব্দ মাউনা কেয়ার অর্থ হোয়াইট মাউন্টেন বা শ্বেত পর্বত। উত্তর গোলার্ধে যখন শীত নামে তখন তুষার ধবল বরফে ঢেকে যায় পর্বতটির চূড়া। বিশেষ করে যে বার লা নিনা প্রভাব বিস্তার করে চূড়া থেকে পর্বতের নিচের বেশ কতকটা মুড়ে দেয় তিন ফুট চওড়া বরফের আস্তরণ। মাউনা কেয়া আরোহণে একদিকে যেমন পেতে পারেন মরু অঞ্চলের পরিবেশ অপর দিকে পাবেন গহিন অরণ্য।

সমতল ভূমি থেকে শুরু করে উত্তর মেরুর তুন্দ্রা পৃথিবীর প্রায় সব কটি বাস্তুসংস্থানের আশ্চর্য সমাবেশ ঘটেছে এখানে। সাগরপৃষ্ঠের ৫ হাজার ২০০ থেকে আট হাজার ফুট পর্যন্ত অংশটা পশুচারণভূমি হিসেবে আদর্শ। প্রচণ্ড কুয়াশায় অভিযাত্রীদের দৃষ্টিসীমা যখন শূন্যের কাছাকাছি তখন পর্বতে চড়ে বেড়ানো কালো বুনো ষাঁড় কিংবা মোটাতাজা ভেড়ার সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো মুশকিল!

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে অবস্থান চিম্বোরাজো পর্বতের।অবস্থানগত কারণেই মাউনা কেয়া জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এর চূড়ায় তাই স্থাপিত হয়েছে মানমন্দির এবং অন্তত ডজনখানেক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ। চন্দ্র অভিযানের জন্য নভোচারীদের প্রশিক্ষণও চলে এখানে। তবে হাওয়াইয়ের বাসিন্দারা এসবের ঘোর বিরোধী, তাঁদের বিশ্বাস এটা তুষারদেবী পলিয়াহুর আবাসস্থল। যদি শান্তি বিঘ্নিত হওয়ায় চটে গিয়ে শাপ দিয়ে বসেন দেবী? অবশ্য হাওয়াইয়ের মাউনা লোয়া পর্বতে সাম্প্রতিক অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটলেও মাউনা কেয়ার শেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটে সাড়ে চার হাজার বছর আগে।

ও একটি কথা, যে কারণে সবচেয়ে উঁচু পর্বত কোনটি, সে তর্কের অবতারণা সেটাই তো বলা হয়নি এখনো। ঘটনা হলো, আজ ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। আর এই দিনটিতে এভারেস্ট, মাউনা কেয়াসহ ভালো থাকুক বিশ্বের এবং আমাদের দেশের সব পর্বত—এটাই চাওয়া।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড এটমসফরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস), উইকিপিডিয়া, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত