Ajker Patrika

মেগালোডন: অতীতে সাগরে বিচরণ করা ভয়ানক এক প্রাণী

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১৮: ১৪
মেগালোডন: অতীতে সাগরে বিচরণ করা ভয়ানক এক প্রাণী

মেগালোডন ছিল তাদের সময়ে সাগরে প্রধান শিকারি প্রাণী। অনেকের ধারণা, হলিউডি ছবির কল্পনার জগতের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর ছিল এ জাতের হাঙরেরা। পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত দৈত্যকার এই হাঙর আবার ফিরে এসেছে, তবে বাস্তবে নয় সিনেমার পর্দায়। ২০১৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল দ্য মেগ, যেখানে অ্যাকশন তারকা জেসন স্ট্যাথামকে একটি বিশাল প্রাগৈতিহাসিক হাঙরের সঙ্গে লড়াই করতে দেখা গিয়েছিল। পাঁচ বছর পর মেগ ২: দ্য ট্রেঞ্চে আবারও স্ট্যাথাম বিশালাকার হাঙরের মুখোমুখি হয়েছেন। ছবিটি পরিচালনা করেছেন বেন হুইটলি। 

এখন চলচ্চিত্রটি নিয়ে দর্শকদের অনুভূতি যা-ই হোক না কেন, এতে সন্দেহ নেই যে পর্দার প্রাণীটি একসময় সত্যি ছিল। আর আজ আমরা সেই মেগালোডনদের গল্পই বলব। 

মেগালোডন হাঙর সাগরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল আজ থেকে দুই কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে ৩৫ লাখ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত। তবে ওই সময়কাল মানুষের মুখোমুখি হওয়ার তুলনায় অনেক আগে। এরা ছিল এযাবৎকালের বৃহত্তম হাঙর এবং সাগরে বিচরণ করা সবচেয়ে বড় প্রাণীদের একটি। তবে তারা কতটা বড় ছিল তা গত কয়েক বছরে স্পষ্ট হয়েছে। নতুন গবেষণায় এই প্রাণীগুলো সম্পর্কে আরও অনেক নতুন নতুন তথ্য দিয়েছে আমাদের। 

বিশাল দাঁত
মেগালোডনেরা মোটামুটি ১৮৪০ সাল থেকে বিজ্ঞানের কাছে পরিচিত, এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে এদের বিশাল ত্রিভুজাকার দাঁত। জীবাশ্মে পরিণত হওয়া এদের দাঁতের অনেক নমুনা বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘মেগালোডন’ অর্থও বড় দাঁত। আর মোটেই মজা করে এমন নাম দেওয়া হয়নি এদের, এই হাঙরদের কোনো কোনো দাঁতের নমুনা ১৬ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার বা ৬ দশমিক ৬ ইঞ্চি লম্বা। তুলনা করলে এখনকার গ্রেট হোয়াইট হাঙরদের দাঁত সাড়ে সাত সেন্টিমিটার বা ৩ ইঞ্চি লম্বা। 

মেগালোডনের দাঁতের সংখ্যা শুনলেও চমক উঠবেন, একেকটি এ প্রজাতির হাঙরের ২৭৬টি দাঁত ছিল এদের মাংস ছিঁড়ে ফেলার নিখুঁত হাতিয়ার। এই হাঙরদেরও কামড় ছিল খুব শক্তিশালী। অনুমান করা হয়, প্রতি বর্গইঞ্চিতে এদের দেওয়া কামড়ের শক্তি আনুমানিক ৪০ হাজার পাউন্ড। 

এদের দাঁতের সংখ্যা, আকার আর শক্তি দেখা এটা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে মেগালোডন বিশালাকায় একধরনের বড় হাঙর ছিল, কিন্তু কত বড়? 

যদি আপনার কাছে একটি সম্পূর্ণ কঙ্কাল থাকে, তবে উত্তরটা খুব সহজেই আপনি বের করে ফেলতে পারার কথা। কিন্তু এখানেই ঝামেলাটা বাধে। মেগালোডনদের কঙ্কাল শক্ত হাড়ের বদলে নরম তরুণাস্থি দিয়ে তৈরি। আর এ তরুণাস্থি ভালোভাবে জীবাশ্মে রূপ নেয় না। কাজেই মেগালোডনদের ফসিল রেকর্ড বলতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দাঁত এবং কিছু কশেরুকাকে পাই। 

মেগালোডনের দাঁতের রসায়ন নিয়ে কাজ করা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোজিওকেমিস্ট সোরা কিম বলেন, ‘হাঙরটি আসলে দেখতে কেমন ছিল সে সম্পর্কে আমাদের কাছে বড় কোনো প্রমাণ নেই। 

‘এর মানে মেগালোডনের প্রকৃত আকার ও আকৃতি নিয়ে একটি ধাঁধায়ই পড়ে গেলাম আমরা। এ ঝামেলা মেটাতে এগিয়ে আসেন জীবাশ্মবিদরা। তাঁরা মেগালোডনের দাঁতের মাপ পরিমাপ করেন, শরীরের আকার সম্পর্কে জানা আছে এমন অন্যান্য হাঙরদের দাঁতের সঙ্গে তুলনা করে একটি অনুমান দাঁড় করিয়েছেন। তাই বিষয়টি নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ হয়েছে। তবে অনেক গবেষণা মিলিয়ে ধারণা করা হয় মেগালোডন ১৮ মিটার (৫৯ ফুট) থেকে ২০ মিটার (৬৬ ফুট) পর্যন্ত হতে পারে দৈর্ঘ্যে।’ 

অর্থাৎ মেগালোডনের তুলনায় আধুনিক যেকোনো হাঙরকে বামনই বলতে হবে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় শিকারি হাঙর হলো গ্রেট হোয়াইট শার্ক। যেগুলৌ মোটামুটি ৫ মিটার বা ১৬ ফুটের মতো হয় লম্বায়। এদিকে এখনো সাগরে বিচরণ করা হোয়েইল শার্করা আকারে মেগালোডনদের কাছাকাছি হলেও এরা শিকারি প্রাণী নয়, আণুবীক্ষণিক প্ল্যাঙ্কটনের ঝাঁকে খেয়েই বেঁচে থাকে। 

ভয়ানক শিকারি প্রাণী
মেগালোডনদের দাঁত নিশ্চিত করছে এরা তুখোড় এক শিকারি প্রাণী ছিল। কিন্তু এরা খেত কী? এর উত্তর দেওয়ার জন্য, গবেষকেরা দাঁতের রাসায়নিক বিশ্লেষণের শরণাপন্ন হয়েছেন। একটি প্রাণীর শরীরের সমস্ত নাইট্রোজেন তার খাদ্যের প্রোটিন থেকে আসে। নাইট্রোজেন দুটি ‘আইসোটোপে’, একটি নাইট্রোজেন-১৪ এবং অপরটি নাইট্রোজেন-১৫। 

২০২২ সালের একটি গবেষণায়, কিমসহ অন্য গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে মেগালোডন দাঁতে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার নাইট্রোজেন-১৫ ছিল। এ থেকে অনুমান করা যায় এটি বড় ধরনের প্রাণী শিকার করে খেতে অভ্যস্ত ছিল। যা হোক, কিম ও শিকাগোর ডিপল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ কেনশু শিমাদা ২০২২ সালের আরেকটি গবেষণায় জিংকের দিকে মনোযোগ দেন। এটা অনুসারে মেগালোডনদের এখনকার গ্রেট হোয়াইট হাঙরদের সঙ্গে কিছু মিল যাওয়া যায় শিকারের দিক থেকে। কিম এটাও জানান, সব মেগালোডন একই খাবার খায় না। 
 
ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের জীবাশ্মবিদ পিমিয়েন্টো যেমন বলেছেন, শিশু-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে খাবারের পার্থক্য হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আধুনিক প্রজাতি থেকে আমরা জানি যে হাঙররা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের খাদ্য পরিবর্তন করে।’ 

তবে তাদের সময়ে মেগালোডন ছিল খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষ শিকারি। ধারণা করা হয় ৫০ থেকে ৭০ টনের এই প্রাণীটির দৈনিক আড়াই হাজার পাউন্ড খাবার খেতে হয়। তিমি এবং ডলফিনের মতো বিভিন্ন বড় সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল এদের খাদ্যতালিকায়। এটি অন্যান্য হাঙরও শিকার করে খেত বলে অনুমান করা হয়। 

লস অ্যাঞ্জেলস মিউজিয়ামে ২০২২ সালে স্ক্রিনে মেগালোডনের একটি রেপ্লিকা প্রদর্শন করা হয়। ছবি: এএফপিপ্রকৃতপক্ষে, শিশু ও কম বয়স্ক মেগালোডন সম্ভবত তাদের মা-বাবার থেকে বেশ ভিন্ন ধরনের জীবন যাপন করেছিল। ২০১০ সালে পিমিয়েন্টো এবং তাঁর সহকর্মীরা পানামার একটি অঞ্চল থেকে মেগালোডনের যে দাঁতগুলো আবিষ্কার করেন, সেগুলো ছিল অস্বাভাবিক রকম ছোট। অর্থাৎ এগুলো কম বয়স্ক হাঙর ছিল। কিন্তু এক জায়গায় একসঙ্গে এত শিশু বা বাচ্চা হাঙর থাকার রহস্য কী? গবেষকেরা উপসংহারে পৌঁছান অগভীর সমুদ্রের ওই অঞ্চলটি শিশু হাঙরদের একটি নার্সারি হিসেবে কাজ করেছিল। তরুণ মেগালোডনগুলো তুলনামূলক নিরাপদে সেখানে খেতে পারত, কারণ বড় শিকারি প্রাণীদের জন্য এ ধরনের অগভীর জলে প্রবেশ করাটা ছিল কঠিন। 

শিমাদা এবং তাঁর সহকর্মীদের ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, এ ধরনের হাঙর জন্মের সময় ৬ দশমিক ৬ ফুটের মতো হতো দৈর্ঘ্যে। তবে এই হাঙরদের সম্পর্কে গবেষণায় বের হয়ে আসা পিলে চমকানো তথ্য হলো, বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্য, মেগালোডন হাঙরের বাচ্চারা তাদের নিজের ভাই-বোনদের খেয়ে ফেলত। যেহেতু প্রতিটি ভ্রূণ বড় হয়ে বড় দখল করবে, সেগুলি খাওয়ার ফলে বেঁচে থাকা হাঙরটি বড় আকার নিয়ে জন্ম নেয়। আরও পরিষ্কারভাবে বললে এই প্রজাতির হাঙরদের বেলায় ডিমে পাড়ার পরিবর্তে মায়ের গর্ভেই বাচ্চা ফুটার ঘটনা ঘটত। 

উষ্ণ রক্তের প্রাণী
২০২২ সালে, পিমিয়েন্টো এবং তাঁর সহকর্মীরা মেগালোডনের একটি ত্রিমাত্রিক আকৃতি প্রকাশ করেন। তারপরে তাঁরা অন্যান্য হাঙরের তথ্যের সঙ্গে এটি মেলানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা উপসংহারে পৌঁছেছে যে মেগালোডন তুখোড় সাঁতারু ছিল। তবে কম বয়স্ক হাঙরদের সাঁতারের গতি ছিল বেশি। পিমিয়েন্টো এবং তাঁর সহকর্মীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান এরা নিয়মিতভাবে এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরে সাঁতারে বেড়াত খাবারের খোঁজে।

এই সক্রিয় জীবনধারা অন্য বৈশিষ্ট্য দ্বারা আরেকটি বিষয় ওঠে আসে তা হলো এরা ছিল মূলত উষ্ণ রক্তের প্রাণী। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া প্রতিটি মহাদেশে মেগালোডনের দাঁত পাওয়া গেছে। আর এরা নিজস্ব তাপ উৎপন্ন করে নিজেদের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। ২০১৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় মেগালোডন তার শরীরের অংশগুলি আশপাশের জলের চেয়ে উষ্ণ রাখত। তারপরে ২০২৩ সালের জুনে, শিমাদা, কিমসহ গবেষকদের একটি দল জীবাশ্ম দাঁতের খনিজ থেকে অনুমান করেন মেগালোডন আংশিকভাবে উষ্ণ রক্তযুক্ত এক প্রাণী। 

‘মেগালোডন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতো উষ্ণ প্রাণী নয়,’ কিম বলেছেন। এটা হতে পারে যে এটি তার শরীরের মূল অংশে অভ্যন্তরীণ তাপ উৎপন্ন করে। অথবা এটি হতে পারে যে এর নিছক আকারের কারণে এটিকে তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। যেভাবেই হোক, এর শরীরের ভেতরটা উষ্ণ ছিল। 

কীভাবে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল

তবে ঘটনা হলো, বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন, মেগালোডনের আকার এবং উষ্ণ-রক্তের ব্যাপারটাই এর পতন ঢেকে আনে। ‘সমুদ্রের পানির স্তর নেমে যাওয়ার পরে মেগালোডন বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ এ সময় এদের জন্য পর্যাপ্ত শিকার ছিল না।’ পিমিয়েন্টো বলেন। ২০১৭ সালে তিনি এবং তার সহকর্মীরা মহাসাগরে একটি ব্যাপক বিলুপ্তি শনাক্ত করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল মেগালোডন এবং অন্যান্য অনেক বড় সামুদ্রিক প্রাণী। 
 
মেগ ২: দ্য ট্রেঞ্চ ছবির পোস্টার। ছবি: আইএমডিবি‘মেগালোডনের মতো একটি বড় প্রাণীর টিকে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণে খাবারের প্রয়োজন হয়।’ কিম বলেন। 

একবার শিকার দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠলে, মেগালোডনের মতো উষ্ণ রক্তের জীবনধারা বড় মূল্য দিতে হয়। প্রায় ৩৫-৩৬ লাখ বছর আগে, যখন সাগর শীতল হচ্ছিল এবং শুকিয়ে যাচ্ছিল এবং মেগালোডনগুলি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এ সময় সমুদ্রের তাপমাত্রা কমে যায় এবং সমুদ্র বরফে পরিণত হতে শুরু করে, মেগালোডনদের আবাসস্থলও ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে। এদিকে এদের শিকারের একটি বড় অংশ মারা পড়ে বা অন্য কোনো দিকে সরে পড়ে। 

 
এই বিলুপ্তি লাখ লাখ বছর আগে ঘটেছিল। পিমিয়েন্টো এবং সহকর্মীদের ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় ২৬ লাখ বছর আগের কথা বলা হয়, কিন্তু অন্য একটি দলের গবেষণায় সময়টা ৩৫ লাখ বছর আগে বলা হয়েছে। 

সঠিক তারিখ নিয়ে তর্ক থাকলেও মেগালোডন আর নেই যে তাতে সন্দেহ নেই। বিশাল এলাকাজুড়ে শিকার করা এই প্রাণীটি যদি সাগরে কোনোভাবে থাকত একে খেয়াল না করার সুযোগ নেই। যদিও চলচ্চিত্রগুলোতে দেখানো হয় এখনো প্রজাতিটি কোনোভাবে বেঁচে আছে। তেমনি অতিরিক্ত আশাবাদী কেউ কেউ দাবি করেন সাগরের কোনো গুপ্ত এলাকায় এখনো বিচরণ করে বেড়াচ্ছে এই তুখোড় শিকারি। তবে গবেষকেরা বলছেন এটা কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। রহস্যময় সাগরের অনেক কিছু এখনো মানুষের অগোচরে থেকে গেলেও এত বিশাল, ভয়ানক একটি প্রাণীর পক্ষে লুকিয়ে থাকা মুশকিলই, কি বলেন! 

সূত্র: বিবিসি, লাইভ সায়েন্স, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিডস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত