Ajker Patrika

আফগান চলচ্চিত্রের আদ্যোপান্ত

বিনোদন ডেস্ক
আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২১, ১০: ৪১
আফগান চলচ্চিত্রের আদ্যোপান্ত

১৯৪৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘লাভ অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ’ আফগানিস্তানের প্রথম সিনেমা। ছবিটির পরিচালক রশিদ লতিফ। ১৯৬৮ সালে ‘আফগান ফিল্ম অরগানাইজেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা অন্যান্য দেশের বিভিন্ন ছবি দেখাতে শুরু করে। বিশেষ করে খবর এবং তথ্যচিত্র দেখানো হত। এই ফিল্ম অর্গানাইজেশনের প্রথম নারী মহাসচিব সাহরা করিমি। বর্তমানে তিনিই এই দায়িত্বে আছেন। তবে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসলে ভীত হয়ে বিশ্ববাসীর কাছে সে দেশের ফিল্মমেকারদের উদ্ধারের জন্য আবেদন করেছেন। আফগান চলচ্চিত্রের আদ্যোপান্ত জানানো হল।

প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি
আফগানিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির নাম ‘লাইক ঈগলস’, সাদা কালো ছবি। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন আফগান অভিনেতা-গায়ক জাহির ওয়াইদা এবং নাজিয়া নামের এক কিশোরী।

রঙিন ছবি নির্মাণ শুরু
ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে আসার পর সে দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের গুরুত্ব বাড়ে। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনাও শুরু হয়। আশির দশকে আফগানিস্তানে রঙিন ছবি নির্মাণ শুরু হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল ‘রান অ্যাওয়ে’, ‘লাভ এপিক’, ‘সাবুর সোলজার’ ইত্যাদি।

থমকে গেল
১৯৯০ সালে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের শুরু হলে শিল্পচর্চা থমকে যায়। বহু চলচ্চিত্র নির্মাতা দেশ ছে়ড়়ে ইরান বা পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত চলা তালেবানি শাসনের সময় বন্ধ হয়ে যায় সব শিল্পচর্চা। সেদেশে পূর্বে নির্মিত প্রায় সব ছবির রিল পুড়িয়ে ফেলা হয়। বন্ধ হয়ে যায় সিনেমাহলগুলো। টেলিভিশন দেখায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। চলচ্চিত্র শিল্পকে তালেবানরা ধ্বংস করার আগেই ‘আফগান ফিল্ম অরগানাইজেশন’-এর সদস্য হাবিবুল্লাহ আলি কিছু রিল লুকিয়ে ফেলেন মাটির তলায়। যেগুলো পরবর্তীতে সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানা যায়।

‘পার্টিং’ ছবির দৃশ্যঅন্যদেশে আশ্রয় নিয়ে পরিচালনা
তালেবানি শাসনের প্রথম দফায় একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাতা আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা অন্য দেশে আশ্রয় নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। সেই ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখের দাবি রাখে, ‘শিরিন গুল-ও-শির আঘা’, ‘শেরাঘাই দঘলবাজ’, ‘ইন দ্য রং হ্যান্ডস’, ‘শেড অব ফায়ার’, ‘‌শেকাস্ত’ ইত্যাদি।


নতুনভাবে শুরু
২০০১ সালে আমেরিকান বাহিনী আফগানিস্তান দখলে নামলে সেদেশের চলচ্চিত্রে নতুন যুগ শুরু হয়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০২ সালে নতুন ছবি ‘টিয়ারড্রপস’ মুক্তি পায়। এর আগে ১৯৯৫ সালে বানানো হয়েছিল ‘ওরুজ’ নামে একটি ছবি। এর মধ্যে আর কোনও ছবি নির্মিত হয়নি। ১৯৯৬ সালের পর থেকে সে দেশে চলচ্চিত্র শুটিং করায় নিষেধা়জ্ঞা ছিল। সেই নিষেধাজ্ঞার পর ২০০৩ সালে তৈরি ‘ওসামা’-ই প্রথম ছবি, যার সব দৃশ্য আফগানিস্তানে ধারণ হয়। ছবির মূল চরিত্র ওসামা এক আফগান কিশোরী। কিন্তু তালেবানি শাসকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য পুরুষের ছদ্মবেশে দিনযাপন করত সে। তালেবানি শাষনে নারীদের অবস্থান কেমন ছিল, তা-ই দেখানো হয় ছবিটিতে। সেই বছরই ‘গোল্ডেন গ্লোব’ পুরস্কার পেয়েছিল পরিচালক সিদ্দিক বরমাক পরিচালিত এই ছবি।

সাহরা করিমি

নারীদের জয়গান
আফগানিস্তানের সিনেমার অন্যতম প্রধান ভাষা ‘নারী’। সেদেশের নারীদের বন্দিদশার গল্প ফুটে উঠতে থাকে সেলুলয়েডের পর্দায়। গত ২০ বছরে সে দেশের অভিনেত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন লীনা আলম, আমিনা জাফরি, সাবাহ শাহের, মরিনা গুলবাহারি প্রমুখ। অভিনেত্রী সাবাহ নিজে একজন পরিচালকও বটে। শুধু পরিচালক বললে কম বলা হবে, প্রথম আফগান মহিলা পরিচালক তিনি। ১৯৭৫ সালে জন্ম সাবার। দেশের প্রথম মহিলা প্রযোজকও তিনি। ২০০৪ সালে প্রথম ছবি ‘দ্য ল’। সাফল্য পায় সেই ছবি। তাঁর আরও একটি ছবি ‘পাসিং দ্য রেনবো’ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়।

‘দ্য কাইট রানার’ ছবির দৃশ্য২০২০ সালের ২৫ আগস্ট কাবুল যাওয়ার পথে তাঁকে গুলি করে তালেবানরা। সাবার সঙ্গে তাঁর দেহরক্ষী এবং গাড়িচালকও ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নারীর অধিকার নিয়ে ছবি বানানোর জন্য তার ওপর এমন আক্রমণ করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কিন্তু প্রথম দফার তালেবানি শাসনের পরের সময়ের বিচারে রোয়া সাদাতকে সে দেশের প্রথম নারী পরিচালক এবং প্রযোজক বলা হয়। তিনি এবং তাঁর বোন একটি প্রযোজনা সংস্থাও খুলেছিলেন। টেলিভিশনের জন্য নিয়মিত বিভিন্ন প্রগ্রাম বানাত এই প্রযোজনা সংস্থা। যেখানে নারীর অধিকার নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতো। যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় ২০১২ সালে তৈরি হয়েছিল ‘বুজকাশি বয়জ’। অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল স্যাম ফ্রেঞ্চ পরিচালিত দুই কিশোরের বন্ধুত্বের গল্প নিয়ে তৈরি সেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি।

বাইরের পরিচালকদের চোখে আফগান গল্প
ইরানের পরিচালক মহসিন মাখমালবাফ ২০০১ সালে আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে একটি ছবি বানিয়েছিলেন, ‘কান্দাহার’। সেটিই প্রথম আফগান ছবি, যা কান চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছিল। ছবির অধিকাংশ শুটিং হয়েছিল ইরানে। কিছু দৃশ্য গোপনে আফগানিস্তানেও শুটিং করা হয়।

‘এট ফাইভ ইন দ্য আফটারনুন’ ছবির দৃশ্যবর্তমান অবস্থা
সম্প্রতি তালেবান শাসনের দ্বিতীয় দফায় বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে তালেবান অভ্যুত্থান নিয়ে সরব হয়েছেন আফগানিস্তানের নারী চিত্র পরিচালক সাহারা করিমি। বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন, ‘ভারাক্রান্ত মনে অনেক আশা নিয়ে আপনাদের চিঠি লিখছি। আমাদের সুন্দর দেশটাকে, দেশের মানুষকে এবং শিল্প সচেতন মানুষকে তালেবানের হাত থেকে বাঁচান। গত কয়েক সপ্তাহে একাধিক প্রদেশ দখল করে নিয়েছে তালেবান। কতশত শিশুকে অপহরণ করেছে। বাজারে ছোট ছোট মেয়েদের বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। গত ২০ বছরে যা কিছু অর্জন করেছি, সব ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। আমি এবং আমার মতো শিল্প সচেতন মানুষ এখন ওদের হিটলিস্টে। কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারব না আমরা। অন্য ভাবে যোগাযোগের রাস্তাও হয়তো থাকবে না। হয়তো আর কয়েকটা দিনই আছে আমাদের হাতে।’

এক সাংবাদিক সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বললেন, ‘তালেবান শাসনে নারীদের কাজ করার অধিকার দেওয়া হবে। তাঁরা কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারবেন। তবে সবই হবে ইসলামিক আইন মেনে। ইসলামিক আইন মেনে নারীর অধিকার রক্ষা করা হবে। নারীরা তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। কিন্তু শরিয়তি আইনের বাইরে গিয়ে কিছুই হবে না।’ তা সত্বেও প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি আগের চেয়ে ভিন্ন একদম নতুন কিছু হবে? নাকি সবটাই মিধ্যে আশ্বাস?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত