Ajker Patrika

গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই, তবু কর চাই

  • করছাড়ের দিন শেষ: অর্থ উপদেষ্টা
  • বিপরীত অবস্থানে ব্যবসায়ীদের বক্তব্য।
  • করব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনে জোর।
  • অটোমেশন প্রকল্পে আসছে বন্ড ব্যবস্থা।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০১ মে ২০২৫, ০৮: ৫৯
আগামী বাজেট নিয়ে এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় অংশ নেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, কর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী নেতারা। ছবি: আজকের পত্রিকা
আগামী বাজেট নিয়ে এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় অংশ নেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, কর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী নেতারা। ছবি: আজকের পত্রিকা

কর দিতে গিয়েও দিতে হয় ঘুষ—শিল্পমালিকদের এই বিস্ফোরক ক্ষোভ এখন আর কানে কানে বলা গুঞ্জন নয়, বরং অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে প্রকাশ্য প্রতিবাদ। নিয়মিত করদাতারা পাচ্ছেন না ন্যায্য সম্মান, বরং তাঁদের ঘাড়ে চাপছে অতিরিক্ত বোঝা। উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই, অথচ কর চাই নিরবচ্ছিন্নভাবে। বিনিয়োগ থমকে, ভরসা হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এ অনিশ্চয়তার মধ্যে করছাড়ের ন্যায্যতা তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। তবে সরকারের জবাব ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু স্পষ্ট—‘করছাড়ের দিন শেষ।’ নিশ্ছিদ্র রাজস্ব আদায়ের এই বার্তা যেন আগাম জানিয়ে দিচ্ছে—আসছে বাজেটে ছাড় নয়, থাকবে কড়াকড়ি।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকালের আলোচনায় পরামর্শের টেবিল এভাবেই যেন রূপ নেয় দ্বন্দ্বের মঞ্চে, যেখানে মুখোমুখি হয় কর আদায়ের কঠোরতা আর ব্যবসায়ীদের বাস্তবতার চাপা ক্ষোভ। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় আলোচনায় অংশ নেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টারা, কর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী নেতারা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাফ জানিয়ে দেন—‘করছাড়ের দিন শেষ। এখন কর দিয়ে সুবিধা নিতে হবে।’ তিনি বলেন, সরকারের ওপর রাজস্ব বাড়ানোর ব্যাপক চাপ রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে ব্যবসায়ীদের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করকাঠামো মেনে চলতে হবে।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য একেবারে ভিন্ন সুরে। বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, ‘৩০ হাজার টাকার শুল্ক দিতে গেলে ৫০ হাজার টাকার ঘুষ লাগে’—এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও ব্যবসা বিপর্যস্ত। তিনি এনবিআরকে আহ্বান জানান নিজেদের ক্ষমতা কমিয়ে গঠনমূলক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে।

মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের কণ্ঠেও ঝরে পড়ে হতাশা। কুমিল্লা ইকোনমিক জোনে ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁদের গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ মেলেনি। তাঁর মতে, নিজের দেশের বিনিয়োগকারীদের এভাবে অবহেলিত রেখে বিদেশিদের আকৃষ্ট করা একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।

ভ্যাট নিয়ে ভিন্ন এক সমস্যা তুলে ধরেন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তাঁর অভিযোগ, ‘অনেক অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়, যা কর্মকর্তারা আটকে রেখে অহেতুক হয়রানি করেন।’ তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সোলার প্যানেল স্থাপন করে জ্বালানি-সংকটের সমাধানে ভূমিকা রাখতে চান, অথচ ইনভার্টার ও প্যানেলের ওপর উচ্চ হারে কর বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন এফবিসিসিআই সাধারণ করদাতার বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা ৩.৫ থেকে বাড়িয়ে ৪.৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করা সংগঠনটির প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় করকাঠামোর ভারসাম্যহীনতা সাধারণ নাগরিকদের বিপদে ফেলছে।

হাফিজুর রহমান প্রস্তাব করেন, রপ্তানি খাতে উৎসে করের হার আবার ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা হোক এবং তা আগামী পাঁচ বছর স্থায়ী হোক।

অপর দিকে সভাপতির বক্তব্যে এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান করপোরেট কর কমানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। তবে তিনি বলেন, এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের সম্পর্কোন্নয়নে করব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন জোরদার করা হচ্ছে। অটোমেশন প্রকল্পে বন্ড ব্যবস্থাও আনা হচ্ছে।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা বাজেটে প্রত্যাশার ফুলঝুরি দেব না, বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা আনব।’ পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ নিয়ে আমরা চিন্তিত নই, সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।’ তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কনীতি নিয়ে আলোচনার জন্য ৯০ দিন সময় রয়েছে, আলোচনায় সমাধান না হলে আরও সময় চাওয়া হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘এবারের বাজেট হবে ব্যয়ের উন্মাদনায় নয়, বাস্তবতার ভিত্তিতে তৈরি এক লক্ষ্যনির্ভর নথি।’

কর দিতে গিয়েও ঘুষ—ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ শুধু প্রশাসনিক গলদের নয়, বরং গভীর এক নীতিগত সংকটের প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র চায় রাজস্ব, ব্যবসায়ীরা চান স্বচ্ছতা—এ সম্পর্ক যদি বিশ্বাসের ভিত্তিতে না দাঁড়ায়, তবে অর্থনৈতিক উত্তরণের স্বপ্ন কথার দেয়ালে ঝুলে থাকবে। আর এ কথাগুলোর পেছনে রয়েছে এমন এক বাস্তবতা, যা একটি সভার গণ্ডি পেরিয়ে পুরো অর্থনীতিকে নাড়া দেয়।

আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান প্রমুখ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

‘ঘুষের জন্য’ ৯১টি ফাইল আটকে রাখেন মাউশির ডিডি: দুদক

রাখাইনে মানবিক করিডর কি প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদ হবে, ভারত-চীন কীভাবে দেখবে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত