Ajker Patrika

এনবিআর

আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর সরকারের কঠোরতায় প্রশ্ন

  • ৪ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, ১ জনকে বরখাস্ত
  • ১৬ কর্মকর্তার বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক
  • নতুন করে আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন
  • রাজস্ব কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা
আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৫, ১০: ০৯
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়, আগারগাঁও, ঢাকা। ফাইল ছবি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয়, আগারগাঁও, ঢাকা। ফাইল ছবি

ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় আন্দোলন স্থগিত করে গত ৩০ জুন ফের কাজে যোগ দিয়েছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে টানা দেড় মাসের স্থবিরতা কাটতে শুরু করে দেশের শুল্ক স্টেশনগুলোয়। গতি ফিরে আসে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। কিন্তু আন্দোলন শেষ হওয়ার পরপরই এনবিআরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে সরকার। এতে বিব্রত মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ীরা, শঙ্কা দেখা দিয়েছে রাজস্ব কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার।

আন্দোলন-পরবর্তী সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে ইতিমধ্যে এনবিআরের চার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে একজন কমিশনারকে। গত পাঁচ দিনে ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া এনবিআর কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষভাবে আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।

গত বুধবার এনবিআরের কর বিভাগের সদস্য আলমগীর হোসেন, শুল্কনীতি ও আইসিটি বিভাগের সদস্য হোসেন আহমদ, মূসক নীতি বিভাগের সদস্য আবদুর রউফ এবং বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার মো. শব্বির আহমেদকে অবসরে পাঠানো হয়। তার আগে মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অন্যদিকে গত ৫ দিনে ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ খুঁজে বের করতে তদন্তে নেমেছে দুদক।

গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআরের ৫ কর্মকর্তার বিষয়ে অনুসন্ধানের কথা জানায় দুদক। তাঁরা হলেন ঢাকা পূর্বের কমিশনার (কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট) কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল স্থলবন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, উপকর কমিশনার মো. মামুন মিয়া, অতিরিক্ত কর কমিশনার (আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট) সেহেলা সিদ্দিকা ও কর অঞ্চল-২-এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ।

অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অসাধু সদস্য ও কর্মকর্তারা কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেন।

এর আগে বুধবার ৫ জন এবং গত ২৯ জুন ৬ কর্মকর্তার বিষয়ে অনুসন্ধানের কথা জানায় দুদক। তাঁরা হলেন অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, সদস্য লুৎফুল আজীম, সিআইসির সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, উপকর কমিশনার মো. শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাসান, সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম, অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা, যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান, যুগ্ম কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কমিশনার হাসান তারেক রিকাবদার এবং অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুন্ডু। তাঁদের বেশির ভাগ এনবিআরের আন্দোলনে নেতৃত্ব ও সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন।

আন্দোলন ছেড়ে কাজে যোগ দেওয়ার পরও সরকারের এমন কঠোর পদক্ষেপে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভয় জেঁকে বসেছে। তাঁরা বলছেন, স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজে ফিরতে বললেও এখন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এ ঘটনায় বিব্রত মধ্যস্থতা করে আন্দোলন থামানো ব্যবসায়ীরা। সরকারের সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। বিষয়গুলো রাজস্ব খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে এবং এতে রাজস্ব কার্যক্রম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকার কর্মকর্তাদের ট্রান্সফার বা আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে কি না, সেটা জিজ্ঞেস করেছি। তাঁরা বলেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করবেন না, সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে দেখবেন। সে কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঐক্য পরিষদের নেতারা আমাদের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। যেহেতু আমাদের কথাতে তাঁরা কোনো শর্ত ছাড়াই আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। এরপরও যদি এসব ঘটনা হয়, তাহলে এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক।’

এনবিআর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের এভাবে অনুসন্ধানে নামার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছেন না কেউই। সরকারের সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, আন্দোলনটা যেভাবে করা হয়েছে, সেটা কোনোক্রমে সমর্থনযোগ্য নয়। তবে বর্তমানে সরকার স্বাভাবিকভাবে কঠোরতা দেখাচ্ছে। সরকারের উচিত ছিল কৌশলে বিষয়টিকে ম্যানেজ করা। তিনি আরও বলেন, সত্যিকারে কেউ যদি দুর্নীতি করে, অবশ্যই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এতে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বেছে বেছে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে প্রশ্নের উদ্রেক হয়। দমনপীড়ন দিয়ে ফলাফল আসে না। এতে এনবিআরের কর্মকর্তারা কাজে মনোযোগী হবেন না। স্বাভাবিকভাবে তখন রাজস্ব আদায় ব্যাহত হবে, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে এনবিআর বিলুপ্তি রোধসহ কয়েকটি দাবিতে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন। ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশটি সংশোধন করার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ২২ জুন থেকে চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু হয়। ২৮ ও ২৯ জুন কমপ্লিট শাটডাউন এবং মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালিত হয়। চট্টগ্রামের কাস্টম অফিস বন্ধ করে কর্মকর্তারা ঢাকার আন্দোলনে যোগ দেন। এতে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।

এমন স্থবিরতার মধ্যে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় ২৯ জুন রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করে পরদিন কাজে যোগ দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই দিন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সবাইকে সবকিছু ভুলে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে এরপর থেকে আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া এনবিআরের একজন অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, এখন পর্যন্ত যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাঁরা সবাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। বলা হচ্ছে, দুদক নিজেদের আইনমতো চলছে। দুদক কতটা আইনমতো চলে, সেটা সবাই জানেন। তিনি বলেন, যদি কোনো কর্মকর্তা সত্যিকার অর্থে অপরাধ করেন থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে পরেও ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে হলে তো বোঝার অপেক্ষা রাখে না, কেন হচ্ছে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব প্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং সুশাসন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এনবিআরের পদক্ষেপ হিসেবে সব কর্মকর্তার জন্য একটি নৈতিকতা এবং পেশাগত আচরণ নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এটি চূড়ান্ত হতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, ভবিষ্যতে কর্মকর্তাদের প্রতিহত করতেই কি এমন উদ্যোগ!

এ প্রসঙ্গে এক অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘আন্দোলন দমন করার জন্য কোড অব কন্ডাক্ট করা হচ্ছে। আমাদের আচরণ বিধিমালা আছে, সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য। এর বাইরে নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য আচরণ বিধিমালা নেই। তাহলে এনবিআরের জন্য কেন হবে? এতে বোঝাই যায়, উদ্দেশ্য ভালো নয়।’

এনবিআরের এক যুগ্ম কমিশনার বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের দক্ষতা অনন্য পর্যায়ের। সততা ও একাগ্রতাও প্রশংসনীয়।

সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। এক যুগ্ম কমিশনার বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টমসে রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কাজ হয়। যখন একজন সহকারী কমিশনার দেখবেন, এত কাজ করেও এই পরিণতি, তখন কি তিনি আর আগের মতো উদ্যমে কাজ করবেন? করবেন না। বিকেল ৫টা পর্যন্ত করে চলে যাবেন। এতে রাজস্ব আহরণে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এনবিআর কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিষয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব আবদুর রহমান খান বলেন, ‘এটার বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। এটা সরকারের নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর সিদ্ধান্ত। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’ এনবিআরের কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা আচরণবিধি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আলাদা করে কোনো কিছু করা হচ্ছে, এমনটি আমার জানা নেই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার নারীরা সব ক্ষেত্রে সরাসরি মামলা করতে পারবেন না

চাচাকে বিয়ে করতে না পেরে ৪৫ দিনের মাথায় স্বামীকে খুন করলেন নববধূ

ভারত যে পারমাণবিক বোমা ফেলেনি, পাকিস্তানের বুঝতে সময় লেগেছে ৩০-৪৫ সেকেন্ড

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ: বরখাস্তের দণ্ড বদলে বাধ্যতামূলক অবসর

‘ভিআইপি রুম না পেয়ে’ হোটেল বারে ভাঙচুর, যুবদলের পদ হারালেন মনির হোসেন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত