Ajker Patrika

বিনিয়োগ খরায় বাড়ছে ব্যাংকের সুদ ব্যয়

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৫
বিনিয়োগ খরায় বাড়ছে ব্যাংকের সুদ ব্যয়

সরকার পরিবর্তনের পর ঋণ দেওয়া-সংক্রান্ত শর্তাবলি শিথিল হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু সেই আমানত বিনিয়োগে রূপান্তরিত না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর হাতে জমা তারল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের আগস্টে এই অতিরিক্ত তারল্য ৩ লাখ কোটি টাকার ওপর পৌঁছেছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে আমানতকারীদের উচ্চ সুদ দিতে হচ্ছে, যা তাদের ব্যয়কে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকগুলো এই অতিরিক্ত টাকা সঞ্চয়কারীদের ৮-১০ শতাংশ হারে সুদ প্রদানে ব্যয় করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের আগস্টে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য পৌঁছেছে ৩ লাখ ৬ হাজার ১১২ কোটি টাকায়। একই সময়ে গত বছর এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ সংরক্ষণ করায় মোট তারল্য দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা, যদিও আগস্টে প্রকৃত চাহিদা ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ‘সরকারের পালাবদলের পর ব্যাংক খাতে কিছু সংস্কার ও পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ এখনো স্থিতিশীল হয়নি। উচ্চ সুদের হার, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগের পূর্ব হিসাবনিকাশ মিলিয়ে অনেকে ঋণ নিতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে ব্যাংকে মোটা অঙ্কের টাকা অলস পড়ে রয়েছে। এসব টাকার কোনো অর্থনৈতিক বা উৎপাদনশীল ব্যবহার হচ্ছে না। অথচ গ্রাহকের অর্থ জমা হওয়ার বিপরীতে বা আমানতকারীদের ঠিকই সুদ দিতে বাধ্য ব্যাংকগুলো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, আশা করা যায়, সামনে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হবে, তখন বিনিয়োগ বাড়বে। এতে ঋণের চাহিদা বাড়বে এবং তারল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে। ব্যাংকের সুদদণ্ডও একটা পর্যায়ে আর থাকবে না।’

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগস্ট শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৩ কোটি টাকা। প্রচলিত ধারার ৪৩ বেসরকারি ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। ১০টি ইসলামি ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য ৬ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা এবং ৯টি বিদেশি ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য ৩২ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকভিত্তিক অবস্থান অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য সর্বোচ্চ ৬২ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের ১৮ হাজার ৮৭৭ কোটি, পূবালী ব্যাংকের ১৮ হাজার ৩৯৮ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ১৮ হাজার ৩৫১ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ১৭ হাজার ৯০৫ কোটি, ডাচ্‌-বাংলার ১৬ হাজার ২২০ কোটি, যমুনা ব্যাংকের ১৪ হাজার ৮০১ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১২ হাজার ৫৫৩ কোটি, সিটি ব্যাংকের ১২ হাজার ৪৮১ কোটি এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ১২ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা।

অতিরিক্ত তারল্য হিসাব করা হয় স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) এবং ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) বজায় রাখার পর। ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকে মোট আমানতের ৪ শতাংশ নগদে এবং ১৩ শতাংশ ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে রাখতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের আগস্টে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ঋণে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ সময় ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিক বলেন, ‘বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম হওয়ায় ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে। যদিও তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিনিয়োগ অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকগুলো ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চেষ্টা করছে। একটা সময় পর বিনিয়োগ বাড়লে ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।’

পরিস্থিতি বদলালেই ঋণের চাহিদা বাড়বে, সুদ ব্যয় কমবে

মো. শওকত আলী খান

ব্যবস্থাপনা পরিচালক. সোনালী ব্যাংক

পরিস্থিতি বদলালেই উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে আগ্রহী হবেন, এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমবে অতিরিক্ত তারল্যের বোঝা। এভাবে ব্যাংক যখন স্বাভাবিক ঋণচক্রে ফিরে আসবে, তখন আমানতের বিপরীতে যে বড় অঙ্কের সুদ দিচ্ছে, সেই ব্যয়ও শূন্যে নেমে আসবে।

অন্যদিকে ব্যাংকের শক্তির মূল ভরসাই গ্রাহক। রাজনৈতিক পালাবদলের পর দুর্বল ব্যাংকগুলোর নানান দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলে আসায় অনেক আমানতকারী তাঁদের টাকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফলে এসব ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের আমানত সরতে থাকে এবং তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোয় জমা হতে থাকে। এতে কম সময়ে ভালো ব্যাংকগুলোর তারল্য দ্রুত ফুলে ওঠে। কিন্তু এই প্রবাহ যত দ্রুত বাড়ছে, সেই গতিতে ঋণ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই-বাছাই, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং ভালো গ্রাহক চিহ্নিত করতে সময় লাগে। এতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা শ্লথ হলেও আমানত সংগ্রহের ধারাবাহিকতা কিন্তু থেমে থাকে না। সেই কারণে তারল্যের পাহাড় তৈরি হয়, যা বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ না থাকলে ব্যাংকের জন্য চাপ হয়ে দাঁড়ায়।

সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ব্যাংক ঋণ বিতরণ বাড়াতে না পারলেও অলস পড়ে থাকা আমানত যেন অকার্যকর না হয়, এ জন্য তারা অগ্রাধিকার খাতে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি সরকারি সিকিউরিটিজ, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। কারণ, আমানতকারীদের সঞ্চয়ের অর্থ ব্যাংক যতক্ষণ ধরে রাখে, ততক্ষণই তাদের সুদ দিতে হয়। ফলে বিনিয়োগ স্থবির থাকলে এই সুদই পরিণত হয় ব্যাংকের বাড়তি ব্যয়ে।

তবে অর্থনীতিতে আবার গতি ফিরলে এবং বিনিয়োগের পরিবেশ পরিষ্কার হলে এখন ব্যাংকগুলোর হাতে জমে থাকা এই তারল্যই আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে। অতএব পরিস্থিতি বদলালে অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগ এলে, ঋণের চাহিদা বাড়লে বর্তমান উদ্বৃত্ত তারল্য আর থাকবে না; বরং ব্যাংকিং খাতকে স্বস্তির জায়গায় ফিরিয়ে আনবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ