Ajker Patrika

রেমিট্যান্সের প্রবাহ: রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায়

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহের নতুন এক অধ্যায় তৈরি হয়েছে। সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে, একক মাসে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ২০২৪ সালে প্রবাসীরা মোট ২৭ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা শুধু অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক নয়, সংকটের মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।

২০২৩ সালে প্রবাসী আয় ছিল ২১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে এই প্রবাহে যে বিস্ময়কর ঊর্ধ্বগতি ঘটেছে, তা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই নতুন রেকর্ড শুধু একটি আর্থিক পরিসংখ্যান নয়; এটি একটি বড় প্রক্রিয়ার অংশ, যা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে। প্রবাসীরা যখন তাঁদের পরিবারকে রেমিট্যান্স পাঠান, তখন তাঁরা শুধু টাকা পাঠাচ্ছেন না, বরং দেশের উন্নয়নের জন্য একটি শক্তি জোগাচ্ছেন। এই অর্থপ্রবাহ দেশের অগ্রগতির প্রমাণ এবং এটি মানুষকে একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়ার শক্তি দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করছেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির ক্রমশ উন্নতি, দেশের প্রতি প্রবাসীদের অবিচল সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবেশে বাংলাদেশের কার্যকর নীতি সহায়তা এই রেকর্ড অর্জনে সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা দেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আগমন। প্রতিদিন গড়ে ৮ কোটি ৫১ লাখ ডলার প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এর আগে, ২০২০ সালের জুলাইতে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে, তবে বর্তমানে তা অতিক্রম করেছে।

রেমিট্যান্সের উন্নতি: কেন এই হালচাল?

বর্তমান রেমিট্যান্স বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ হলো সরকারি উদ্যোগ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ফল। ২০২৪ সালে জুলাইয়ে, যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কোটাবিরোধী আন্দোলন ছিল, তখন রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। প্রবাসী আয় এসেছিল মাত্র ১৯১ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রবাসীরা আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। বিশেষত, সরকারি নীতির প্রতি আস্থার ফলে বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে তাঁদের আয় পাঠাচ্ছেন, যা রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ানোর অন্যতম কারণ।

এর ফলে ২০১৯ সালে যেখানে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৪ সালে তা থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হুন্ডি বা অবৈধ চ্যানেলের ব্যবহার কমে যাওয়ার ফলে এই প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা বৃদ্ধি, ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রবাসীরা এখন আরও বেশি ব্যাংকিংমাধ্যম ব্যবহার করছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, ‘এত দিন দেশের অর্থ পাচারের কারণে রেমিট্যান্স কাঙ্ক্ষিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পাচারের ওপর সরকারের কঠোর নজরদারি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নতি এই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। এখন অর্থ পাচার থামানো গেলে রেমিট্যান্স আরও দ্রুত বাড়বে।’

প্রবাসী কর্মীদের সংখ্যা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি রেকর্ড করেছে। ২০২৪ সালের প্রথম ৬ মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মী গেছেন ৫ লাখ ২৬ হাজার ৮৩৭ জন। আর ২০২৩ সালে গেছেন ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ কর্মী; যা একটি বিশাল অর্জন। যদিও কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে এর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে রেমিট্যান্সের প্রবাহে কিছুটা অমিল ছিল। কারণ, অনেক প্রবাসীর রেমিট্যান্স দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসতে পারে না, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির সঙ্গে হুন্ডির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তবে রেমিট্যান্স দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেল এবং সরকারের নীতি শক্তিশালী হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আরও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরও দ্রুত বেড়ে যায়। সার্বিকভাবে ফাঁকফোকর দূর করা গেলে একটা সময় দেশে প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসবে।’

রেমিট্যান্সের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

অর্থনীতির জন্য রেমিট্যান্স এখন শুধু একটি আয় নয়, এটি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে না, বরং নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছে। প্রবাসী আয় যত বেশি হবে, তত বেশি দেশে অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নত হবে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘এখন প্রবাসী আয় আসার প্রবাহ বেড়েছে, এটি আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। রেমিট্যান্সের এই প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতি ও রিজার্ভের উন্নতি ঘটাবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত