Ajker Patrika

বাংলাদেশের এলএনজির চালান ‘মাঝপথে ঘুরে যাচ্ছে’ ইউরোপে

আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২২, ১৮: ০৪
বাংলাদেশের এলএনজির চালান ‘মাঝপথে ঘুরে যাচ্ছে’ ইউরোপে

উচ্চ চাহিদার কারণে ইউরোপে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম সর্বোচ্চ। আর তাই অন্য দেশের গন্তব্যে থাকা এলএনজির চালান পথ বদলে বেশি লাভজনক ইউরোপের বাজারে যাচ্ছে।

এর ফলে স্পট মার্কেটে এলএনজির চালান কেনায় ইউরোপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটছে বলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

বিশ্ব পণ্যবাজার নিয়ে বুধবার প্রকাশিত ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’ শীর্ষক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, ডলারের বিপরীতে বিশ্বের অন্য সব মুদ্রার রেকর্ড দরপতনের ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও জ্বালানির সংকট তীব্রতর হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

সরকারের হিসাবে বাংলাদেশের মোট জ্বালানি ব্যবহারের প্রায় ৬২ শতাংশই প্রাকৃতিক গ্যাস, যার মধ্যে ৮ শতাংশ চাহিদা আমদানি করা এলপিজি দিয়ে মেটানো হয়। বাকি ৩৮ শতাংশ জ্বালানি চাহিদার বেশির ভাগটা আমদানি করা তেল দিয়ে মেটানো হয়।

এর বাইরে জ্বালানির উৎস হিসেবে দেশে কয়লার বড় মজুত থাকলেও তার উৎপাদন ও ব্যবহার দুটোই কম। অন্যদিকে তরল গ্যাসের মজুত খুব বেশি না হলেও প্রাপ্ত উৎসের মধ্যে এর উৎপাদন ও ব্যবহারই বেশি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, তেলের মতো অন্যান্য বিকল্পের ব্যবহার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারছে না। তবে জাপান ও কোরিয়ার মতো বড় এলএনজি আমদানিকারকেরা তাদের বেশির ভাগ এলএনজি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কিনে থাকে। এর ফলে স্পট মার্কেটে দাম বাড়লে এরা বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

তবে এ দুটি দেশই প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে সরে গিয়ে জ্বালানি ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনতে চায়। এজন্য তারা পরমাণু শক্তি পুনর্ব্যবহারেরও পরিকল্পনা করছে। মেরিন ট্রাফিকের হিসাবে, এখন ৬০টি ট্যাংকার বা বিশ্বের এলএনজি নৌযানের ১০ শতাংশ এখন উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর, ইবেরিয়ান উপদ্বীপ এলাকায় চলাচল করছে বা নোঙর করে আছে।

 ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় শীতের আগে ইউরোপের জ্বালানির চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। সে কারণে এলএনজি ট্যাংকারগুলো সেদিকে ছুটছে। চাহিদার চেয়ে সংরক্ষণক্ষমতা কম থাকায় সেগুলোকে জলরাশিতেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে সিএনবিসির খবরে বলা হয়েছে।

বৈশ্বিক পণ্যবাজার পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে খাদ্য ও জ্বালানির দাম এমনভাবে হুহু করে বাড়ছে যে এসব দেশের চলমান খাদ্য ও জ্বালানির সংকটকে তা তীব্রতর করতে পারে।

আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির হিসাবে, ঘনিয়ে আসা মন্দার শঙ্কার মধ্যে ডলারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম চূড়ায় উঠেও সম্প্রতি কিছুটা কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর থেকে আগস্ট পর্যন্ত ডলারে অপরিশোধিত তেল ব্রেন্টের দর প্রায় ৬ শতাংশ কমেছে। তবু আমদানিকারক ও উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় মুদ্রায় তেলের দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। একইভাবে গমের দামেও ব্যাপক উচ্চমূল্যের মুখোমুখি হয়েছে এসব দেশের ৯০ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি পণ্যের উচ্চমূল্য বাড়িয়েছে খাদ্যের দাম। ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল গড়ে ২০ শতাংশের বেশি, যা বিশ্বে অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়াসহ অন্যান্য অঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি গড়ে ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে ছিল। তবে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরই একমাত্র অঞ্চল, যেখানে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কম ছিল। এর জন্য চালের দামের স্থিতিশীলতাকে মূল অবদান হিসেবে দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

বিশ্বব্যাংকের সুষম প্রবৃদ্ধি, অর্থ ও প্রতিষ্ঠান বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট পাবলো সাভেদ্রা এক বিবৃতিতে বলেন, পণ্যের দাম যতটুকু কমেছে, তা হিসাবে ধরেও গত পাঁচ বছরে গড় মূল্য স্তরের চেয়ে অনেক বেশি। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যের সংকট দীর্ঘায়িত হতে পারে।

‘আর তাই অবাধ খাদ্য সরবরাহ ও সুষম বিতরণ এবং মানুষের প্রকৃত আয়ে সহায়তা বা ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য একগুচ্ছ নীতিমালার জরুরি বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জ্বালানির দামে বেশ অস্থিরতা ছিল। তবে ধীরে ধীরে দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি বছরে জ্বালানির দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বাড়লেও ২০২৩ সালে তা প্রায় ১১ শতাংশ কমবে বলে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। তবে এই কমার পরও জ্বালানির দাম গত পাঁচ বছরের চেয়ে গড়ে ৭৫ শতাংশ বেশি থাকবে।

২০২৩ সালে ব্রেন্টের দাম প্রতি ব্যারেল ৯২ ডলার হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা পাঁচ বছরের গড় দামের চেয়েও বেশি। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লার দামও কমার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে ২০২৪ সালের মধ্যে অস্ট্রেলীয় কয়লা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বিগত পাঁচ বছরের গড় দামের দ্বিগুণ হবে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম প্রায় চার গুণ বেশি হতে পারে।

কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক তৈরির দায়িত্বে থাকা বিশ্বব্যাংকের প্রসপেক্ট গ্রুপ ডিরেক্টর আয়হান কোস বলেন, পণ্যের উচ্চমূল্য এবং ক্রমাগত মুদ্রার অবমূল্যায়ন অনেক দেশকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তবে কয়েক দশকের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির এই চক্রের লাগাম হাতে রাখতে নতুন বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নীতি-নির্ধারকদের খুব বেশি কিছু করার নেই বলে তিনি মনে করেন।

আয়হান কোস বলেন, ‘খুব সর্তকতার সঙ্গে মুদ্রা ও আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন করে পরিকল্পনাগুলো সুস্পষ্টভাবে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হাবে তাঁদের। পাশাপাশি বৈশ্বিক আর্থিক ও পণ্য বাজারে আরও উচ্চ অস্থির সময় মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’

কৃষিপণ্যের দাম আগামী বছর ৫ শতাংশ কমার আশা করা হচ্ছে। আর গমের দাম এ বছর তৃতীয় প্রান্তিকে ২০ শতাংশ কমেও এক বছর আগের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি।

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সিনিয়র ইকোনমিস্ট জন ব্যাফেস বলেন, কৃষিপণ্যের দাম কমার পূর্বাভাস কতগুলো ঝুঁকি ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত, ইউক্রেন বা রাশিয়া থেকে রপ্তানিতে ব্যাঘাত আবারও বিশ্বব্যাপী শস্য সরবরাহে বাধা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, জ্বালানির দামের চরম বৃদ্ধি শস্য ও ভোজ্যতেলের দামে ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয়ত, বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফলন কমতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত