Ajker Patrika

রণাঙ্গনে ঈদ

মাহবুব আলম
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২২, ১৭: ৫১
রণাঙ্গনে  ঈদ

রমজান মাস শেষ হয়ে আসে। ঈদুল ফিতর এসে যায়। যুদ্ধের ভেতর দিয়েই একটা রোজার মাস পার হয়ে গেলো। ছেলেরা যুদ্ধের মাঠে ঈদ উৎসব পালনে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আমি লাঠিতে ভর দিয়ে পিন্টুর সাথে ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াই সামনের চত্বরে। শীতের রৌদ্রে শরীর এলিয়ে বসে থাকি ঘাসের গালিচায়।

ঝকঝকে সুন্দর দিন। ফসলের ক্ষেতে নুয়ে পড়া সোনালি ধানের পাকা শীষ যেনো আগুনে রঙ ছড়ায়। ভেসে আসে জমি থেকে পাকা ধানের গন্ধ।

মনে পড়ে পাকা সড়কের পার্শ্ববর্তী লোকজনের আকুতিভরা কথা। তারা যেনো ধান কাটতে পারে, কঠোর শ্রমে ফলানো সোনালি ফসল তারা তাদের ঘরে তুলতে পারে, সে ব্যাপারে তারা আমাদের সাহায্য চেয়েছিল। সেই ফসল কাটার সময় তো প্রায় এসে গেল। তাদের আমরা কথা দিয়েছি। ফসল কাটার সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে হবেই। মন বলে, ফসল কাটার কাজ ঠিকঠাক মতোই শেষ হবে। দখলদার পাকবাহিনী আমাদের সে চেষ্টা রুখতে পারবে না যতো কিছুই করুক।

ঈদ এসে গেলো।

ছেলেরা ঈদ উৎসব পালনের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে।

একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে এ রকমের যে, ঈদের দিন পাক আর্মি ব্যাপকভাবে হামলা করবে সীমান্ত এলাকাগুলো জুড়ে। খবরটা যেভাবেই ছড়াক, যথেষ্ট বিচলিত করে তোলে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঈদের নামাজের জন্য জামাতে দাঁড়াবে ঠিক সে সময়ই নাকি করা হবে এই হামলা।

যুদ্ধের মাঠে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য কোনো তৎপরতাকেই অবিশ্বাস করা যায় না। ঈদের দিন মুক্তিবাহিনীর দল যখন ঈদ উৎসবে মেতে থাকবে, তারা নামাজ পড়তে দলবদ্ধভাবে কোথাও সমবেত হবে, তখুনি সুযোগ বুঝে তারা হামলে পড়বে অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। খবর যখন রটেছে, এ ধরনের হামলা তখন পাকবাহিনীর তরফ থেকে হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই পাকবাহিনীর তরফ থেকে এ ধরনের সম্ভাব্য হামলাকে সামনে রেখে আমরা ঈদুল ফিতর উৎসব উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিই। ঈদ মুসলমানদের জন্য প্রধান উৎসবের দিন। জন্ম থেকেই সবাই এই উৎসব পালন করে এসেছে যার যেমন সঙ্গতি, সে অনুযায়ীই। এখানেও যুদ্ধের মাঠে ছেলেরা ঈদ উৎসব পালনের জন্য মেতে উঠেছে। ঈদের নামাজ পড়া হবে না, ঈদের উৎসব হবে না, ভালো খাওয়াদাওয়া হবে না, ঈদের দিন সবাই হাতিয়ার হাতে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে থাকবে, এ রকম একটা কিছু কেউই যেনো মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।

১৯৭১-এ ঈদের নামাজে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীযুদ্ধের মাঠে, দিনরাত ক্লান্তিহীন যুদ্ধ প্রক্রিয়ার ভেতরে ছেলেদের রিক্রিয়েশান বলতে কিছু নেই। দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের একঘেয়ে কাজ। অপারেশন আর যুদ্ধ। এ হাইড আউট থেকে অন্য হাইড আউট। গোলাবারুদ আর হাতিয়ার বয়ে বেড়ানো। ছুটি নেই, আরাম নেই, বিশ্রাম নেই। বড়ো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর জীবন সবার। এর মধ্যে ঈদের উৎসব একটা খুশির আবহ নিয়ে এসেছে। ছেলেদের এই খুশির ভাগ থেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করে না। পিন্টুসহ বসে তাই সিদ্ধান্ত নিই। আর সেটা এ রকমের। ঈদের দিন নামাজ হবে, বড়ো খানার আয়োজন করা হবে। মোদ্দা কথা, ঈদ উৎসব পালন করা হবে যথাসাধ্য ভালোভাবেই। সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও ছকে ফেলে সবাই একসঙ্গে বসে।

সিদ্ধান্ত হয়, ঈদের আগের দিন সবগুলো দল দু’ভাগে ভাগ হবে এবং সমবেত হবে দু’জায়গায়। নালাগঞ্জ আর গুয়াবাড়িতে। ছেলেরা তাদের নিজেদের মতো করেই ঈদ উৎসব পালন করবে।

তবে নামাজ পড়বে একেবারে সীমান্তের ধার ঘেঁষে। গুয়াবাড়িতে সমবেত ছেলেরা ভারতীয় সীমান্তে উঁচু গড়ের পাদদেশে গিয়ে জামাত পড়বে। নালাগঞ্জে জামাত হবে আমগাছতলায় পুকুরের পাড়ে।

মুসলমান ছেলেরা যখন ঈদের জামাতে দাঁড়াবে, তখন হিন্দু ছেলেরা কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে হাতিয়ার হাতে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। হিন্দু সহযোদ্ধাদের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান ছেলেরা নামাজ পড়বে।

এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়িতে একরামুলের কাছে। সোনারবানে বকর ও শামসুদ্দিনের কাছে। নালাগঞ্জে মুসা আর চৌধুরীও সেভাবেই তৈরি হয়। হিন্দু ছেলেরা তাদের মুসলমান ভাইদের নামাজের সময় পাহারা দেবার দায়িত্ব পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে এই যুদ্ধের মাঠে জীবনমরণের মাঝখানেই সবার বসবাস। এক ধর্মের মানুষ ধর্মীয় আচরণ পালন করবে, আর তাদের নিরাপদ রাখার জন্য ভিন্ন ধর্মের মানুষ হাতিয়ার হাতে পাহারা দেবে, আমার কাছে এ অভাবনীয় আর মহান মানবিক ঘটনা বলে মনে হয়। হিন্দু ছেলেদের সংখ্যা বেশি না হলেও ঈদের জামাতের সময় তাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্য নিয়েই তারা তাদের মুসলমান ভাইদের কিভাবে নিরাপত্তা বিধান করবে, তার পরিকল্পনায় মেতে ওঠে।

ঈদের বড়ো খানার আয়োজনের বাজেট নিয়ে বসে মিনহাজ। সকালে রান্না হবে শেমাই। দুপুরে কোর্মা-পোলাও ইত্যাদি। আর সে অনুসারেই হিসেব-নিকেশ করে লম্বা একটা ফর্দ তৈরি করে ফেলে সে। হিন্দু ছেলেরা রয়েছে, সেহেতু গরু চলবে না। গ্রামের বন্ধুরা তাদের শুভেচ্ছাস্বরূপ পাঠিয়ে দেয় ৪টা খাসি। এর মধ্যে দুটো পাঠিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়িতে সেখানকার ছেলেদের জন্য। মুন্না এসেছে গুয়াবাড়ি থেকে। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে বেশ বিচলিত সে। তাকে বলি, ‘মন খারাপ করছিস কেনো? ভালো তো হয়ে উঠছি।’

আমার শিয়রে বসে থাকে সে অধিকাংশ সময়। আপন রক্ত, ডেকে কথা বলে। থেকে থেকেই।

সে জিগ্যেস করে, কষ্ট হচ্ছে মামা? আমি ওর জিজ্ঞাসার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলি, ঈদ এসে গেল, কাপড়চোপড় তো তোর নেই। জলপাইগুড়ি গিয়ে নতুন কাপড়চোপড় বানিয়ে নে।

ও আপত্তি করে। বলে এতগুলো ছেলে, কারুরই তো নতুন কাপড়জামা হলো না মামা।—তাতে কি হয়েছে। আমাদের যা আছে, তা দিয়েই চলে যাবে, তুই বানিয়ে নে। কেউ এতে কিছু মনে করবে না। এদের সবারই তুই প্রিয় ভাগনে।

মুসা ঈদের ফর্দ আর টাকাকড়ি নিয়ে জলপাইগুড়ি যায় সাথে দু’জন নিয়ে। মুন্নাকেও মুসার সাথে নিয়ে দিই। যাবার সময় বলি, জলপাইগুড়িতে কাপড়চোপড় কিনে সে যেন কোর্টগোছ চলে যায় তার আগেকার আস্তানায়। সেখানে সবার সাথে ঈদ করাও হবে, তাদের খোঁজখবর নেয়াও হবে। সেখানকার পরিচিত শরণার্থী পরিবারটির ছেলেমেয়েদের জন্য কাপড়চোপড় কেনার জন্য তাকে অতিরিক্ত কিছু অর্থ ধরিয়ে দিই। যুদ্ধের মাঠ থেকে তাদের জন্য কিছুটা উপহার সামগ্রী প্রেরণের জন্য মনের গভীর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করি। বারবার মনে পড়ে স্বপ্নময় একটা মুখ। নিদারুণ নিঃসঙ্গ আর একাকিত্বের ম্লান সেই মুখ। গভীর এক প্রত্যাশার ছায়া। তার সেই চোখেমুখে। হয়তো কেবলই ভাবনা, কবে শেষ হবে এই যুদ্ধ।

মুন্নাকে নিয়ে মুসা তার কেনাকাটা করার জন্য দলবলসহ চলে যায় জলপাইগুড়ির দিকে। মোতালেব তার একদল উৎসাহী সহযোগী নিয়ে পুকুরপাড়ের ঈদগাহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে মেতে ওঠে। কাল ঈদ। সমস্ত হাইড আউট মেতে ওঠে আনন্দে। একজন মৌলবী পাওয়া যায় স্থানীয়ভাবে। তিনি পড়াবেন নামাজ।

সন্ধ্যার পর ফিরে আসে মুসা। হতাশ মুখে জানায় সারা জলপাইগুড়ি বাজার খুঁজে শেমাই পাওয়া যায়নি। কথাটা শুনে মনে প্রথমে কেমন ধাক্কা লাগে। বলে কি! শেমাই পাওয়া যায়নি মানে? তারপরই মনে হয়, জলপাইগুড়ি তো আর আমাদের বাংলাদেশের শহর নয়, ইন্ডিয়ার। সেখানে মুসলমান খাবার হিসেবে বিবেচিত শেমাই না পাওয়ার ব্যাপারটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক আছে শেমাই যখন নেই, তখন চাল-দুধ দিয়ে পায়েস করেই ঈদের সকালের মিষ্টির কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে। মিনহাজকে সেইভাবেই মেনু করতে বলি। ঈদের দিনের সকাল। উৎসবমুখর পরিবেশ। সবাই আনন্দে উচ্ছল। পাশাপাশি চরম উত্তেজনা পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ হতে পারে। ভরতের নেতৃত্বে ৮-১০ জন হিন্দু ছেলে এগিয়ে খালের পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়।

সকাল ন’টায় ঈদের জামাত শুরু হয় পুকুরপাড়ে। আমি নিজে দাঁড়াতে এবং লাঠি ধরে চলাফেরা করতে পারলেও নামাজ পড়তে পারি না। ওরা সবাই ঈদগাহের মতো জায়গায় পরম পবিত্র মনে নামাজে দাঁড়ায়। আমিও লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি জামাতের কাছাকাছি অবস্থানে। যাহোক, যুদ্ধের মাঠেও তাহলে আমরা নামাজ পড়তে পারছি! গভীর এক প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। সতৃষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি ঈদের জামাতের দিকে। না, শত্রুর হামলা হয় না। তাই হৈচৈ করে, উৎসবের খাওয়াদাওয়া নিয়ে আনন্দে আনন্দে গড়িয়ে যায় দিনটি।

মাহবুব আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সচিব

‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ বই থেকে (বানান অপরিবর্তিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রশিক্ষণ ছাড়াই মাঠে ৪২৬ সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা

গ্রাহকের ২,৬৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৪৬ বিমা কোম্পানি

‘এই টাকা দিয়ে কী হয়, আমি এত চাপ নিচ্ছি, লাখ পাঁচেক দিতে বলো’, ওসির অডিও ফাঁস

মারধর করে ছাত্রলীগ কর্মীর পিঠে পাড়া দিয়ে অটোরিকশায় শহর ঘোরাল ছাত্রদল, সঙ্গে উচ্চ স্বরে গান

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়: তিন দফা দাবিতে সোমবার মাঠে নামছেন শিক্ষার্থীরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত