Ajker Patrika

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে পরিবহনসেবা কমিয়ে ‘শিক্ষার্থীদের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ’

শাপলা খন্দকার, বগুড়া
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১০: ৫৯
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে পরিবহনসেবা কমিয়ে ‘শিক্ষার্থীদের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ’

বগুড়ার সুপরিচিত ও বৃহৎ সরকারি কলেজ আজিজুল হক কলেজ। উত্তরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে আসেন শিক্ষার্থীরা। স্থানীয়দের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি থেকেই যাওয়া-আসা করেন। এক বছর আগে পরিবহনসেবা সীমিত করায় নিয়মিত ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা । ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কমেছে।

এক বছরের বেশি সময় ধরে কলেজের বাসগুলো শিক্ষার্থীদের শুধু নিয়ে আসছে, কিন্তু ক্লাস শেষে তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে না। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রীরাও গণপরিবহনে যাতায়াত করায় অনিরাপদ বোধ করেন। এর ফলে একদিকে পরিবহনে তাঁদের দেওয়া ফি যেমন আত্মসাৎ করা হচ্ছে, তার ওপর বাড়তি গাড়িভাড়াও দিতে হচ্ছে তাঁদের। এমন পরিস্থিতিতে ভাড়ার টাকা জোগানোর সামর্থ্য না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী কলেজেই আসছেন না।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর পরিবহন ফি বাবদ আদায় করা হয় মাথাপিছু ২৭৫ টাকা। ২৬ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২৭৫ টাকা করে নিলে বছরে কলেজের কোষাগারে জমা হয় ৭১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এখন পরিবহন সীমিত করে কলেজ থেকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া বাদ দিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ এক বছরে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষার্থীরা। 

কলেজ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি আজিজুল হক কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী আছেন মোট ২৬ হাজার। এদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রী হলে থাকেন ৬০০ জন। ব্যক্তিগত খরচে মেসে থাকেন আনুমানিক ১১ হাজার জন। বাকি প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়া-আসা করেন। 

কলেজের পরিবহন পুলের মোট সাতটি বাসে ৩১০টি আসন আছে। একটি বাস জেলা সদরের শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য বরাদ্দ। বাকি ছয়টি বাস যায় সোনাতলা উপজেলার সদর রেলঘুণ্টি, সারিয়াকান্দির উপজেলা বাজার, নন্দীগ্রামের সদর বাজার, শেরপুর-ধুনট মোড়, দুঁপচাচিয়ার জে কে কলেজের সামনে ও শিবগঞ্জের পীরবে। 

এসব বাসস্টপে সকাল ৮টায় গিয়ে বাস থামে; শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজে পৌঁছায়। কিন্তু বিকেলে ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা হয় না। সকালে কলেজ বাসে এলেও শিক্ষার্থীদের ফিরতে হয় নিজ খরচে, নিজ দায়িত্বে। এই অবস্থা চলছে গত বছরের (২০২১) ১২ সেপ্টেম্বর থেকে। 

এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা; দৈনিক ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি খরচ হচ্ছে তাঁদের। কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আর পরিবহনসেবা না থাকার কারণে কমেছে ক্লাসে তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিতি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি বিভাগের প্রথম বর্ষের ২০০ জনের মতো শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও এ বছর তা কমে ৩০-৫০ জনে ঠেকেছে। 

আজ সোমবার কলেজে গিয়ে দেখা যায়, বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ক্লাসে ৩০ জন উপস্থিত আছেন। এই বিভাগের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০ জন। হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ক্লাসে উপস্থিত আছেন ৬৫ জন শিক্ষার্থী। এই বিভাগের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩২৫ জন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমার ক্লাসে শুরুর দিকে ১৫০ জনের মতো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এখন ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে।’

দুপচাঁচিয়া থেকে কলেজে আসেন হিসাববিজ্ঞান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী লক্ষ্মণ চন্দ্র বর্মণ। তিনি বলেন, ‘দুপচাঁচিয়ায় যেতে আমার ৬৫ টাকা ভাড়া লাগে। সপ্তাহে চার দিন কলেজে এলে খরচ দাঁড়ায় ২৮০ টাকা। মাসে খরচ হয় ১ হাজার ১২০ টাকা। আমার কৃষক পরিবার। আমি এত টাকা জোগাতে পারি না। তাই কলেজেই আসা কমিয়ে দিয়েছি।’

ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার বলেন, ‘দূর থেকে কলেজে আসা-যাওয়া করি। কলেজের বাসে নিশ্চিন্তে আসা যায়। কিন্তু অন্যান্য যানবাহনে এলে অনিরাপদ বোধ হয়। মা কলেজে আসতে নিরুৎসাহিত করেন।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কলেজ থেকে সোনাতলা বাসস্টপের দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার, সারিয়াকান্দির ২২ কিলোমিটার, নন্দীগ্রাম ২০ কিলোমিটার, শেরপুর-ধুনট মোড় ২২ কিলোমিটার এবং শিবগঞ্জ ১৭ কিলোমিটার। দূরত্ব অনুযায়ী ছয়টি উপজেলায় প্রতিদিন সকাল-বিকেল দুবার যাওয়া-আসা করতে জ্বালানি প্রয়োজন হয় ২০৬ লিটার।

প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ১০৯ টাকা করে হলে দৈনিক ব্যয় ২২ হাজার ৪৫৪ টাকা। সপ্তাহে ৫ দিন কলেজ খোলা থাকে। সে হিসাবে এক বছরে (২৪০ দিন) এই খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬০ টাকা। এক বেলা আসা-যাওয়ায় জ্বালানি খরচ হয় এর অর্ধেক অর্থাৎ ২৬ লাখ ৯৪ হাজার ৪৮০ টাকা। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা বাৎসরিক পরিবহন ফি থেকে এই খরচ বাদ দিলে দেখা যায়, এক বছরে লুট হচ্ছে ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫২০ টাকা।

আজিজুল হক কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জেলা শাখার সভাপতি ধনঞ্জয় বর্মণ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আবাসিক-অনাবাসিক সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরিবহন ফি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম পরিবহনসেবা দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। এই অনিয়ম শিক্ষার্থীরা মেনে নেবেন না।

‘এমনিতেই কলেজের ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে বাসের সংখ্যা অপ্রতুল। তার পরও শিক্ষার্থীদের বাসায় পৌঁছে দেওয়া বন্ধ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

এ বিষয়ে জানতে আজ সোমবার বিকেলে সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে মিটিং করার জন্য ঢাকায় এসেছি। আপনি পরে ফোন করেন।’

উনি সন্ধ্যায় কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় তাঁকে ফোন দেওয়া হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

পরে কলেজের পরিবহন পুলের দায়িত্বে থাকা আরবি শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুর রশিদের কাছে গত সেপ্টেম্বর থেকে বাস বন্ধ থাকার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আসলে অর্থ সাশ্রয়ের জন্য এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন জ্বালানির দাম বেশি, আমাদের ওপর ব্যয় সংকোচন এবং অপচয় রোধ করার তাগিদ রয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত