Ajker Patrika

দুদিনের ব্যবধানে দুই শিশুর মৃত্যু: সন্তানের দাফনেও যেতে পারলেন না প্রভাষক দম্পতি

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩: ১১
দুদিনের ব্যবধানে দুই শিশুর মৃত্যু: সন্তানের দাফনেও যেতে পারলেন না প্রভাষক দম্পতি

আসছে ২ মার্চ দুই বছরে পড়ত মুনতাহা মারিশা। আর ৩০ মে পাঁচ বছর পূর্ণ হতো মুফতাউল মাশিয়ার বয়স। ফুটফুটে দুই বোন একসঙ্গেই খেলত। হঠাৎ জ্বর আর বমির কারণে মারিশাকে নেওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। কিন্তু পথেই সে মারা যায়। 

ছোট বোনকে দেখতে না পেয়ে মাশিয়া বারবার বাবাকে বলত, মারিশা কোথায়? বাবা বলেছিলেন, মারিশাকে আল্লাহ নিয়ে গেছেন। মাশিয়া তখন বলেছিল, ‘আমিও আল্লাহর কাছে যাব। মারিশাকে নিয়ে আসব।’ 

মারিশার মৃত্যুর তৃতীয় দিন একই লক্ষণ নিয়ে মাশিয়াও মারা যায়। মৃত্যুর আগে ও পরে দুই শিশুরই শরীরে ছোপ ছোপ কালো দাগ দেখা দিয়েছিল। এটি কোনো ভাইরাসের সংক্রমণে হতে পারে বলে অনুমান করছেন চিকিৎসকেরা।

দুই শিশুর বাবার নাম মনজুর রহমান (৩৫)। তিনি রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক। তাঁর স্ত্রী পলি খাতুন (৩০) গৃহিণী। তাঁদের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া গ্রামে। তবে তাঁরা রাজশাহীর চারঘাটের সারদায় ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারেই থাকেন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আজ শনিবার বিকেল ৫টার দিকে মারা যায় বড় মেয়ে মাশিয়া। আর গত বুধবার একই লক্ষণ নিয়ে মারা যায় ছোট মেয়ে মারিশা। নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ সন্দেহে দুই শিশুর বাবা–মাকে হাসপাতাল থেকে যেতে দেননি চিকিৎসকেরা। 

তাঁদের রামেক হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। আর বিকেলে স্বজনদের মাধ্যমে মাশিয়ার মরদেহ বাড়িতে পাঠানো হয়। সন্ধ্যার পরে দুর্গাপুর উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে মরদেহ দাফন করা হয়। গত বুধবার রাতে ছোট মেয়ে মারিশাকেও একই স্থানে দাফন করা হয়েছে। 

আজ রাত ৮টার দিকে রামেক হাসপাতালের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি শয্যায় মনজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী পলি খাতুন বসে আছেন শোকস্তব্ধ হয়ে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে পলি খাতুন বললেন, ‘এসব বলে আর কী হবে!’ মনজুর রহমান তখন বলেন, ‘সবার এসব জানা উচিত। সবাই তাহলে সচেতন হবে।’ এরপর পলি খাতুনই শুধু কথা বলে গেলেন। মনজুর রহমান কিছু বলতে পারলেন না। 

পলি খাতুন জানান, গত মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে কোয়ার্টারের কাজের বুয়া (গৃহকর্মী) কলেজ ক্যাম্পাসের গাছ থেকে বরই কুড়িয়ে এনে দুই মেয়েকে খেতে দিয়েছিলেন। না ধুয়েই ওই বরই খেয়েছিল মারিশা আর মাশিয়া। সেদিন তারা ভালোই ছিল। একসঙ্গে খেলেছে। পরদিন বুধবার বেলা ১১টার দিকে ছোট মেয়ে মারিশার জ্বর আসে। বারবার পানি খাচ্ছিল। দুপুরের পর শুরু হয় বমি। তখন মেয়েকে নিয়ে তারা একটি মাইক্রোবাসে করে রাজশাহীর সিএমএইচ হাসপাতালে আসছিলেন। মাইক্রোবাসেও মারিশা বুকের দুধ খেয়েছে। শহরে ঢোকার আগে কাটাখালী এলাকায় মায়ের বুকেই মারা যায় মারিশা। সিএমএইচে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, সে আর নেই! এরপর গ্রামের বাড়ি দুর্গাপুরে নিয়ে মরদেহ দাফন করা হয়। 

শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে দুর্গাপুরের বাড়িতে মাশিয়ারও জ্বর আসে। শুরু হয় বমি। দ্রুতই তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে রাজশাহী সিএমএইচে আনা হয়। রাতে মাশিয়ারও পুরো শরীরে ছোপ ছোট কালো দাগ উঠতে শুরু করে। তা দেখে সিএমএইচের চিকিৎসকেরা মাশিয়াকে রামেক হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। রাত ৯টায় তাকে রামেক হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকেরা তাকে দ্রুতই আইসিইউতে ভর্তি নেন। আজ শনিবার বিকেলে মাশিয়াও মারা যায়। 

পলি খাতুন জানান, ছোট মেয়ে মাশিয়ার পুরো শরীরে ছোপ ছোপ কালো দাগ উঠতে শুরু করে মৃত্যুর পর। আর মারিশার একই রকম কালো দাগ উঠতে শুরু করে মৃত্যুর আগের রাতে। এ রকম দাগ তিনি আগে কখনো দেখেননি। গরম তেল শরীরে পড়লে যেমন ফোসকার দাগ হয়, অনেকটা সেরকম। অসুস্থ হওয়ার পরে দুই বোনই বারবার পানি খাচ্ছিল।

কথা বলতে বলতে পলি খাতুনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছিল পানি। প্রায় বুঁজে আসা গলায় বলতে থাকেন, ‘আমার দুইটা মেয়েই ছিল পরির বাচ্চা। মাথাভর্তি চুল। জন্মের পরই চুলে ক্লিপ দিতে হয়েছিল। ধপধপে ফরসা ছিল তাদের শরীর। সেই শরীর কালো দাগে ভরে গিয়েছিল। ছোট মেয়েটা সারাক্ষণ এসে “মামনি মামনি” করত, আর দুই গালে চুমু খেত। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় বড় মেয়েটা সারা রাত “বাবা বাবা” করেছে। ছোটটা মারা যাওয়ার পরে ভেবেছিলাম বড় মেয়েটাকে নিয়ে বাঁচব। কিন্তু সে–ও চলে গেল!’ 

পলি বলেন, ‘মাশিয়ার মৃত্যুর পর মারিশার বারবার বাবার কাছে যেত আর বলত, ‘‘বাবা, মাশিয়া কই?’’ তার বাবা বলেছিল, ‘‘মাশিয়াকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন।” মারিশা বলেছিল, “আমিও আল্লাহর কাছে যাব, মাশিয়াকে নিয়ে আসব।” সে যে সত্যি সত্যিই চলে যাবে বুঝতে পারিনি! আমি এখন কী করে থাকব! পৃথিবীর কোথায় গেলে তাদের পাব?’ 

শিশু দুটির এমন আকস্মিক মৃত্যুর বিষয়ে রামেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে বাচ্চা দুইটা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। যদিও তাদের বাবা–মা জানিয়েছেন, তারা খেজুর রস খায়নি। তবে না ধুয়ে বরই খেয়েছিল। এটা নিপাহ ভাইরাস হতে পারে, আবার অন্য কোনো ভাইরাসও হতে পারে। সেটা আসলেই কী তা জানতে হাসপাতালে মারা যাওয়া মারিশা আর তার বাবা–মায়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। রোববার রিপোর্ট হবে। তখন জানতে পারব।’ 

এ বছর এ পর্যন্ত রাজশাহীতে কেউ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে ডা. আবু হেনা বলেন, ‘তবে এটা সঠিক যে, বাচ্চা দুইটা কোনো একটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই মারা গেছে। অসুস্থ হওয়ার আগে এটা বোঝা যায়নি। আবার অসুস্থ হওয়ার পরে চিকিৎসার জন্য খুব বেশি সময়ও পাওয়া যায়নি। তাই বাচ্চা দুইটার বাবা–মাকে বাসায় যেতে দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে তাঁদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।’ 

হাসপাতালে থাকা শিশু দুটির বাবা–মা জানিয়েছেন, তাঁরা শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। কিন্তু মানসিকভাবে কেমন আছেন তা বর্ণনা করার মতো নয়! এভাবে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই শিশুসন্তানকে হারানোর অনুভূতি শুধু তাঁরাই বুঝবেন!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ভারত: ব্রিটিশ বিশ্লেষক

পুরোনো রাউটার ফেলে না দিয়ে যে কাজে ব্যবহার করতে পারেন

পোশাকের পর অস্ত্র প্রশিক্ষণও পাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত এডিরা

প্রশাসনিক আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ভুল, আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ সঠিক: বিএনপি

প্রথম ভাষণে গাজা প্রসঙ্গে যা বললেন পোপ লিও চতুর্দশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত