Ajker Patrika

লিচুর রাজধানীতে ফলন বিপর্যয়

  • ঈশ্বরদীতে অর্ধেকের বেশি গাছে মুকুল আসেনি, ঝরে পড়ছে গুটি
  • এবার ফলন ৭০ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে
  • বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ফলন কম—এটা গুজব: ফল বিজ্ঞানী
সাইফুল মাসুম, ঢাকা ও খোন্দকার মাহাবুবুল হক, ঈশ্বরদী
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ২২
লিচুগাছে কাঙ্ক্ষিত মুকুল আসেনি। তবে ফলন্ত লিচুগুলো যাতে ঝরে না পড়ে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাগানমালিকেরা। গত শুক্রবার পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার জয়নগর পশ্চিমপাড়ার একটি লিচুবাগানে। ছবি: আজকের পত্রিকা
লিচুগাছে কাঙ্ক্ষিত মুকুল আসেনি। তবে ফলন্ত লিচুগুলো যাতে ঝরে না পড়ে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাগানমালিকেরা। গত শুক্রবার পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার জয়নগর পশ্চিমপাড়ার একটি লিচুবাগানে। ছবি: আজকের পত্রিকা

বিরূপ আবহাওয়ার কারণে লিচুর রাজধানীখ্যাত পাবনার ঈশ্বরদীতে এবার ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে রসালো লিচুর স্বাদ নেওয়ার সুযোগ এবার কম হতে পারে।

চাষিরা বলছেন, কোনো কোনো এলাকায় অর্ধেকের বেশি গাছে মুকুল আসেনি। আবার অনেক গাছের গুটি ঝরে গেছে। কিছু গাছের লিচু ফেটে গেছে। এ নিয়ে লিচুচাষি, বাগানের মালিক, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভুগছেন দুশ্চিন্তায়।

জানতে চাইলে বারির (ফল বিভাগ) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মসিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অনেক এলাকায় এবার লিচুর ফলন কম হবে। এর প্রধান কারণ আবহাওয়া। সাধারণত শীতের পরে গরম ধীরে ধীরে বাড়ে। এবার হঠাৎ গরম, হঠাৎ শীত—এমন বিরূপ আবহাওয়ার কারণে লিচুর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ঈশ্বরদীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা মোবাইল ফোনের টাওয়ারের কারণে লিচু উৎপাদন কম হচ্ছে—এটা গুজব বলে মন্তব্য করেছেন এই ফল বিজ্ঞানী।

দেশের লিচু উৎপাদনকারী শীর্ষ পাঁচ জেলার একটি পাবনা। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলাকে লিচুর রাজধানী বলা হয়। নানা প্রজাতির লিচুর ফলন হয় এখানে। কিন্তু এবার লিচু উৎপাদনের চিত্র ভিন্ন। ঈশ্বরদীর ছলিমপুর ও সাহাপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি বাগান ঘুরে জানা গেছে, ৭০-৭৫ শতাংশ বাগানে এবার লিচুর মুকুল নেই। ৩০টি গাছের মধ্যে ৫টিতে ফলন্ত লিচুর দেখা মিললেও সংখ্যায় অনেক কম। যেসব গাছে মুকুল ধরেছে, সেগুলোর গুটি ঝরে যাচ্ছে প্রচণ্ড গরমে। ছলিমপুর ইউনিয়নের মিরকামারী গ্রামের লিচুচাষি ইমরান মণ্ডল বলেন, তাঁর বাগানের গাছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ লিচু ধরেছে। তিনি জানান, বাগানের ২৮টি ফলন্ত গাছে এবার ২ হাজার ৮০০ লিচু হবে কি না সন্দেহ। অথচ গত বছর অনেক ভালো ফলন হয়েছিল।

লাভের আশায় উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়ন ও ছলিমপুরে তিন শতাধিক লিচুগাছসহ সাতটি বাগান কিনেছিলেন মানিকনগর গ্রামের লিচু ব্যবসায়ী আবুল বাশার প্রামাণিক। কিন্তু এবার লিচুর কাঙ্ক্ষিত ফলন না হওয়ায় তাঁর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। আবুল বাশার বলেন, ‘এবার লোকসান ঠেকাব কীভাবে, তা বুঝতে পারছি না। বাগানের ৩০-৩৫ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে। এরই মধ্যে আবার খরায় ঝরছে লিচুর গুটি।’ এবার ৪-৫ লাখ টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি।

ঈশ্বরদী উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা মোতমাইন্না জানান, প্রাকৃতিক কারণে এবার গাছে তুলনামূলক কম মুকুল এসেছে। যা এসেছে, গরমের কারণে তা-ও ঝরে পড়ছে। ফলে এবার ফলন প্রায় ৭০ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এবার লিচুর দাম একটু বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ঈশ্বরদীতে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। মুকুল কম আসায় ১৯ হাজার ৪৪৩ টন লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর ঈশ্বরদীতে লিচুর ফলন হয়েছিল ৩০ হাজার ১২০ টন।

পাবনা ছাড়াও লিচু উৎপাদনকারী অন্য শীর্ষ জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে দিনাজপুর, গাজীপুর, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্য অনুসারে, চলতি মৌসুমে দেশের ৩০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। বিগত দুই মৌসুমে প্রতিবছর ২ লাখ ৩০ হাজার টনের বেশি লিচু উৎপাদিত হয়েছে। এবারও একই রকম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও বিরূপ আবহাওয়ায় অনেক জেলায় উৎপাদন অনেক কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কৃষি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে বর্তমানে প্রায় ১২ প্রজাতির লিচুর চাষ করা হয়। এর মধ্যে জনপ্রিয় জাতগুলো হচ্ছে বোম্বাই, বেদানা, চায়না-৩, মঙ্গলবারি, কদমি, কাঁঠালি ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ‘বারি লিচু-১ থেকে বারি লিচু-৬’ প্রজাতির লিচু উদ্ভাবন করেছে।

দেশীয় লিচুর ফলন আসে সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি। আর হাইব্রিড লিচু আসে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে।

মাগুরায়ও ফলন কম

মাগুরা প্রতিনিধি ফয়সাল পারভেজ জানান, গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, মাগুরা সদরের হাজরাপুর ও হাজীপুর ইউনিয়নের বেশ কিছু বাগানে কোনো কোনো গাছের লিচু শুকিয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। গাছের পাতা শুকিয়ে গেছে।

ইছাখাদা গ্রামের লিচুবাগানি ইলিয়াস মোল্লা বলেন, ‘গরমে অধিকাংশ লিচুতে দাগ পড়ে যাচ্ছে। অনেক লিচু অপরিপক্ব অবস্থায় হলদে হয়ে ফেটে গেছে। এ রকম হলে বাজারে নেওয়ার অগে আমাদের পথে বসতে হবে।’

মাগুরা সদর কৃষি অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এই মৌসুমে লিচু একটু কম ধরেছে। তবে প্রচণ্ড গরমে সকালে ও সন্ধ্যার দিকে গাছে পানি দিতে হবে। তাহলে লিচু ঝরে পড়া এবং তাপে ফাটা কমবে।’

মাগুরা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ৫৩১ হেক্টর জমিতে লিচু উৎপাদন করা হচ্ছে। এখান থেকে ৫০০ টন লিচু উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে, যার আনুমানিক মূল্য ৪০ কোটি টাকা।

দিনাজপুরে ফলন ভালো

দিনাজপুর প্রতিনিধি আনিসুল হক জুয়েল জানান, বর্তমানে লিচুবাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। তাঁরা বলছেন, যে পরিমাণ ফলন এসেছে, যদি তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে আর খরার কবলে পড়তে না হয়, তবে লিচুতে এবার ভালো লাভ হবে।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘গত বছর সানবার্নের (তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণ) কারণে কিছু গাছের ফসল নষ্ট হয়েছিল। তবে এবার গাছে গাছে লিচুর গুটিগুলো ভালো ফলনের জানান দিচ্ছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার লিচুর আকার বড়, রসালো ও মিষ্টি হবে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে দিনাজপুরের রসাল লিচু বাজারে আসতে শুরু করবে।’

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে লিচুবাগান রয়েছে ৯ হাজার ৯৮টি। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৪ হাজার ৬২৮ টন। ১৩ উপজেলায় চাষ হলেও সদর ও বিরল উপজেলার লিচু সেরা। সবচেয়ে বেশি আবাদও হয় বিরল উপজেলায়। আড়াই হাজার হেক্টরে। বাগানের সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত