Ajker Patrika

সব হারিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে গুচ্ছগ্রামের ২০৫ পরিবার 

সাহাদত জামান, সারিয়াকান্দি (বগুড়া)
আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৩: ৩৫
সব হারিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে গুচ্ছগ্রামের ২০৫ পরিবার 

একেক পরিবার এসেছে একেক জায়গা থেকে। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সৌহার্দের মেলবন্ধন চোখে পরার মতো। বিভিন্ন গ্রাম ও ইউনিয়ন থেকে আসা ২০৫ টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি নতুন গ্রাম। নাম শাহানবান্দা গুচ্ছগ্রাম।
 
বগুড়া সারিয়াকান্দির শেরপুরের শাহানবান্দার গুচ্ছগ্রামে ২০৫টি পরিবারের বাস। বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে এসে বসতি গড়লেও নিজেদের মধ্যে গড়ে উঠেছে আলাদা সম্পর্ক। ঈদ উৎসব, বিবাহ বার্ষিকী, বনভোজনসহ নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে তাদের মেলবন্ধন চোখে পরার মতো।

গ্রামটির আশপাশে উর্বর জমি থাকায় বাসিন্দারা ধান, পাট, মরিচ, বেগুনসহ নানা ধরনের ফসল ফলাচ্ছেন। গ্রামটির আশপাশে গোচারণভূমি থাকায় প্রতিটি বাড়ি এক একটি ছোট খামারে পরিণত হয়েছে। তারা পালন করছেন গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া কবুতরসহ নানা ধরনের গৃহপালিত পশু। প্রতিটি পরিবারের মাচায় ধরে আছে লাউ, শিম, বরবটিসহ নানা ধরনের সবজি।

গুচ্ছগ্রামের বুলু মিয়ার সহধর্মিণী শিল্পী বেগম (৪৫) বলেন, হামার চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি আছিল শেরপুরে। নদী ভাঙার পর হামরা হাসনাপাড়া মানষের জায়গাত এতদিন আছিলেম। এ জন্যে জোতদাররা অনেকসময় হামাগিরেক অনেক কটু কথা কছে। তারগিরেক অনেক কামকাজ করে দিছি হামরা। একন শেখ হাসিনা হামাগিরেক এডা ঘর করে দিছে। দুই শতক নিজের জায়গা পাছি। শেখ হাসিনাক আল্লাহ যেন ভালই করে।

কথা হয় গুচ্ছগ্রামের শাহজাহান আলী (৫৫) সাথে। তিনি জানান, হামার জীবনে ১২ বার বাড়ি ভাঙার পর শেষ আশ্রয় নিছি এই গুচ্ছগ্রামে। হামি ছোটবেলায় বেড়ে উঠছি চালুয়াবাড়ি ফাজিলপুরে। নদী ভাঙার পর ২০০৫ সালে বাড়ি করলাম চালুয়াবাড়ী গ্রামে, সেখান থেকে ২০০৭ সালে বাড়ি করছিলাম শিমুলতাইড় গ্রামে, তারপর বাড়ি করলেম সাঁঘাটা উপজেলার হলুদিয়া ইউনিয়নের গাড়ামারা চরে ২০১০ সালে, সেখান থেকে একই ইউনিয়নের পাতিলমারী চরে বাড়ি করলেম ২০১৩ সালে, সেখান থেকে ২০১৫ সালে আবার আসলেম চালুয়াবাড়ীর গহলাডাঙায়। এরপর তিনি থেমে যান। 

১৫৮টি ঘর করে দেওয়া হয়েছে, একেক পরিবারকে দেওয়া হয়েছে দুই শতক করে জমিশাহজাহান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলেন, হামার পরিবার নিয়ে নৌকাযোগ বাড়ি ফেরার সময় যমুনার স্রোতে হামাগিরে নৌকা ডুবে যায়। সেই নৌকাডুবিতে হামার বউ আর তিন বছরের কোলের ছেলে মারা যায়। ছেলের লাশ সারিয়াকান্দি থানাত পাছিলেম কিন্তু হামার বউয়ের লাশটাও আজও পালেম না। বলতে বলতে কেদে ওঠেন তিনি। 

২০১৭ সালে তিনি বাড়ি করেছিলেন হাটশেরপুরের করনজাপাড়ায়। তারপর চালুয়াবাড়ীর সুজাতপুর এভাবে ১২ বার বাড়ী ভাঙার পর তিনি সর্বশেষ আশ্রয় নিয়েছেন এই গুচ্ছগ্রামে।

মৃত ফারাজ প্রাং এর ছেলে মালবর (৭০) বলেন, হামাগিরে ভিটেমাটি আছিল শেরপুরের নয়াপাড়ায়। ১৯৭৩ সালে নদী ভাঙার পর আশ্রয় নিছিলেম শেরপুরের বলিদাপালান বেড়িবাঁধে, তারপর নয়াপাড়া, দিঘাপাড়া, কয়েরখালীপাড়া ইংকে করে নয় বার বাড়ি ভাঙার পর আশ্রয় নিছি এই গুচ্ছগ্রামে। কয়েকদিন আগে হামার মেয়ের বিয়ে দিলেম। সারা গুচ্ছগ্রামের সব মানুষই বিয়েত হামাক বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করছে।

হাটশেরপুর ইউনিয়নের অজিবে (৮০), খাদেজা (৬০)সহ  ২০৫টি পরিবার সব হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গুচ্ছগ্রামে। পেয়েছেন পাকাবাড়ি।

গ্রামটির প্রতিটি পরিবারে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সুবিধা। ফলে গ্রামটি ফ্যান, টিভির শব্দ, জারিগানের আওয়াজ, ছোট ছেলেমেয়েদের নানা ধরনের খেলাসহ তাদের হৈ চৈ ধ্বনিতে মুখরিত থাকে সবসময়। মাটি কেটে উঁচু স্থানে নির্মাণ করায় এখানে বন্যার পানি উঠার কোন সম্ভাবনা নেই। এ বছর এর ধারে কাছে বন্যার পানি ওঠেনি।

মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে নির্মিত গ্রামটিতে ১ম পর্যায়ে ৪০টি, ২য় পর্যায়ে ৪৫টি ও পুনর্বাসিত ১২০টি ( টিনসেড) পরিবারের বসতি শাহানবান্দা গুচ্ছগ্রামে। এছাড়া উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ডোমকান্দিতে ৩৩টি, চালুয়াবাড়ী চরে ৪টি, বড়ইকান্দি ৫টি, মাছিরপাড়া ৩টি এবং কাজলার শাহজালাল বাজারে ২৮টি পাকাঘর নির্মাণ করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে নির্মিত সারিয়াকান্দি উপজেলায় ১৫৮টি ঘর নির্মাণ করতে প্রতিটিতে ব্যয় হয়েছে ১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা।

প্রথম ধাপে ১০৭টি, দ্বিতীয় ধাপে ৫১টি।দুই পর্যায়ে সারিয়াকান্দি উপজেলার মোট ১৫৮টি ঘর মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে এবং দুইশতক জমি কবুলত হস্তান্তর করা হয়েছে। 

শাহানবান্দা গুচ্ছগ্রামে সরকারি বরাদ্দের বাইরে প্যালাসাইটিং করা হয়েছে, বেঞ্চ করে দেওয়া হয়েছে, অজুখানা, পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণ ও প্রতিবন্ধীদের ফ্যান ক্রয় করে দেওয়া হয়েছে। তাদের বিনোদনের জন্য করা হয়েছে চড়ুইভাতির আয়োজন।

গুচ্ছগ্রামের চারটি দোকান,একটা মসজিদ ও স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ চলছে।

গ্রামটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে, টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকবার খাদ্য সহায়তা এবং নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। 

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাসেল মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, নদীভাঙনে যেসব মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছেন, যাদের ঘর এবং থাকার জায়গা নেই তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঘর দেয়া হয়েছে। উপজেলার শাহানবান্দা গুচ্ছগ্রাম নতুন হলেও সেখানকার পরিবেশ অত্যন্ত সুন্দর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত