Ajker Patrika

ময়মনসিংহে মামলা-বাণিজ্যে বিএনপি নেতারাও ভুক্তভোগী

  • ৫ আগস্টের পর জেলায় রাজনৈতিক মামলা করা হয়েছে ৩১টি।
  • মামলাকে পুঁজি করে লেনদেন মোটা অঙ্কের টাকা।
  • পুলিশের দাবি, নিরীহদের হয়রানি করা হচ্ছে না।
  • রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়েও আসামি অনেকে।
ইলিয়াস আহমেদ, ময়মনসিংহ  
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ময়মনসিংহে চলছে রমরমা মামলা-বাণিজ্য। এসব মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীসংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি আসামি করা হচ্ছে বিএনপির নেতা-কর্মীদেরও। বাদ পড়ছেন না ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ মানুষও। মামলাকে পুঁজি করে লেনদেন হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে জেলাজুড়ে। তবে পুলিশ বলছে, বিভিন্ন মামলায় নিরীহ ব্যক্তিরা আসামি হয়ে থাকলেও তাঁদের হয়রানি করা হচ্ছে না। অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় বাদ দেওয়া হবে তাঁদের নাম।

ভুক্তভোগী সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১০ সালে ডান হাতের কবজি কেটে নেওয়া হয় লুৎফুর রহমানের (৪২)। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের করা নাশকতা মামলায় বেশ কয়েক মাস জেলও খাটেন তিনি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলায়ও আসামি হয়েছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার ঘোগা ইউনিয়ন পরিষদের টানা তিনবারের সদস্য লুৎফুর।

নাশকতার অভিযোগ এনে গত ৩০ আগস্ট মুক্তাগাছা থানায় সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ ৯২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৪০০ থেকে ১৫০০ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন দাওগাঁও ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম। এ মামলায় ২২ নম্বর আসামি বুলবুল (৪৫), ৮৪ নম্বর আসামি লুৎফুর রহমান (৪৫) এবং ৯০ নম্বর আসামি মুন্নাফ মিয়া কামাল (৪০) বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁরা সবাই উপজেলার ঘোগা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও বিএনপির কর্মী। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তাঁরা মামলা-হামলা, জেল খাটাসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

ভুক্তভোগী লুৎফুর রহমান বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ২০১০ সালে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক দুলাল আমার একটি হাত কেটে ফেলে, অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এখনো বাঁ হাতটি স্বাভাবিক হয়নি। অন্যের সহযোগিতায় চলতে হয়। ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম মনি বাদী হয়ে আমাকে প্রধান আসামি করে নাশকতার মামলায় আসামি করে। গত আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেও আমার নামে নাশকতার মামলা হয়। বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে এখন বাড়িতেই থাকছি।’

আরেক ভুক্তভোগী মুন্নাফ মিয়া কামাল বলেন, ‘ঘোগা ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুজ্জামান লেবুর পক্ষে অবস্থান না নেওয়ায় আমাকে নাশকতার মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে। এটি কখনোই কাম্য হতে পারে না।’

মামলার বাদী দাওগাঁও ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের নির্দেশে এ মামলায় সবাইকে আসামি করা হয়েছে। তবে মামলায় বিএনপির তিনজন থাকার বিষয়ে আমি অবগত নই। এটা তাঁরা বলতে পারবেন।’

এদিকে, গত ১২ নভেম্বর ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলমের করা মামলায় ফেরারি আসামি হয়ে বাড়িছাড়া সদর উপজেলার নিলক্ষীয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ (৫৮)। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বিএনপির হরতাল সফল করার লক্ষ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করায় তৎকালীন কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই আলী আকবর বাদী হয়ে যে মামলা করেছিলেন, সেটির ৫ নম্বর আসামি ছিলেন মজিদ।

ভুক্তভোগী আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনো দলই করিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমাকে বিএনপি বানিয়ে নাশকতার মামলায় আসামি করা হয়েছে। এখন আমাকে আওয়ামী লীগ বানিয়ে বিএনপির অফিস পোড়ানোর মামলায় আসামি করা হলে আত্মগোপনে চলে যাই।’

গত ৪ আগস্ট শম্ভুগঞ্জ বাজারে ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি ও হামলা-ভঙচুর চালিয়ে দোকান লুটের অভিযোগ এনে কোতোয়ালি মডেল থানায় পাঁচ-সাতজনের নামে অভিযোগ দেন ব্যবসায়ী হামিদ মণ্ডল। কিন্তু ১১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জনকে আসামি দেখিয়ে ১ ডিসেম্বর অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে পুলিশ। মামলা হওয়ার পরপরই হামিদ মণ্ডলের একটি অডিও রেকর্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে হামিদকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি মামলা করিনি, কীভাবে মামলা হলো তাও জানি না।’

মোবাইল ফোনে মামলার বাদী হামিদ মণ্ডল বলেন, ‘মামলা আমার অজান্তে হয়েছে; এর জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু কে বা কারা করিয়েছে, তা বলতে পারব না।’

মামলার বিষয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘বাদীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই মামলা করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব, সেখানে যদি কেউ নিরপরাধ হয়ে থাকেন তাহলে অভিযোগপত্র থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হবে।’

জেলার তারাকান্দার নলদীঘি গ্রামে ৫ আগস্ট হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে গত ২৮ সেপ্টেম্বর। এতে আসামি করা হয়েছে একই পরিবারের পাঁচজনকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ ঘটনাস্থল তদন্ত না করেই বাদীপক্ষের কাছ থেকে মোট অঙ্কের টাকা নিয়ে মামলা করেছে।

ময়মনসিংহের তারাকান্দা-ধোবাউড়া সড়কের নলদীঘি গ্রামের ফয়েজ উদ্দিনদের সাড়ে ১০ শতাংশ জমি ২০০৮ সাল থেকে জোরপূর্বক দখল করে রেখেছিলেন তারাকান্দা উপজেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক সুমন বিকাশ সরকারের চাচাতো ভাই নিল্টন চন্দ্র সরকার। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা তাঁর দখলে থাকা জমিটি উদ্ধার করে। এ সময় করা হয় ভাঙচুরও। ঘটনাটি ২৮ সেপ্টেম্বরের দেখিয়ে ফয়েজ উদ্দিনসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৮- ১০ জনকে আসামি করে তারাকান্দা থানায় মামলা করেন নিল্টন।

মামলার আসামি এমদাদুল হক বলেন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আমাদের সাড়ে ১০ শতাংশ জমি দখল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করে আসছিলেন নিল্টন চন্দ্র। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ছাত্র-জনতা আমাদের জমিটুকু উদ্ধার করে দেয়। নতুন ওসি এসেই বিষয়টি তদন্ত না করে বাদীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আমাদের নামে ভুয়া মামলা করে হয়রানি করছেন।’

তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ টিপু সুলতান বলেন, ‘এটি একটি সাধারণ মামলা, এ নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ করার কিছু নেই। বাদী-বিবাদী মামলাটি আপসের পথে হাঁটছে। না হয় আমরা তদন্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দেব।’

ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক মামলায় নিরপরাধ কেউ আসামি হয়ে থাকলেও পুলিশ তাদের হয়রানি করছে না। চার্জশিট (অভিযোগপত্র) থেকে বাদ দেওয়া হবে তাঁদের নামও।

প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্টের পর জেলায় রাজনৈতিক মামলা হয়েছে ৩১টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুই শতাধিক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত