Ajker Patrika

‘ভূতেও এখন পাহাড়ে থাকতে ভয় পায়’  

রাশেদুল ইসলাম রনি, বকশীগঞ্জ (জামালপুর) 
‘ভূতেও এখন পাহাড়ে থাকতে ভয় পায়’  

ভূতেও এখন পাহাড়ে থাকতে ভয় পায়। দিনের বেলাতেই কাউকে পাওয়া যায় না। সবাই এখন শহরে থাকে। কেউ কাজ কাম করে আবার কেউ পড়াশোনা। আগে অনেক লোক ছিল। এখন পাহাড়ের মধ্যে কোনো নিরাপত্তা নেই। দিনের বেলাও কোনো একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেলেও কি হচ্ছে এলাকার মধ্যে তা কেউ বুঝতেই পারবে না। তাই আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। এ ভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলার কামালপুরের পাহাড়ি এলাকা দিঘলাকোনা গ্রামের জয় দাংগো। 

শুধু জয় দাংগো নয়, সেই গ্রামের পাহাড়ি জনপদের আরেক বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী পুদি মারাক জানান, সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষা বাড়িটিতে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ছোট একটি সুখের সংসার ছিল তাঁর। সেই ছোট সংসারটি এখন আরও ছোট হয়ে এসেছে। পাহাড়ে কর্মসংস্থান না থাকায় জীবিকার তাগিদে ঢাকায় কাজ করেন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা। শেষ জীবনে পাহাড়ের মায়া না ছাড়তে পারাই ছোট বাড়িটিতে এখন একাই থাকেন তিনি। বাড়ির কাজ ও বাগানের পরিচর্যা করেই জীবনের শেষদিনগুলো পার করছেন তিনি। 

পুদি মারাক বলেন, ‘আগে আমগরে কত সুখের সংসার ছিল। এখন আমি একাই থাকি। আমার ছেলেমেয়েরা সব বাইরে থাকে। কাজ কাম করে। বছরে দুই একবার আহে। আবার যায়গা। আমি এখন একা মানুষ। কোথায় যামু? পাহাড়ে মায়া ছাড়তে পারতাছিনা। তাই আমার শেষ জীবনটা এখানেই কাটামু।’ 

বকশিগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, কামালপুর ইউনিয়নে প্রায় দেড় হাজার ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বসবাস থাকলেও সেখানে এখন বাস করছেন মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ জন। 

সীমান্ত ঘেঁষা এই পাহাড়ি জনপদে শত বছরের অধিক সময় ধরে হাজারো গারো জনগোষ্ঠীর বাস। পাহাড়ে জুমচাষ, ফল, ফুল ও ফসল উৎপাদন করে বিক্রি এবং কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করত এই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর পরিবারগুলো। তবে পাহাড়ে জুমচাষ বন্ধসহ নানা কারণে বনভূমি ব্যবহারে নিষেধ থাকায় কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে এসব অঞ্চলে। ফলে জীবিকার তাগিদে পাহাড় ছেড়ে এখন শহরমুখী হচ্ছে আদিবাসী পরিবারের কর্মক্ষম প্রায় প্রতিটি সদস্য। 

স্থানীয়দের দাবি, অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী শহরমুখী হওয়ায় এখন ধ্বংসের মুখে বনভূমি। বিলুপ্তির পথে তাঁদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এ ছাড়াও এই অঞ্চলে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। 

পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে পাহাড়ে বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিকদের বাড়িপাহাড়ি এলাকা সাতানিপাড়ার বাসিন্দা নপু মারাক নপ্তরীও বলেন, ‘আগে আমাদের কৃষ্টি কালচার যা ছিল তা এখন লালন করতে পারি না। কেন না আমাদের জুমচাষ নেই। পাহাড়ে কাজ নেই। কেউ থাকে না। আগে কিছুদিন পরপর আমাদের এখানে নাচাগানা হতো। এখন বছরে একদিনও কেউ মিল হতে পারি না। এ সমস্ত কারণে আমাদের কৃষ্টি কালচারও সমস্তই বিলুপ্তির পথে।’ 

ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়িতে বেড়াতে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজেশ খোকশি বলেন, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীরা পাহাড়ে না থাকার কারণে বিশেষ করে পাহাড় ধ্বংস হচ্ছে। পাহাড় ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীও ক্ষতি হচ্ছে। আদিবাসীদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি কালচার সবগুলোই বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। 

ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নেতাদের দাবি সরকারের পক্ষ থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ গ্রামমুখী উন্নয়ন ও বনভূমি ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হলেই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীরা আবারও ফিরে আসবে পাহাড়ে। বিলুপ্তি হওয়ার পথ থেকে রক্ষা পাবে তাঁদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। 

ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পিটিশন সাংমা বলেন, এখানে কোনো কর্মসংস্থান নাই। আগে বনে আমরা জুম চাষসহ বিভিন্ন ফসল করতে পারতাম। নানা বিধিনিষেধের কারণে এখন আমরা সেখান থেকে বঞ্চিত। তাই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রতিটি ঘর থেকে লোকজন জীবিকা নির্বাহের জন্য শহরমুখী হচ্ছেন। সরকার যদি আমাদের জন্য বন ব্যবহারের অনুমতি দেয় তাহলে আমরা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী চিরস্থায়ীভাবে আবার আগের মতো বসবাস করতে পারব। 

দিঘলাকোনা এলাকার সাধু আন্দ্রে ধর্মপল্লির পুরোহিত ফাদার ডোমিনিক সরকার সিএসসি বলেন, এখানে শিক্ষার সেই ধরনের কোনো সুযোগ নেই। আবার উন্নত জীবনেরও সুযোগ নেই। কোনো চাকরির সেই ধরনের সম্ভাবনাও এখানে নেই। তাই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জনগণেরা শহরে চলে যাচ্ছেন। 

গ্রামে লোকজন তেমন না থাকায় জনশূন্য পুরো রাস্তাফাদার ডোমিনিক সরকার সিএসসি আরও বলেন, পাহাড়িদের যদি আবার তাঁদের নিজস্বতায় ফিরিয়ে আনতে হয় তাহলে সেখানে প্রয়োজন হবে কর্মসংস্থানের। যদি সরকার চিন্তা করেন গ্রামমুখী উন্নয়ন করার তাহলেই সম্ভব। তাহলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এগিয়ে যাবে। 

এ বিষয়ে বকশিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুন মুন জাহান লিজা বলেন, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর যারা বকশিগঞ্জে আছেন। তাঁদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য উপজেলা প্রশাসন এরই মধ্যে একটি কালচারাল একাডেমিসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি দিয়েছেন। এতে করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জনগণেরা তাঁদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারবে। 

নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জনগণের পাশে উপজেলা প্রশাসন সব সময় আছে। তাঁরা যেন আমাদের সঙ্গে মূল ধারায় চলতে পারে। এ ছাড়া দিন দিন পাহাড়ে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী সংখ্যা কমে যাওয়াটা কিছুটা চিন্তাজনক। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করবে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত