Ajker Patrika

যশোরে কৃষি উন্নয়নে স্থাপনা নির্মাণ: ৪১ কোটির তিন প্রকল্প জলে

  • পানিসারায় তিন বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্র।
  • কাজে আসছে না গদখালী বাজারের পাশে নির্মিত ফুল বিপণনকেন্দ্র।
  • চাঁচড়ায় মাছের পোনা বিক্রয়কেন্দ্র পড়ে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে।
জাহিদ হাসান, যশোর
আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ৪৬
চাঁচড়ায় মাছের পোনা বিক্রয়কেন্দ্র পড়ে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে। ছবি: আজকের পত্রিকা
চাঁচড়ায় মাছের পোনা বিক্রয়কেন্দ্র পড়ে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে। ছবি: আজকের পত্রিকা

সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন ভবন। ভবনের গায়ে বড় করে লেখা রয়েছে ‘বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্র’। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল বীজ বিপণন ও সংরক্ষণের জন্য হিমাগার। ভবনের সামনে রয়েছে ফুল মোড়কজাত (প্যাকেজিং) ও বিক্রির জন্য পাকা মেঝে এবং টিনের ছোট ছোট ছাউনি (শেড)। তবে যে কারণে এত সুযোগ-সুবিধার আয়োজন, সেই ফুল বেচাকেনা, বীজ সংরক্ষণই হয় না এখানে। অথচ মার্কেটটির সামনের সড়ক দিয়ে প্রতিদিন মাঠ থেকে ফুল নিয়ে শত শত কৃষক বিক্রি করতে যান সাড়ে ৩ কিলোমিটার দূরে।

ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারা এলাকায় বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এই এলাকায় উৎপাদিত ফুল, বীজ বিপণন ও সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে সাড়ে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে হিমাগারসহ আধুনিক ফুল মার্কেট নির্মাণ করে সরকার। ১ একর জমিতে এই বিপণনকেন্দ্র নির্মাণের পর ২০২২ সালে উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু মার্কেট নিয়ে ফুলচাষিদের কোনো আগ্রহ না থাকায় তিন বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, যে ভবন ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের পদচারণে মুখর থাকার কথা, সেই ভবনের সামনে ফুলের পরিবর্তে ধান শুকাচ্ছে এলাকাবাসী। পড়ে রয়েছে ফুল বেচাকেনার শেড।

ফুলচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশির দশক থেকেই গদখালী ও পানিসারা—এই দুই ইউনিয়নে বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদিত হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ফুলের রাজধানী হিসেবে এই এলাকা পরিচিতি লাভ করে। কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ফুল দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাজারে বিক্রি করে আসছেন। তাঁদের এই ফুল সংরক্ষণ ও বিপণনের জন্য উন্নত সুযোগ-সুবিধা ছিল না।

কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ফুল বিপণন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। মার্কেট নির্মাণের পর জমির মালিকানা নিয়ে আইনি জটিলতা ও আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা না থাকায় জেলা প্রশাসনের মার্কেটটি বুঝে নিতে এবং উদ্বোধন করতে দেরি হয়।

বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্র ব্যবহার না করার কারণ হিসেবে চাষিরা জানান, কেন্দ্রটি নির্মাণে স্থান নির্বাচনে ভুল করা হয়েছে। এটি নির্মাণ করা হয় পানিসারা ইউনিয়নে। গদখালী বাজার থেকে এর দূরত্ব সাড়ে ৩ কিলোমিটার। আবার গদখালী বাজারের পাশে মহাসড়ক থাকায় সহজেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ফুল বাজারজাত করা যায়। এ ছাড়া গদখালীতেই বেশি ফুলের চাষ হয়। ফলে চাষিরা অনেক দূরের ওই বিপণনকেন্দ্রে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কেন্দ্রটি গদখালীতে নির্মাণ করা হলে কৃষকেরা উপকৃত হতেন।

নূর নবী নামের এক ফুলচাষি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মার্কেটটি নির্মাণ করা হয়েছে। গদখালী থেকে এটি অনেক দূরে। ফলে গদখালীর ফুলচাষিরা ওখানে যেতে চান না। বাজার থেকে সহজে বিভিন্ন পরিবহনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ফুল পাঠানো যায়। তাই দীর্ঘদিন ধরে ফুল মার্কেট পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া ফুলে বীজ সংরক্ষণ করতে না পারায় স্থানীয় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁদের এখন চড়া মূল্যে যশোর ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার আলুর হিমাগারে ফুলের বীজ সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। তা-ও আবার অনেক সময় হিমাগারে জায়গা পাওয়া যায় না।

একই অবস্থা গদখালী বাজারের পাশে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফুল বিপণনকেন্দ্র (অ্যাসেম্বল সেন্টার)। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় সেখানে যান না চাষিরা। বছরের পর বছর পড়ে রয়েছে বিপণনকেন্দ্রটি।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারায় অব্যবহৃত বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্র। সামনে ধান শুকান স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবি: আজকের পত্রিকা
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারায় অব্যবহৃত বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্র। সামনে ধান শুকান স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবি: আজকের পত্রিকা

যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পানিসারায় অবস্থিত বাংলাদেশ-আমেরিকা সৌহার্দ্য ফুল বিপণনকেন্দ্রটির জমির মালিকানা নিয়ে প্রথমে ঝামেলা ছিল, পরে তা সমাধান হয়। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ী গদখালী বাজারটি তাঁদের আয়ত্তে রেখে মোটা অঙ্কের বাণিজ্যের জন্য ওই মার্কেট চালু করতে দিচ্ছেন না। আমরা প্রশাসনের কাছে মার্কেটটি দ্রুত চালুর দাবি জানাই।’

এদিকে যশোর শহরের চাঁচড়া এলাকায় ৮০ শতক জমির ওপর ১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক মাছের পোনা বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। দোতলা এ বিক্রয়কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মৎস্য বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, পোনা বিক্রয়কেন্দ্রটির নিচতলার ১১ হাজার বর্গফুট জায়গায় কার্পজাতীয় মাছের পোনা বিক্রির জন্য ৩২০ বর্গফুটের ৫১টি সিস্টার্ন (হাউস) নির্মাণ করা হয়। সিস্টার্নে পানি শাওয়ারিং ও অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। আর দেশি প্রজাতির ছোট মাছের পোনা বিক্রির জন্য দোতলায় ৭ হাজার ৯০০ বর্গফুট জায়গা রয়েছে। সেখানে ৭০ জন ব্যবসায়ী বড় হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে পোনা বিক্রি করতে পারবেন। মাছের গাড়ি সরাসরি দোতলায় নেওয়ার জন্য র‍্যাম্প পদ্ধতির সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য স্বয়ংক্রিয় জেনারেটরও স্থাপন করা আছে। কিন্তু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত পোনা বিক্রেতারা এ কেন্দ্রে জায়গা বরাদ্দ নিতে আগ্রহ দেখাননি।

গদখালী বাজারের পাশে নির্মিত ফুল বিপণনকেন্দ্র। ছবি: আজকের পত্রিকা
গদখালী বাজারের পাশে নির্মিত ফুল বিপণনকেন্দ্র। ছবি: আজকের পত্রিকা

কারণ হিসেবে মাছচাষিরা জানান, চাঁচড়া বাবলাতলায় সড়কের ওপর পাতিলে মাছের পোনা রেখে বিক্রি করতে কোনো খরচ নেই। কিন্তু পোনা বিক্রয়কেন্দ্রে জায়গা বরাদ্দ নিতে অফেরতযোগ্য ২৫ হাজার টাকা জামানাত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে আরও ১ হাজার টাকা খরচ হবে। তাই তাঁরা ওই কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হননি।

যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, হ্যাচারিদের মতামত উপেক্ষা করে মার্কেটটি নির্মাণ করা হয়েছে। চাঁচড়া বাবলাতলায় নির্মাণ করার দাবি জানালেও সরকারের তৎকালীন মৎস্য কর্মকর্তা চাঁচড়ায় নির্মাণ করেন। সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা নেই, পানির সমস্যা। তাই হ্যাচারিমালিকেরা দেড় কিলোমিটার দূরে চাঁচড়ায় যেতে আগ্রহ দেখান না।

সরকারের তিনটি প্রকল্প অব্যবহৃত পড়ে থাকার বিষয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্ট ফুল ও মাছচাষিদের মতামতের ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত