Ajker Patrika

‘চড়ুইভাতি’র বিনিময়ে আগাম ভুট্টা রোপণ করছে ফুলবাড়ীর খুদে কৃষকের দল

মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
শিবনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ বাসুদেবপুর ও দাদপুর এলাকায় প্রস্তুতকৃত জমিতে খুদে কৃষকেরা ভুট্টা রোপণ করছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিবনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ বাসুদেবপুর ও দাদপুর এলাকায় প্রস্তুতকৃত জমিতে খুদে কৃষকেরা ভুট্টা রোপণ করছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

দিনাজপুরের শস্যভান্ডার খ্যাত ফুলবাড়ীতে শুরু হয়েছে আগাম জাতের ভুট্টা রোপণ, তবে শ্রমিক-সংকটে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন চাষিরা। একদল উদ্যমী খুদে কৃষক চড়ুইভাতির বিনিময়ে ভুট্টা রোপণে এগিয়ে আসায় দূর হয়েছে শ্রমিক-সংকট।

নদীর তীর, ধঞ্চে ও পাট কাটার পর প্রস্তুত করা জমিতে এখন চলছে ভুট্টা রোপণের কাজ। ভুট্টা চাষ সাধারণত সারা বছর করা গেলেও ভালো দাম পেতে অনেক কৃষক অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আগাম জাতের ভুট্টা রোপণ করেন। কিন্তু এই আগাম রোপণে শ্রমিক-সংকট, বীজ ও সারের ঊর্ধ্বগতি এবং বৈরী আবহাওয়া—নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছিল চাষিদের।

ভুট্টা রোপণের কাজ সাধারণত সকাল ও বিকেল—নির্দিষ্ট এই দুই সময়ে করতে হয়। শুধু অল্প সময়ের কাজের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক পাওয়া কঠিন, আবার তাঁদের মজুরিও অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরদের কয়েকটি দল।

জানা যায়, ১০-১৫ জনের এই খুদে কৃষকের দল স্কুল ছুটির দিন বা স্কুলে যাওয়ার আগে-পরে ভুট্টা রোপণ করে দিচ্ছে। এতে একদিকে কৃষকের শ্রমিক-সংকট দূর হচ্ছে, অন্যদিকে শিশু-কিশোরেরা কৃষিকাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। এই কাজের বিনিময়ে পুরো দলকে চড়ুইভাতির মাধ্যমে পিকনিক খাওয়ানো হয় এবং তাদের স্কুলের টিফিনের জন্য কিছু বাড়তি টাকাও দেওয়া হয়।

শুক্রবার বিকেলে উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ বাসুদেবপুর ও দাদপুর এলাকায় দেখা যায়, প্রস্তুতকৃত জমিতে সারি সারি হয়ে একদল খুদে কৃষক ভুট্টা রোপণ করছে। তাদের দলে রয়েছে একজন সরদার। সরদার মূলত কার জমিতে ভুট্টা রোপণ করবে তা ঠিক করে। কোনো জমিতে ভুট্টা রোপণ করতে হলে আগে সরদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। পাটের সুতলিতে ১৫ ইঞ্চি পরপর লাল রং করে বীজ রোপণের দূরত্ব ঠিক করা হয়েছে। দেড় হাত পরপর সুতলি ধরে ভুট্টার লাইনের দূরত্ব ঠিক করছে সরদার। অন্য সদস্যরা পাশাপাশি সারবদ্ধ হয়ে সুতলিতে দেওয়া লাল দাগের নিচে বীজ রোপণ করছে। এভাবে এক বিঘা জমি মাত্র এক ঘণ্টায় রোপণ করছে। শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এবং বেলা ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভুট্টা রোপণ করে তারা। এই সময়ে ৪-৫ বিঘা জমি রোপণ করতে পারে। অন্যান্য দিন সকালে দুই ঘণ্টা ও বিকেলে দুই ঘণ্টা ভুট্টা রোপণ করে তারা।

খুদে কৃষক সিয়াম, আকাশ, মাহিম, রিফাতের ভাষ্য, ‘আমরা লেখাপড়ার পাশাপাশি ভুট্টা রোপণ করি। জমির মালিক আমাদেরকে সকালে হোটেলে খিচুড়ি খাওয়ান। এ ছাড়াও ৫০-১০০ টাকা করে দেন। যা দিয়ে আমাদের স্কুলের টিফিনের টাকা হয়ে যায়। ভুট্টা রোপণ শেষ হলে বড়সড় চড়ুইভাতির আয়োজন করেন। আমাদের মূল আকর্ষণ ওই চড়ুইভাতি। অল্প সময়ের কাজ বলে মা-বাবা কিছু বলে না। কোনো কাজই ছোট নয়, আমাদেরও অভিজ্ঞতা হলো।’

কথা হয় ভুট্টাচাষি মামুনুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছোট যমুনা নদীর তীরে প্রতিবছর ১৪ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করি। আগাম ভুট্টা ভালো দামে বিক্রি হয়। কিন্তু এ সময় শ্রমিক-সংকট থাকায় প্রতিবেশী খুদে কৃষকেরা ভুট্টা রোপণে সাহায্য করে। এতে শ্রমিক-সংকট দূর হয়, ভুট্টা রোপণে খরচ কমে। সবাই মিলেমিশে চড়ুইভাতি করি। চড়ুইভাতিতে অনেক ছেলেমেয়ের মা-বাবাও অংশগ্রহণ করে, এতে অনেক আনন্দ হয়। পাশাপাশি বাড়তি অল্প কিছু টাকা পায়, তা দিয়ে তাদের স্কুলের টিফিন খরচ হয়ে যায়।’

দাদপুর এলাকার শামিম হোসেন বলেন, ‘বর্তমান সময়ে শ্রমিক পাওয়া অনেক কঠিন। তাই স্কুল ছুটির দিনে প্রতিবেশী ভাই-ভাতিজাদের দিয়ে ১ বিঘা জমির ভুট্টা লাগিয়েছি। এতে তারা ছোট থেকে কৃষিকাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা পেল। তাদেরকে পিকনিকের খরচ করে দিয়েছি। ওরা ওদের মতো করে চড়ুইভাতি করে আনন্দ করেছে।’

অভিভাবকেরা বলেন, ‘বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রায় ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেট আর মোবাইলে আসক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন ভুলে যাচ্ছে। এর কুফলে আনেকের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ছে। তার চেয়ে ছুটির দিনে অবসর সময়ে যে সময় খেলাধুলা করে, সে সময় কৃষিকাজে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া সকলে মিলে একসঙ্গে চড়ুইভাতি করে আনন্দ-উল্লাস করছে। এতে কৃষিকাজের বাস্তব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ফুলবাড়ী উপজেলায় এবার ৪ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভুট্টা মূলত সারা বছরই চাষ করা যায়। তবে উপযুক্ত সময় হচ্ছে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত। ভুট্টা রোপণের যান্ত্রিকীকরণ এখনো সহজলভ্য না হওয়ায় শ্রমিক-সংকট থাকতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...