Ajker Patrika

দাবদাহ ও রোজার কারণে ঘিওরে পয়লা বৈশাখের মেলা ঈদের পরে

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর, মানিকগঞ্জ
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ২২: ৩১
Thumbnail image

আজ পয়লা বৈশাখ, বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। নববর্ষকে বরণ করতে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার মানুষজনের আগ্রহের কমতি নেই। উপজেলা প্রশাসন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষে সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হয়েছে। তবে বৈশাখী মেলাসহ বিনোদনের আয়োজন নেই বললেই চলে। 

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে বছর চারেক আগেও কমপক্ষে ১৫ স্থানে বসত বৈশাখী মেলা। হাজারো মানুষের পদচারণে মুখরিত থাকত এলাকা। বিনোদনের জন্য থাকত নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, যাত্রাপালা, গানের আসর, ষাঁড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, পুতুল নাচ ইত্যাদি। তবে দিন দিন এসব সুখস্মৃতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। 

উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘিওর, বড়টিয়া, পয়লা, বানিয়াজুরী, সিংজুরী, বালিয়াখোড়া ও নালী ইউনিয়নে তাঁত, মিষ্টি, হস্ত ও মৃৎশিল্পের পরিবার রয়েছে চার হাজারের ওপরে। বিগত দুই বছর করোনার কারণে ছিল মেলা বন্ধ। এ বছর অনেক আশায় বুক বেঁধেছিলেন তাঁরা। কিন্তু এ বছরও মেলার আয়োজন নেই। 

বৈশাখী মেলার প্রস্তুতিতে পণ্য তৈরির কাজ করছেন কারিগরেরাকারণ হিসেবে অনেকেই জানান, রমজান মাসের কারণে মূলত আয়োজনে ভাটা। এ বছর পয়লা বৈশাখের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ পান্তা-ইলিশ ও বৈশাখী মেলা হচ্ছে না। তবে ঈদুল ফিতরের পরদিন থেকে উপজেলার রাধাকান্তপুর, সিংজুরী, বাঙ্গালা, নারচী, বেড়াডাঙ্গা, বড় কুষ্টিয়া (২ বৈশাখ), পুরান বাজারসহ বেশ কয়েকটি স্থানে মেলা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন এলাকাবাসী। 

এদিকে কর্মমুখর ঘিওর পালপাড়ায় চৈত্র থেকেই শুরু হয় বৈশাখী মেলার প্রস্তুতি। প্রবীণ মৃৎশিল্পী সুখেন পাল ও গৃহবধূ শিল্পী পাল বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকেই মেলার জন্য মাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও তৈজসপত্র তৈরি করেছি। এসবের মধ্য রয়েছে পুতুল, ব্যাংক, আম, কাঁঠাল, হরিণ, ঘোড়া, হাতি, মাছ, ময়ূর, সিংহসহ হরেক রকম শিশু খেলনা। ঘর গৃহস্থালির হাঁড়ি, পাতিল, ঢাকনা, ঝাঁজর, কলসসহ নানান তৈজসপত্র। ঘর সাজানোর জন্য ফুলদানি, টবসহ নানা তৈজসপত্র। বৈশাখী মেলা আমাদের আয়ের বড় একটি উৎস। কিন্তু মেলা হচ্ছে না। ঈদের পর কয়েকটি মেলা আছে, সেখানে বিক্রির আশা করছি।’ 

বৈশাখী মেলার প্রস্তুতিতে পণ্য তৈরির কাজ করছেন কারিগরেরাপুখুরিয়ার তাঁতশ্রমিক আজমত মল্লিক বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ, ঈদ, পূজায় আমাদের আয় রোজগার বেড়ে যায়। কিন্তু উপকরণের দাম বেশি, তারপর নেই মেলা, অনুষ্ঠান। সামনে ঈদ। পরিবার নিয়ে আমরা হতাশ।’ 

সরেজমিন বড়টিয়া ইউনিয়নের ঋষিপাড়া গ্রামে দেখা গেছে, বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে বউ–ঝিরা গাছের ছায়ায় বসে বেত দিয়ে তৈরি করছেন সুদৃশ্য তৈজস সামগ্রী। সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তৈরি করছে নানা রকমের জিনিসপত্র। 

আলাপকালে নিরঞ্জন দাস ও ক্ষিতীশ দাস বলেন, ‘বৈশাখী মেলায় প্রতিটি পরিবার গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতাম। গত দুই বছর করোনার কারণে বন্ধ ছিল। অত্যধিক গরম আর রোজার কারণে বৈশাখী মেলা পয়লা বৈশাখে না হলেও কয়েক দিন পরে (ঈদের পর) হবে। তখন বিক্রি করব, তাই পণ্য তৈরি করে রাখছি।’ 

রাধাকান্তপুরে দীর্ঘদিন ধরে বৈশাখী মেলার আয়োজক ও রাধাকান্তপুর ফাইভ স্টার ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রঞ্জু খান বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসের কারণে এবার পয়লা বৈশাখের মেলা হচ্ছে না। তবে ঈদের পরদিন থেকে তিন দিনব্যাপী জমজমাট বৈশাখী মেলা হবে।’ 

সিংজুরী বৈশাখী মেলা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পোস্টমাস্টার আব্দুল খালেক বলেন, ‘অর্ধশত বছর ধরে সিংজুরী বৈশাখী মেলা চলে আসছে। পয়লা বৈশাখ থেকে মেলা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রমজান মাসের জন্যই মেলার সময়সূচি পরিবর্তন করে ঈদের পরদিন থেকে দুই দিনব্যাপী মেলা হবে।’ 

ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলার পুরোনো ছবিউপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের বাষ্টিয়া নবজাগরণ ক্লাব ৩০ বছর ধরে আয়োজন করছে বৈশাখী মেলা। কিন্তু এ বছর পয়লা বৈশাখে মেলা বসেনি। এর কারণ হিসেবে ক্লাবের সভাপতি মো. নূরে আলম সিদ্দিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চলছে পবিত্র রমজান মাস। তার ওপর প্রচণ্ড তাপদাহ। এই মুহূর্তে মেলার আয়োজন করা হলে মানুষজন মেলায় খুব কম উপস্থিত হতো। রমজানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মেলার সময়সূচি পরিবর্তন করে ঈদের পরে মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।’ 

উপজেলা সদরের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া কলেজ শিক্ষার্থী আফসানা রুবা বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ মানেই সবাই মিলে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার আর মেলার আয়োজন। কিন্তু পবিত্র রোজার কারণে দুটোর কোনোটিই এবার হচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমের কারণে বান্ধবীদের নিয়ে ঘোরার সাহসও পাচ্ছি না।’ 

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘বৈশাখ মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। বর্ষবরণের পাশাপাশি উৎসবকে পরিপূর্ণতা দেয় বৈশাখী মেলা। বৈশাখী মেলা শুধু গ্রামেই নয়, শহরে মানুষকে বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।’ 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতির জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। আমাদের কৃষ্টি, সাহিত্য ও সভ্যতার একটি অংশ পয়লা বৈশাখ। বর্ণাঢ্য বৈশাখী শোভাযাত্রা করা হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত