Ajker Patrika

লোডশেডিংয়ে আয় হারাচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
লোডশেডিংয়ে আয় হারাচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা

পুরান ঢাকার ইংলিশ রোড থেকে ডানে মোড় নিলে সটান সদরঘাট পর্যন্ত চলে যাওয়া সড়কটির নাম জনসন রোড। জনসন রোডের লিয়াকত আলী অ্যাভিনউয়ের দুপাশে সার বেঁধে আছে প্রায় অর্ধশতাধিক ফটোকপির দোকান। এই এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নোটসহ নানা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ফটোকপির জন্য এখানে দিনের বেলা বরাবরই শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু ইদানীং চিত্রটি পাল্টে গেছে। কারণ, লোডশেডিং। 

লিয়াকত আলী অ্যাভিনিউয়ে আজ সোমবার গিয়ে ফটোকপির দোকান ও এগুলোর কর্মীদের বেশ আয়েশ করে দাবা, লুডু ইত্যাদি খেলতে দেখা গেল। কোনো তাড়া নেই। নেই চেনা ভিড়ভাট্টা। বিদ্যুৎ নেই, ফলে ফটোকপি করার উপায় বা তাড়া কিছুই নেই। 

আশপাশে থাকা বিভিন্ন দোকানের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিদ্যুৎ চলে গেছে ১১টা ৩০ মিনিটে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লোডশেডিং শিডিউল মোতাবেক ১২টা ৩০ নাগাদ বিদ্যুৎ চলে আসার কথা। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ১২টা ৪৫ মিনিট অতিক্রমের পরও বিদ্যুৎ আসার খবর নেই। ফলে সেখানকার ফটোকপির দোকানগুলো কার্যত অচল। 

এ অবস্থায় দোকানগুলোর কর্মচারীদের কেউ দোকানে বসে দাবা খেলছেন, কেউ আবার মোবাইলে লুডু খেলে অবসর সময় পার করছেন। তাঁরা জানান, প্রতিদিন একাধিকবার বিদ্যুৎ চলে যায়। অনেক সময় ফটোকপি মেশিনে কপির কাজ চলার সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এতে কপি আটকে থাকে। ফলে গ্রাহকেরা বিরক্ত হয়ে চলে যান। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সার্বিক আয়ের ওপর। 

হামীম কম্পিউটারের এক কর্মচারী বলেন, ‘বিদ্যুতের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায়, লোডশেডিংয়ের সময় দোকানের সকল কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের কাস্টমার সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। তারা এই সময়টাতেই বেশি আসে। এখন বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে।’ 

একই রকম বিপাকে পড়েছেন লন্ড্রি ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে কথা হয় কলতাবাজার এলাকার কুঞ্জবাবু লেনের লন্ড্রি ব্যবসায়ী হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত বাধ্য হয়ে হজম করতে হচ্ছে আমাদের। আগে রাত সাড়ে ১০টা-১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখা হতো। এখন সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাত ৮টা থেকে দোকান বন্ধ রাখতে হয়। অনেকে সারা দিন কাজে ব্যস্ত থাকায়, রাতে কাপড় ইস্ত্রি করতে আসেন। কিন্তু দোকান বন্ধ থাকায় তাঁরা বিরক্ত হয়ে ফিরে যান।’ 

দিনের বেলা পাটুয়াটুলীর চশমার দোকানগুলোয় তেমন ভিড় দেখা যায় নালক্ষ্মীবাজার এলাকার নবদ্বীপ বসাক লেনের আরেক লন্ড্রি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শামিম বলেন, ‘একেকদিন একেক সময়ে কারেন্ট চলে যায়। নির্দিষ্ট একটা টাইমে কারেন্ট গেলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো। আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারতাম এবং কাস্টমারদের বোঝাতে পারতাম। কাস্টমাররা সন্ধ্যার পর এসে চাপ দিতে থাকে। ফলে আমাদের অসুবিধা হয়। রাত ৮টার পর পুলিশ টহল দেয়। ফলে দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হই।’ 

লোডশেডিংয়ের সময়সূচি নিজেদের সুবিধামতো উপায়ে আগে থেকে জানতে পারছেন না বলেও অভিযোগ করেন এই ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘মাইকে কারেন্ট যাওয়ার সময়টা জানিয়ে দিলে সুবিধা হতো। আমদের কাছে ভালো মোবাইল না থাকায় সরকারি নোটিশ জানতে পারি না। হুট করে বিদ্যুৎ চলে যায়। আগে থেকে জানলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারতাম। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। আর আমাদের খরচ বাড়ছে, কিন্তু ইনকাম বাড়ছে না।’ 

শুধু ফটোকপি বা লন্ড্রি ব্যবসায়ীরাই নন, লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ রাখায় এবং দিনে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং থাকায় আয় কমছে বলে অভিযোগ তাদের। সঙ্গে ক্রেতা ও গ্রাহকদের নানা বিরূপ মন্তব্যও শুনতে হচ্ছে তাদের। 

সাধারণত বিকেলের পর থেকেই চশমার দোকানগুলোয় ক্রেতারা আসতে থাকেনবিশেষত বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই বা এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সামর্থ্য নেই এমন ব্যবসায়ীরা পড়েছেন সবচেয়ে বিপাকে। ব্যবসা পরিচালনায় বিদ্যুৎ প্রয়োজন হলেও সময়মতো তা না পাওয়ায় লোকসানের শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করছেন তাঁরা। এ তালিকায় আছেন রাজধানীর চশমার পাইকারি বাজার পাটুয়াটুলীর চশমা ব্যবসায়ীরা। 

পাটুয়াটুলী বাজারের চশমা ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, ‘সারা দিনের অসহ্য গরমের মধ্যে কেউ দোকানে আসতে চায় না। আবার রাত ৮টার পর দোকান বন্ধ করতে হয়। অথচ আমাদের ক্রেতারা রাতেই বেশি আসে। এ কারণে এখন বিক্রি কম হয়।’ 

চশমা ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় এর গ্লাস ফিটিং নিয়ে। চশমা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান বলেন, ‘চশমার গ্লাস ফিটিং মেশিন কারেন্ট ছাড়া চলে না। জরুরি সময় বিদ্যুৎ না থাকলে লোকজনকে বসিয়ে রাখতে হয়। ফলে সময়মতো কাজ করতে না পারায়, ক্রেতারা বিরক্ত হয়ে চলে যান।’ 

চশমার দোকানে ফিটিং মেশিনে কাজ করতে বিদ্যুৎ অপরিহার্যপাটুয়াটুলীর চশমা ব্যবসায়ীরা লোডশেডিং এবং সরকারি নির্দেশনায় সবচেয়ে বড় যে সংকটে পড়েছেন, তা হলো চিকিৎসাসেবা। অধিকাংশ দোকানেই সন্ধ্যার পর চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসেন। এ জন্য ক্রেতাদের একটি বড় অংশই সন্ধ্যার পর এসব দোকানে আসেন। একসঙ্গে চোখ দেখিয়ে চশমা অর্ডার করেন তাঁরা। কিন্তু ৮টার পর দোকান বন্ধ হওয়ায় এই চিকিৎসাসেবা প্রায় বন্ধ। ফলে ক্রেতাদের চাপও কমে গেছে বলে বড় আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এই ব্যবসায়ীদের। 

এখানে শুধু পুরান ঢাকার কথা চিত্র উঠে এলেও রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর লোডশেডিংয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ছোট পরিসরে ব্যবসা পরিচালনা করা এসব ব্যবসায়ীর পক্ষে বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আয়োজন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা। অনেকের ব্যবসা দাঁড়িয়েই আছে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ওপর। ফলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট তাঁদের আয়ে বড় প্রভাব ফেলছে, যা তাদের জীবনকেই বিভ্রাটে ফেলে দিচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত