Ajker Patrika

শিক্ষা কার্যক্রম: চার ইস্যুতে অস্থির শিক্ষাঙ্গন

  • বাড়িভাড়াসহ তিন দাবিতে আন্দোলনে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা
  • ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে জটিলতা বাড়ছে
  • প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকেরা অনশন কর্মসূচি দিয়ে স্থগিত করেছেন
  • বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষোভ বাড়ছে শিক্ষা ক্যাডারে
রাহুল শর্মা, ঢাকা 
শহীদ মিনারের সামনে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থান কর্মসূচি। ছবি: আজকের পত্রিকা
শহীদ মিনারের সামনে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থান কর্মসূচি। ছবি: আজকের পত্রিকা

হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত আলাদা ইস্যু ঘিরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক জটিলতাও। শঙ্কা দেখা দিচ্ছে সেশনজটসহ নানা সংকটের।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, গত বছরের জুলাই-আগস্টে হওয়া আন্দোলনের অভিঘাত থেকে এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম।

সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মজিবর রহমান বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যেকোনো দাবি পূরণে সরকার আন্তরিক। এসব বিষয়ে পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

আন্দোলনে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা

বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধিসহ তিন দফা দাবি আদায়ে গতকাল শুক্রবার দুপুর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। একই সঙ্গে তাঁদের ডাকা ‘অব্যাহত কর্মবিরতির’ কর্মসূচিও চলছে। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে শ্রেণি কার্যক্রম।

এ ছাড়া আজ শনিবার সকালে শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকেরা।

এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা তাঁদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতা, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের চিকিৎসা ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা করা এবং এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের উৎসব ভাতা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ করার দাবি তুলেছেন।

বর্তমানে দেশে ২৬ হাজার ১০৪টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী।

এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের ব্যানারে ১২ অক্টোবর থেকে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরারের (সি আর আবরার) সঙ্গে বৈঠক করে শিক্ষকনেতাদের একটি প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, বাড়িভাড়া ৫ শতাংশের বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। শিক্ষকেরা রাজি হলে ১ নভেম্বর থেকে ৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধি বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে শিক্ষা উপদেষ্টার এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকনেতারা।

সাত কলেজ নিয়ে জটিলতা বাড়ছে

রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ করা নিয়ে জটিলতা দিন দিন বাড়ছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তর না থাকার শঙ্কা এবং প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে ঢাকা কলেজের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা সাবেক শিক্ষার্থীদের।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদ্যমান খসড়া অনুযায়ী প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে ঐতিহ্য হারাবে সাত কলেজ। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলেজের তুলনায় আসনসংখ্যা অর্ধেক কমে যাবে, যা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পথ সংকুচিত করবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা এখন মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত। ১৩ অক্টোবর শিক্ষা ভবন এলাকায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছেন তাঁরা।

শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাদেশ দ্রুত জারির দাবিতে শিক্ষা ভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। আরেক অংশ দাবি করছে, পদযাত্রার নামে ‘মব’ সৃষ্টি করে সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এ ছাড়া উচ্চমাধ্যমিক স্তর রাখার দাবিতে ১২ অক্টোবর সায়েন্স ল্যাব মোড় দখল করে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা।

একই সঙ্গে প্রস্তাবিত কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছেন সাত কলেজে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকেরা। তাঁরা কলেজের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কলেজের নামে অক্ষুণ্ন রাখা, কলেজগুলোর কার্যক্রম, পাঠদান ও অবকাঠামোর গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পৃথক স্থানে করাসহ ১১ দফা দাবি জানিয়েছেন।

সাত কলেজের সংকট নিয়ে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সাত কলেজ নিয়ে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হবে। তবে কিছুটা ভুল-বোঝাবুঝি ও ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। সেগুলো নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপ গুজব ছড়াচ্ছে, যেটা মোটেই কল্যাণকর নয়।’

ঢাকার সরকারি সাত কলেজ একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। এই কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত জানুয়ারিতে কলেজগুলোকে অধিভুক্তি থেকে সরানো হয় এবং নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

শিক্ষা ক্যাডারে ক্ষোভ

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর বিভাজনের উদ্যোগ, সাত কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ, দীর্ঘদিন পদোন্নতি আটকে থাকায় ক্ষুব্ধ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। তাঁদের অভিযোগ, মাউশি বিভাজন হলে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও শিক্ষা প্রশাসনে পদায়নের সুযোগ সীমিত হবে। আর সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে ঢাকায় তাঁদের পদায়নের সুযোগ কমবে এবং বিপুলসংখ্যক পদ বিলুপ্ত হবে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নতুন পদ সৃষ্টি না হওয়া, পদোন্নতি আটকে থাকা এবং তৃতীয় গ্রেড না পাওয়ার কারণেও হতাশ তাঁরা।

১২ অক্টোবর মাউশি ভেঙে দুটি অধিদপ্তর করার সিদ্ধান্ত জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর একটি মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, অন্যটি কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর। এ দুটি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথক অর্গানোগ্রাম, কার্যতালিকাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কর্মকর্তার সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় দুটি ক্যাডারের একটি হলো শিক্ষা। এই ক্যাডারে মোট ১৯ হাজার ৮৬৮টি পদের বিপরীতে কর্মরত সাড়ে ১৭ হাজারের বেশি কর্মকর্তা। তাঁদের অধিকাংশ সরকারি কলেজের শিক্ষক। কিছু সদস্য মাউশিসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত।

জানতে চাইলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল গতকাল বলেন, অংশীজনদের মতামত নিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান না হলে তা টেকসই হবে না। এতে সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আশ্বাসে স্থগিত প্রাথমিকের আন্দোলন

সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে একাদশ গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, চাকরির ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার জটিলতা নিরসন এবং প্রধান শিক্ষকের শতভাগ পদে সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতিসহ দ্রুত পদোন্নতি চান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা।

দাবি আদায়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আশ্বাসে তা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিক্ষকনেতারা সচিবালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এবং মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর এ ঘোষণা দেন।

তবে আশ্বাস বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হলে আবারও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি মো. আনিসুর রহমান। গতকাল তিনি বলেন, ‘প্রেসক্লাবে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ কারণে আমরণ কর্মসূচি আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে আমাদের দেওয়া আশ্বাস বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হলে আবারও নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত