Ajker Patrika

ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে থানায় পুলিশ, এখনই মিলবে না সব সেবা

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০০: ৪৩
ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে থানায় পুলিশ, এখনই মিলবে না সব সেবা

পলাশ সরকার। পেশায় শিক্ষক। পুলিশের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ নিয়ে সোমবার (১২ আগস্ট) দুপুরে মোহাম্মদপুর থানায় আসেন। তবে ডিউটি অফিসার তাঁর অভিযোগটি রাখেননি। তাঁকে আদালতে মামলা করতে পরামর্শ দেন। ডিউটি অফিসার ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে বলেন, ‘আমরা কেবল জরুরি অভিযোগগুলো রাখছি। যেমন, হত্যা, চুরি ও ডাকাতি। এ ছাড়া কোনো সেবা এখন দেওয়া সম্ভব না।’ ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলে আইনি সহায়তা না পেয়ে হতাশ হয়ে বের হয়ে যান পলাশ সরকার। 

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। ওই দিন বিকেলেই দেশের থানাগুলোতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। গণবিক্ষোভের মুখে থানা রেখে নিরাপদে চলে যায় পুলিশ। আগুন ও ভাঙচুরে দেশের ৪৫০ থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আটটি অপরাধ বিভাগের ৫০ থানার মধ্যে অক্ষত ছিল মাত্র সাতটি থানা। বাকিগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আগুনে পুড়ে যায় তদন্তাধীন মামলার ও অন্যান্য নথি এবং অবকাঠামো। লুট হয় জরুরি সরঞ্জাম। মোহাম্মদপুর থানা এর মধ্যে অন্যতম। 

সোমবার দুপুরে সরেজমিনে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রধান ফটকের সামনে ছয়জন সেনা সদস্যের পাহারা। তাঁদের অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে থানা কম্পাউন্ডে পুড়ে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া পুলিশের চারটি ভ্যান, নয়টি মোটরসাইকেল পড়ে আছে। থানার ভবনে ঢুকতেই কালো ছাই আর পোড়া কাগজ, স্যাঁতসেঁতে মেঝে। নিচতলায় ওসির কক্ষে একজন ডিউটি অফিসার টেবিল পেতে সিভিল পোশাকে বসে আছেন। চারজন যুবক তাঁর টেবিল ঘিরে দাঁড়ানো। কক্ষের ভেতরে টেবিল চেয়ার, হাজিরা খাতা, রেজিস্ট্রার খাতা সবই নতুন। যুবকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন তিনি। এই যুবকদের একটি মোটরসাইকেল সংক্রান্ত সমস্যার কথা শুনছিলেন তিনি। তাঁদের সঙ্গে কথা শেষ করে, এক নারীর হারিয়ে যাওয়া মোবাইলের বিষয়ে জিডির পরামর্শ দেন ডিউটি অফিসার। এই ফাঁকে জানা যায়, ডিউটি অফিসারের নাম উপপরিদর্শক (এসআই) মধুসূদন মজুমদার। 

ভাঙচুর অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত থানা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করছেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা। ছবি: আজকের পত্রিকাতিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কেবল আজ জরুরি বিষয়ের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নিচ্ছি। আজকে সকাল থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ১৩টি জিডি হয়েছে।’ 

মোহাম্মদপুর থানায় অগ্নিসংযোগ করায়, এই থানার কোনো কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ডিউটি অফিসারের কক্ষ থেকে বের হয়ে পাশের কক্ষে দেখা যায়, এক দল শিক্ষার্থী দেয়ালে চুনকাম করছেন। তাঁরাই তিন দিন ধরে থানাটি সাফছুতরোর কাজ করে দিচ্ছেন। এখন আরেকটি কক্ষ ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা করছেন। এভাবে তাঁরা পুরো থানা পরিষ্কার করে দেবেন বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম নাঈম। তিনি বলেন, ‘আমরা থানাটাকে ব্যবহার উপযোগী করে দিতে কাজ করছি। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছে। এখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছে।’ 

তেজগাঁও বিভাগের আদাবর থানাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক বলেন, তাঁর বিভাগের ছয়টি থানাই চালু করা হয়েছে। 

এদিকে রমনা বিভাগের সবগুলো থানায় কাজ শুরু করেছে পুলিশ। এই বিভাগের নিউমার্কেট, রমনা ও শাহবাগে হামলা হয়েছিল। তবে থানা ব্যবহার উপযোগী রয়েছে। কলাবাগান থানায় গিয়ে দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর পাহারায় দোতলায় ডিউটি অফিসার বসে সেবাপ্রার্থীদের সেবা দিচ্ছেন। সীমা নামে এক তরুণী মেইলে হুমকি পাওয়ার অভিযোগ নিয়ে জিডি করতে এসেছেন। তাঁকে পরামর্শ দেন ডিউটি অফিসার এসআই আব্দুল্লাহ আল সাদিক। 

এসআই বলেন, ‘আমাদের সব সেবা চালু আছে। থানার সবাই উপস্থিতও আছে। বর্তমানে কেবল জিডি নেওয়া হচ্ছে। তবে টহল কার্যক্রম শুরু করতে আরও সময় লাগবে। গাড়ি ও ওয়ারলেস সেট চালু হলে টহল চালু হবে।’ 

অপরদিকে, ওয়ারী বিভাগের যাত্রাবাড়ী থানা সম্পূর্ণ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কংক্রিটের কাঠামো থাকলেও সেখানে অবশিষ্ট কিছু নেই। সোমবার কয়েকজন পুলিশ সিভিলে সেখানে যান। তবে কার্যক্রম শুরু হয়নি। সেবা বন্ধ। দুদিন ধরে শিক্ষার্থীরা সেবাপ্রার্থীদের বিভিন্ন লিখিত অভিযোগ রাখলেও তা আনুষ্ঠানিক কিছু না। সাদা পোশাকে শ্যামপুর, ওয়ারী, ডেমরা ও কদমতলী থানার পুলিশ থানায় আসে। 

কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি গুলশান বিভাগের ভাটারা থানা। এই থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। এই থানার কর্মকর্তাদের গুলশান থানায় ও উপকমিশনারের কার্যালয়ে হাজিরার জন্য বলা হয়েছে। বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রাজান সাহা বলেন, ভাটারায় কাজ শুরু করার জন্য থানা প্রস্তুত করা হচ্ছে। 

আপাতত জরুরি জিডি ছাড়া কোনো অভিযোগ নিচ্ছে না পুলিশ। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা। ছবি: আজকের পত্রিকাএই বিভাগের বাড্ডা থানায় লুটপাট করেছিল দুর্বৃত্তরা। সোমবার সরেজমিনে থানায় গিয়ে দেখা গেছে, থানার প্রধান ফটক ভাঙা। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। বাইরে থেকে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে একটি নতুন কম্পিউটার, টেবিল চেয়ার নিয়ে বসেছেন এসআই শাকিল আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জিডি নেওয়া হচ্ছে, তবে সার্ভার না থাকায় ইনপুট দেওয়া যাচ্ছে না।’ শাহীনা নামে এক নারী তাঁর ভাই নিখোঁজের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দিলে, ডিউটি অফিসার সেটি রেখে তাঁকে পরে হালনাগাদ জানানো হবে বলে আশ্বস্ত করেন। 

ডিএমপি জানিয়েছে, থানাগুলোতে ইন্টারনেট সেবা, ওয়্যারলেস, গাড়ির ব্যবস্থা করা, অস্ত্রের ব্যবস্থাপনার পর টহল কার্যক্রম, পরোয়ানা তামিল, মামলার তদন্ত শুরু হবে। এতে আরও দু–একদিন সময় লাগবে। 

এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সারা দেশের সর্বমোট ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৬২৮টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে দেশের ১১টি থানা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস, আসবাবপত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় এসব থানার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত