Ajker Patrika

‘ল্যাম্বরগিনি আকাশের’ গাড়ি তৈরির স্বপ্ন আশ্বাসেই আটকে আছে

সাবিত আল হাসান, নারায়ণগঞ্জ
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, ১২: ৫১
‘ল্যাম্বরগিনি আকাশের’ গাড়ি তৈরির স্বপ্ন আশ্বাসেই আটকে আছে

ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ি বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের তরুণ আকাশ। দেশ–বিদেশ থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েও শেষতক ব্যাটে-বলে মেলেনি। মাঝে করোনার চোখরাঙানি তো ছিলই! দেশের মন্ত্রীর কাছ থেকেও আকাশকে ‘কাজে লাগানো’র আশ্বাস মিলেছিল। সেটিও আর বাস্তবে রূপ পায়নি। তবু হাল ছাড়েননি আকাশ। এখনো তাঁর স্বপ্নের ঠাসবুনন মস্তিষ্কের গলিপথে ঘুরপাক খাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই, দেশেই তৈরি করবেন গাড়ি।

চৈত্রের কোনো এক দিনে ফতুল্লার লামাপাড়া মোড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দোকানের কথা জিজ্ঞেস করতেই এক তরুণ বলে উঠল—‘কোন আকাশ? ল্যাম্বরগিনি বানাইসিল ওই আকাশ?’ হ্যাঁ সূচক উত্তর পেতেই দেখিয়ে দেয় ইজিবাইক মেরামতের ওয়ার্কশপটি। ভেতরে কাজ করছিলেন আকাশের বাবা নবী হোসেন। প্রতিবেদককে একনজর দেখেই হাসিমুখে চিনে ফেললেন তিনি। এই ওয়ার্কশপে বসেই তাঁর ছেলে ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ি তৈরি করে সাড়া ফেলেছিলেন দেশ–বিদেশে।

২০১৯ সালের জুন মাসে ইতালির ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ি তৈরি করে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন আকাশ আহমেদ (২৫)। কোনো পুরোনো গাড়ি মডিফিকেশন বা আমদানি করে নয়। কেবল ইউটিউবের সহযোগিতায় নিজের হাতেই পুরোপুরি গাড়ি নির্মাণ করেন নবম শ্রেণি পাস তরুণ আকাশ। গাড়ির চেসিস থেকে শুরু করে বডি, সাসপেনশন, গ্লাস, লাইট, গিয়ার সবকিছুই ছিল আকাশের নিজের হাতে তৈরি।

আকাশ বলেন, বাবার ইজিবাইকের ওয়ার্কশপে কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই দীর্ঘ দেড় বছরের প্রচেষ্টায় গাড়ি নির্মাণে সক্ষম হন। ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করেন পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক মোটর। দেশীয় প্রযুক্তির সহায়তায় ল্যাম্বরগিনির আদলে ই-কার তৈরি করে আলোচনায় চলে আসেন তিনি। এক নামে পরিচিতি পায় ‘ল্যাম্বরগিনি আকাশ’।

গাড়ি নিয়ে আলোচনায় আসার পর ইউরোপ, কানাডা ও ভারতের বেশ কয়েকটি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করে আকাশের সঙ্গে। করোনার আগে ভারতের একটি জনপ্রিয় গাড়ি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হওয়ার আগমুহূর্তে করোনা এসে বাগড়া দেয়। লকডাউন শুরু হওয়ার পর থমকে যায় সেই প্রক্রিয়া। করোনার প্রকোপ শেষ হলে ভারতের সেই প্রতিষ্ঠান আর যোগাযোগ করেনি।

ল্যাম্বরগিনির আদলে তৈরি আকাশের গাড়ি২০১৯ সালে ডিজিটাল ডিভাইস ও ইনোভেশন এক্সপো প্রদর্শনীতে স্থান পায় আকাশের গাড়িটি। সে সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তাঁর গাড়িটি দেখে প্রশংসা করেন এবং তাঁকে নিয়ে কাজ করার আশ্বাস দেন। এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও মন্ত্রীর পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেননি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ বললেন, সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো মাধ্যমেই আসেনি সহায়তা কিংবা উদ্যোগ। ফলে কিছুটা হতাশ হয়ে আবারও নিজের পুরোনো ইজিবাইকের ওয়ার্কশপেই মনযোগ দিয়েছিলেন একসময়।

গাড়ি নির্মাণ-পরবর্তী অবস্থা নিয়ে আজকের পত্রিকার প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আকাশের। আলাপচারিতায় জানান, দীর্ঘ বিরতিতেও বসে ছিলেন না তিনি। নিজের চলাফেরার জন্য ইতিমধ্যে তৈরি করেছেন ১৫০ সিসির একটি মোটরসাইকেল। সম্পূর্ণ ডিজাইন ও নির্মাণ করেছেন নিজেই। কেবল ইঞ্জিন নিয়ে এসেছেন দেশের বাইরে থেকে। গাড়ির পর মোটরসাইকেলটি নিজ এলাকায় বেশ আলোচনা তৈরি করলেও আকাশ চান গাড়ি নিয়েই কাজ করতে। মোটরসাইকেল নিয়ে ততটা আগ্রহ জন্মেনি তাঁর।

আকাশ বলেন, ‘মাত্র দেড় মাস আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হয়। সেখানে ই-কার তৈরি ও ডিজাইনের কাজ নিয়ে আলাপ হয়। প্রতিষ্ঠানটির ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে দেশীয় ই-কার বাজারজাত করবে। তবে পুরো বিষয়টিই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর আগ পর্যন্ত আমি আমার বাবার ওয়ার্কশপেই কাজ করছি।’

নতুন কোনো গাড়ির কাজ করছেন কি না—এমন প্রশ্নে বলেন, ‘ল্যাম্বরগিনি গাড়িটা এখন গ্যারেজে ফেলে রেখেছি। নতুন করে ক্যাম্পাগানা টি রেক্স গাড়ির আদলে তিন চাকার একটি গাড়ির কাজ চলছে। এর পেছনেও প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি কিছুদিন পরই সেটা উদ্বোধন করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম প্রায় ৪০ লাখ টাকার মতো। আর দেশের মার্কেটে মোটামুটি ৭ লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি করা যাবে। দেশের রাস্তায় ব্যাটারিচালিত গাড়ি ততটা গতিশীল নয়, সে জন্য এবারের গাড়ি জ্বালানি তেলে চালনার পরিকল্পনা রয়েছে আমার।’

আকাশের তৈরি মোটরসাইকেলগাড়ি তৈরির পর অনেক আশ্বাস পেলেও তার বাস্তবায়ন পাননি এমন আক্ষেপ নিয়ে আকাশ বলেন, ‘আমি সবচেয়ে বেশি পেয়েছি মানুষের প্রতিশ্রুতি। এর বাস্তবায়ন পাইনি বললেই চলে। অথচ শুরুর দিকে ২৫টি ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ি তৈরির অফার এলেও সেগুলো বাতিল করেছি। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, আমাকে নিয়ে তারা কাজ করবে। কিন্তু পরে আমাকে আর ডাকা হয়নি। বর্তমানে দেশ যেই পরিমাণ এগিয়েছে, তাতে দেশে ইঞ্জিন তৈরিসহ গাড়ি নির্মাণ করা কোনো বিষয়ই না। যদি সরকারি উদ্যোগ বা বেসরকারি অর্থায়ন পাওয়া যায়, তাহলে বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি নির্মাণ করা যাবে। মানুষ ৫ থেকে ৬ লাখ টাকায় ভালো গাড়ি পাবে। আমি উদ্যোগ এককভাবে নিতে পারছি না কেবল আর্থিক জোগান নেই বলে।’

বিদেশি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে অফার পেয়ে কেন যাওয়া হয়নি এমন প্রশ্নে আকাশ বলেন, ‘ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রথমে কথা চললেও লকডাউনের পরে আর তারা যোগাযোগ করেনি। আর ইউরোপ-কানাডায় বাবা যেতে নিষেধ করেছেন। তাই দেশেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার ইচ্ছা সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে যুক্ত হয়ে দেশেই গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যেখানে আমার মতো অনেক গাড়ি নির্মাতা কাজের সুযোগ পাবেন এবং তাঁরা তাদের প্রতিভা ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।’ 

গাড়ি বানিয়ে আলোচনায় আসা আকাশের বাবা নবী হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছেলের কারণে সবাই প্রশংসা করে এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। শুরুর দিকে তো অনেক কাজের অফার আসছিল, এখন আর অত আগ্রহ দেখি না কোম্পানির মানুষের কাছে। আকাশ চায় অনেক কিছু করতে, সরকার ওর কাজ দেইখা যদি মনে করে ভালো কাজ করছে, তাহলে যেন ওরে ঠিকমতো কাজে লাগায়। এর বেশি কিছু চাই না আমরা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত