Ajker Patrika

ভুয়া চিকিৎসা সনদে পেশাদার লাইসেন্স

  • কম্পিউটারের দোকানে তৈরি হয় ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট।
  • বিআরটিএ নির্ধারিত ৮ হাসপাতালে হয় মেডিকেল পরীক্ষা।
  • ৭ হাসপাতাল থেকে সার্টিফিকেট ই-মেইলে আসে না বিআরটিএতে।
  • দুর্ঘটনায় জড়িত মাদকাসক্ত চালকের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী।
তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা 
ভুয়া চিকিৎসা সনদে পেশাদার লাইসেন্স

পেশাদার মোটরযান চালকদের নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরিতে ও নবায়ন করাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট (চিকিৎসা সনদ) বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেকে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁরা লাইসেন্সও পেয়ে যাচ্ছেন সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা এগুলোর (ব্যাপারে) ব্যবস্থা নেব।’

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালার আলোকে নির্ধারিত ফরমে পেশাদার চালকের বিভিন্ন বিষয় দেখা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত ফরম এবং মেডিকেল সার্টিফিকেট ভুয়া বানানো হচ্ছে। সাধারণত বিআরটিএর সার্কেল অফিসের আশপাশে যেসব কম্পিউটার কম্পোজের দোকান রয়েছে, সেগুলোয় এ ধরনের ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরি করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ডাক্তারের নাম দিয়ে ফটোশপে এডিট করে মেডিকেল সার্টিফিকেট বানানো হচ্ছে।

৮ হাসপাতালে হয় মেডিকেল পরীক্ষা

পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেডিকেল পরীক্ষায় জন্য বিআরটিএ ৮টি হাসপাতাল নির্ধারণ করে দিয়েছে। তার মধ্যে আছে—কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (সাবেক পিজি), জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, রাজারবাগ।

এসব হাসপাতালের ডাক্তারের থেকে আনা সার্টিফিকেট মেডিকেল সার্টিফিকেট হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে শুধু জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান মেডিকেল সার্টিফিকেটের কপি অনলাইনে জিমেইলের মাধ্যমে বিআরটিএকে পাঠায়। এই বিষয়ে বিআরটিএ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, মেডিকেল সার্টিফিকেট বিআরটিএকে অফিশিয়ালি মেইলে পাঠানোর জন্য।

বিআরটিএর বিভিন্ন সার্কেলের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘মেডিকেল সার্টিফিকেটটি ভুয়া কি না, সেটা প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ নেই আমাদের কাছে। তবে চোখের দেখায় বোঝা যায় যে সেটা ভুয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে আমরা সেগুলো ভেরিফাই করেছি। আমরা এই ধরনের ভুয়া সার্টিফিকেট বাতিলও করতে পারছি না। কারণ, সার্টিফিকেটে ডাক্তার ও হাসপাতালের সিল সবই আছে; সে ক্ষেত্রে অফিশিয়ালি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। হাজার হাজার লাইসেন্স ম্যানুয়ালি ক্রস চেক করার সুযোগ কম; কারণ, একটি মাত্র হাসপাতাল সার্টিফিকেট আমাদের কাছে মেইলে পাঠায়, বাকি হাসপাতালগুলো পাঠায় না।’

সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুরসহ বিভিন্ন বিআরটিএ অফিসের পাশে গড়ে ওঠা কম্পিউটার কম্পোজের দোকানগুলোয় দেদার বানানো হচ্ছে মেডিকেল সার্টিফিকেট। টাকার বিনিময়ে হাসপাতাল, ডাক্তারের সিলসহ সই জাল করে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেডিকেল সার্টিফিকেট। এই কাজ বেশি করছেন একশ্রেণির দালাল; যাঁরা ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়ার চুক্তি করছেন গ্রাহকদের সঙ্গে।

মিরপুরে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে এসেছিলেন মো. আলিফ। তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘লাইসেন্সের কাজে অনেক ভেজাল (জটিল)। অনেকগুলো কাগজপত্র লাগে। এর মধ্যে মেডিকেল সার্টিফিকেট করানো একটা জটিলতা। হাসপাতালে ঘুরতে ঘরতে দিন শেষ। আমাদের এত সময় নেই। দোকানে মেডিকেল সার্টিফিকেট বানিয়ে দেয়, সেটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছি।’ জাল মেডিকেল সার্টিফিকেটের কারণে যদি আবেদন বাতিল হয় তখন কী হবে-এ প্রশ্নে আলিফ বলেন, ‘জানি না আবেদনটি বাতিল হবে কিনা। তবে আমার পরিচিত অনেক চালক এইভাবে লাইসেন্স নিয়েছেন।’

জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি আসার পরে এই ধরনের অভিযোগ পেয়েছি, ব্যবস্থাও নিয়েছি। আমাদের এডি (সহকারী পরিচালক) প্যানেলে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রত্যেককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারণ, এসব অ্যাটাচমেন্ট অনলাইনে আসে, সেখানে অনেক সময় ভুল দেয়। তাই অ্যাটাচমেন্টগুলো যাচাই করে সত্যতা পেলে তারপরে অনুমোদন দেন। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরাসরি রিপোর্টটা আমাদের সার্ভারে আপলোড করে দিলে ভালো হতো।’

মেডিকেল পরীক্ষায় চালকের যেসব বিষয় দেখা হয়

সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালায় পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেডিকেল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে চালকের যে বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হয়, সেগুলো হলো—প্রার্থীর বয়স, দৃষ্টিশক্তির কোনো ত্রুটি আছে কি না, প্রার্থী সহজে লাল ও সবুজ রং চিহ্নিত করতে পারেন কি না, প্রার্থীর রাতকানা এবং বধিরতা রোগ আছে কি না, মোটর যান চালনায় অক্ষম এ রকম অঙ্গহানি প্রার্থী আছে কি না, মদ বা ড্রাগে আসক্তির কোনো লক্ষণ আছে কি না। এ ছাড়া প্রার্থীর শনাক্তকরণ চিহ্ন আছে কি না, তা-ও দেখা হয়ে থাকে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে অদক্ষ, মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি যদি ড্রাইভিং লাইসেন্স পান এবং তিনি যদি সড়কে থাকেন, তাহলে সড়ক যতই মাখনের মতো করা হোক, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দুর্ঘটনার অন্যতম ফ্যাক্টর (কারণ) হলো হিউম্যান এরর (মানুষের ভুল)। শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং মাদকাসক্ত চালক যদি সড়কে থাকেন, অন্য চালক দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দুর্ঘটনায় জড়িত মাদকাসক্ত চালক ছিলেন ১২-১৪ শতাংশ। এই সংখ্যা ২০২০-২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ থেকে ২৪ শতাংশ। বর্তমান সময়ে এই সংখ্যা আরও ঊর্ধ্বমুখী বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এটি বাড়ার কারণ হচ্ছে, চালকদের জীবনমানের এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি। সড়ক পরিবহন আইনে যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তার কোনোটি বাস্তবায়িত হয়নি।

সমাধান মিলতে পারে প্রযুক্তিতে

বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, বিআরটিএর সার্ভারে বিএমডিসির রেজিস্টার্ড ডাক্তারদের যুক্ত করতে হবে। ডাক্তাররা যে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেবেন, সেটা বিআরটিএ সিস্টেমে চলে আসবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এতে ভুয়া সার্টিফিকেট ভেরিফাই করা সহজ হবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টেকনোলজি অনেক এগিয়ে গেছে, কিউআর কোডসংবলিত মেডিকেল সার্টিফিকেট করা উচিত। তাহলে যে কেউ কিউআর কোড স্ক্যান করে বুঝতে পারবেন, সার্টিফিকেটটা আসল নাকি নকল।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত