Ajker Patrika

যখন উদ্বাস্তু গাছ-পাখিদের সংসার

ফজলুল কবির, ঢাকা
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩: ৪৮
Thumbnail image

উদ্বাস্তু নদীর এই নগরে পাখিদের থাকতে মানা। উচ্ছেদে উচ্ছেদে সেই কবেই তো লন্ডভন্ড হয়েছে গাছেদের সংসার। এই তো কয়েক দিন আগে শিক্ষার্থীশূন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও একটু জেগে উঠল এক গাছ হত্যার খবরে। প্রশাসন বলছে পোকায় খেয়েছে, তাই কেটে ফেলা হবে। সেই কাজও শুরু করে তারা। পরে প্রতিবাদের মুখে রাশ টানা হয় এই হত্যাযজ্ঞে। 

এ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প নয়। এমনকি শুধু ঢাকার গল্পও নয়। এ গোটা দেশের গল্প। রাস্তা যাবে, গাছ কাটো। ভবন হবে, গাছ কাটো। হাসপাতাল হবে, গাছ কাটো। যেকোনো উন্নয়ন বা অন্য কোনো কাজে যেন প্রথম বাধাটি দিচ্ছে গাছই। ফলে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী যশোর রোডের দুপাশের শতবর্ষী গাছ কাটতেও আমাদের হাত একবারও কাঁপেনি। অথচ এই আমরাই কী অনায়াসে চা খেতে খেতে পাখিদের নিয়ে হাহাকার করি! যদিও তার আবাস মুছে দিতে সব সময়ই উদ্ধত থাকে আমাদের ইরেজার। গাছেদের এই উদ্বাস্তু হওয়ার গল্পই উঠে এল শিল্পী মিল্টন মোমেনের করা ইনস্টলেশনে। 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় চলছে ২৪তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী। বরাবরের মতোই চিত্রশালার দ্বিতীয় তলার গ্যালারি-১-এর বাইরে একটি ইনস্টলেশন অভিবাদন জানাল। ভেতরে হাতছানি দিয়ে তখন ডাকছে আরও শত কাজ। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটু ধন্ধে পড়ে যেতে হলো। মনে হলো কেমন অগোছালো। গেটে থাকা একজনের সঙ্গে কথা বলে খুঁজে খুঁজে দেখা গেল পুরো গ্যালারিতে একটি মাত্র ভিডিও-আর্ট। এই প্রদর্শনীর আওতাধীন আর কোনো শিল্পকর্ম গ্যালারিটিতে নেই। এবিষয়ক কোনো নোটিশও সেখানে নেই। ঠিক বোঝা গেল না, এই দুটিমাত্র কাজকে কেন এমন বিচ্ছিন্ন করা হলো? 

তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা মিলল বহু কাজের। বেশ কিছুতে এই সময়ের বাস্তবতা করোনা বাস্তব হয়ে আছে। দেখা মিলল সাগরপাড়ের জেলেজীবনের বয়ান নিয়ে এক সাম্পানের। দেয়ালে আঁকা এই সাম্পানের প্রতিটি খাঁজে উঁকি মারছে সাগরপাড়ের জীবনের নানা ছবি। কিছু শিল্পকর্ম যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনি কিছু আবার প্রশ্ন জাগিয়েছে মনে—এখানে কেন? আবার কিছু শিল্পকর্মকে এমন অবহেলায় ঠাঁই দেওয়া হয়েছে যে, মনে হয় যেন করুণা করা হয়েছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, যদি এই কাজগুলো এভাবেই জায়গা করে দেওয়া হবে, তবে নির্বাচন না করলেই তো হতো। সে ক্ষেত্রে আরও জায়গা নিয়ে প্রদর্শন করতে পারতেন শিল্পীরা। এমন ঠাসাঠাসি ভাবটা অন্তত থাকত না। প্রতিবারই জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গেলে এই ঠাসাঠাসি বিষয়টিই সবার আগে মাথায় আসে। মনে হয়, নিশ্চয় কোনো একটা সংখ্যার সীমা থেকে থাকবে। না হলে এমন তো হওয়ার কথা নয়। 

সে যাক, এই ঘুরে ঘুরে যখন গ্যালারি-৫ এর সামনে, তখন দেখা মিলল আউয়াল হোসেনের সঙ্গে। গ্যালারি-৫ ও ৬-এর নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বে থাকা আউয়ালকে দেখা গেল একটি ছবির সামনে বেশ আগ্রহ নিয়ে থাকতে। দেয়ালে ঝোলানো সেই জলরঙের আঁকা ছবি এমনিতে বোঝা যায় না। নানা রঙের অনুভূমিক টানে আঁকা ছবিটি কি জাদু করল আউয়ালকে। কৌতূহল হলো, আর সে থেকেই কথার শুরু। জানা গেল, আগে ছিলেন পঙ্গু হাসপাতালে। শুনে কৌতূহল বাড়ল বেশ। চোখ দেখেই হয়তো বুঝলেন। বললেন, ‘এখানে ভালো লাগে। ওখানে তো অসুখ।’ বোঝা গেল শিল্পকলা নতুন দায়িত্ব ক্ষেত্র হওয়ায় তিনি কিছুটা নতুন জীবন পেয়েছেন। ছবিটি দেখিয়ে বললাম, ‘ভালো লাগল এই কাজ?’ মাথা নাড়লেন। 

একটু অন্তরঙ্গ হয়ে আলাপ বাড়াতেই ব্যাখ্যা শুরু করলেন, ‘এটা আসলে গ্রামের ছবি। এই ছবিতে নদী আছে।’ ‘নদী আছে! কোথায়?’ প্রশ্ন করতেই এগিয়ে দেখিয়ে দিলেন রুপার মতো দেখতে তুলির টান। ‘এগুলা ঢেউ, নদীর। আর এই হলো বালু’, সাদা রেখা দেখিয়ে। তারপর আকাশ ও আরও কত কী? বোঝা গেল গ্রামের গন্ধ মাখা এই শহরের নাগরিকদের একজন এই আউয়াল হোসেনেরও মন কেমন করছে হয়তো। 

আলাপে আলাপে জানালেন, বাড়িতে মা-বাবা আছে। আছে স্ত্রী। আর ছোট এক সন্তান। চোখটা চকচক করে উঠল তাঁর এসব বলতে বলতে। আলাপে আলাপে দেখা গেল, সময় যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কিন্তু যেতে তো হবে। প্রদর্শন কক্ষে বেশিক্ষণ থাকার তো নিয়ম নেই। এ তো পরিব্রাজকের জায়গা। চলে আসতে চাইলেও আউয়ালের চোখে আরও আলাপের আহ্বান। কিন্তু সেই আহ্বান উপেক্ষা করে সরে পড়তে হলো। ঘুরে ঘুরে অন্য গ্যালারিগুলো দেখার জন্য পা বাড়াতে হলো। কিন্তু এই পা বাড়িয়েও তাঁর সঙ্গে দেখা হলো আরও অন্তত চারবার। বোঝা গেল তিনি বেশ অনেকক্ষণ ধরেই আশপাশে আছেন। তাঁর চোখে কি হাজারটা কথা জমা? কিন্তু ফিরতে তো হবে। 

ফেরার সময়ই দেখা হলো কাঁটাতারের জালিতে আটকে পড়া পাখিদের সঙ্গে। সেখানে লক্ষ্মীপ্যাঁচার সঙ্গে চোখাচোখি এড়িয়ে চোখ পড়ে গিয়ে বকের ওপর, সেখান থেকে সরালে চোখ যায় চড়ুইর ডানায়। পাশ থেকে শালিক ডেকে বলছে যেন, ‘আমায় দেখ।’ সবাই যেন একবাক্যে একই কথা বলছে—দেখ কী করে, কাদের তাড়িয়েছ তোমরা।’ থমকে যেতে হলো। মনে হলো তাই তো। মনে হলো গাছ-বিগত এই নগরে পাখিদের আবাস আমরা কী নিষ্ঠুরতায়ই না ধ্বংস করেছি। মনটা কেমন করে উঠল। উড়তে চাওয়া পাখিদের ডানা যেন আড়ষ্ট হয়ে আছে। মনে হলো এই ইট-কাঠের শহরের বাসিন্দা হিসেবে এই ডানা-ছাঁটা লোকের দলে তো আমরা সবাই-ই আছি। এমন ভাবনা নিয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ফের ভাবনা এল মাথায়—গাছ-নদী-পাখিদের সংসার উজাড়কে তির্যকভাবে দেখে যে শিল্পকর্মের জন্ম, তার পাখিগুলো কেন তবে কাঠেরই তৈরি? 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত