Ajker Patrika

নদী ‘খুনের’ পেছনে দায়ী ভারত, উন্নয়ন প্রকল্প ও দখলদারেরা: আনু মুহাম্মদ 

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭: ৫১
Thumbnail image

দেশের নদীগুলো একের পর এক ‘খুন’ হয়ে যাওয়ার পেছনে ভারতের নদীমুখে বাঁধ, নদীকেন্দ্রিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও স্থানীয় দখলদারেরা প্রধানত দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। 

আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন, নোঙর, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও ইনিশিয়েটিভ ফর পিসের যৌথ আয়োজনে ‘দখলের গ্রাসে শুঁটকি নদীর ২৬ কিলোমিটার, ৫০ বছরের নদী লুট ঠেকাতে নাগরিক আহ্বান’ শীর্ষক সভায় এমন মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ। 

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দেশের নদীগুলো যে একটার পর একটা খুন হয়ে যাচ্ছে, এর পেছনে তিনটা উৎস। প্রথমত, ভারত। সেখানে বাঁধ, নদী সংযোগ প্রকল্প হওয়ার কারণে আমাদের নদীগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নদীসংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প। এর ফলে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অপরিকল্পিত কাজের কারণে সীমানা অনির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের সঙ্গে অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি, সংস্থা ঋণ দিচ্ছে। তৃতীয় হচ্ছে, যারা সরাসরি নদী দখল করছে। এটা সরাসরি ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত।’

বর্তমানে যে উন্নয়নের মডেল তা নদী খুনের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির পেছনে কনস্ট্রাকশন অন্যতম বড় খাত। এই খাতের সঙ্গে জড়িত ইট, সিমেন্ট, বালি। এসবের সঙ্গে সরাসরি নদী-সম্পর্কিত। শুঁটকি নদী দখল করে দেওয়ান ইয়াহিয়া কনস্ট্রাকশন করছেন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার পাড়ে সিমেন্ট কারখানা, ইটের ভাটা। উন্নয়ন বলতে যদি শুধু জিডিপি বোঝেন তাহলে তো নদী দখল খুবই ভালো কাজ। 

নদী কেটে সরু করতে তিনটি বড় প্রকল্প হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, চীন তিস্তা নদীতে বিনিয়োগ করছে। বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগে ব্রহ্মপুত্রে আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে। আরেকটি ভারতের বিনিয়োগে আরও কয়েকটি নদীতে। এই প্রকল্পগুলোর মূল কথা হচ্ছে, নদী কেটে সরু বানাতে হবে যেন নদীর পাড়ে জমি বের করা যায়। 

ক্ষমতাসীনরাই দখলদারদের মদদ দিচ্ছে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে এক মেয়র সাহেব বললেন, আমরা বুড়িগঙ্গাকে আরেকটা হাতিরঝিল বানাব। যারা নদী এবং ঝিলের তফাৎ জানে না বা নদীকে ঝিল বানানো একটা গৌরবের বিষয় মনে করেন, একটা উন্নয়ন প্রকল্প ভাবে তাঁরাই তো নেতৃত্ব দিচ্ছে, কর্তৃত্ব করছে। এখানে আইন, দর্শনের বিষয় আছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় হচ্ছে ক্ষমতার বিষয়।’ 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক নদী প্রশাসনের চিত্রটা খুব ঘোলাটে। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ তাদের নদী রক্ষা করেছে তারা নদীকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেছে। একটা নৃতাত্ত্বিক কারণেই নদী রক্ষা করতে হবে। কারণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ভাঙন কমানো, সেচ, জলবিদ্যুৎ, মাছ, মাঝি, ড্রেনেজ ইত্যাদি অনেক কারণে নদীকে সম্পদ বলি। আমাদের হাইকোর্টে রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা বলা হয়েছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আপনি একের পর এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করছেন। এমনকি একটা নদী রক্ষা কমিশনও করে ফেলেছেন। তারপরও কি নদীগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে। আসলে নদী বাঁচানোর ইচ্ছা নেই। তবু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ নদী রক্ষার জন্য দাঁড়াচ্ছে। নদী, পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার আন্দোলন আমাদের আরও সাহসিকতা, সততার সঙ্গে করতে হবে।’ 

নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘দলমত-নির্বিশেষে নদী সবার। তাই এটা আমাদের সবার রক্ষা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ বলছে না, নদী উদ্ধার চাই। তাদেরও বলা উচিত। এমন কোনো বড় প্রতিষ্ঠান নেই যারা গত ৩০ বছরে নদী দখল করেনি। স্বাধীনতার পর থেকেই নদী দখল হচ্ছে। নদী, পানি, পরিবেশ, দেশের অস্তিত্ব ও আগামী প্রজন্মের স্বার্থে সব নদী দখলমুক্ত করতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, শক্ত আইনি ভিত্তি থাকার পরও কেন নদী দখল উদ্ধার করা যাচ্ছে না? যেসব ‘কিটগুলো’ দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বসে আছে তাঁরা কাজ করছে না। সময় পার করছেন। তাঁদেরকে বসিয়েছে ওই টাকা-পয়সার মালিক কোম্পানির ক্ষমতাসীন দুষ্টুগুলো। 

সভায় অন্যান্য বক্তারা বলেন, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার শুঁটকি নদীকে খাল দেখিয়ে ইয়াহিয়া ফিসারিজ প্রাইভেট লিমিটেড আদালত ও স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে প্রায় ৫০ বছর ধরে ভোগদখল করছে। নদীটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তালিকাভুক্ত হলেও দখলদারের তালিকায় ইয়াহিয়া ফিসারিজ বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান আহমেদ রাজার নাম কোথাও নেই। নদীতে স্থানীয় মাঝিরা মাছ ধরতে গেলে তিনি বন্দুক হাতে তেড়ে আসেন বলেও অভিযোগ রয়েছে বলে জানান বক্তারা। 

হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন ও ইনিশিয়েটিভ ফর পিস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক প্রধান নির্বাহী শিপা হাফেজ, নোঙরের চেয়ারম্যান সুমন শামস, আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ ও নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা প্রমুখ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত