Ajker Patrika

কক্সবাজারে বাঁকখালীর তীর দখলের মচ্ছব

  • আজ পরিদর্শনে আসছেন দুই উপদেষ্টা।
  • দখল-দূষণে সরু খালে পরিণত হচ্ছে খরস্রোতা বাঁকখালী নদী।
  • কস্তুরাঘাট এলাকায় নদীবন্দরের জন্য নির্ধারিত জমিও দখল হয়ে গেছে।
মাইনউদ্দিন শাহেদ, কক্সবাজার
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৬: ৫৩
কক্সবাজার শহরের মাঝিরঘাট থেকে নুনিয়ারছড়া পর্যন্ত বাঁকখালী নদীর জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের জায়গা দখল করে চলছে পাকা স্থাপনা নির্মাণের কাজ। এরই মধ্যে নদীচরে থাকা প্যারাবনের কয়েক হাজার গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। গতকাল দুপুরে জেলা শহরের পেশকারপাড়া এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা
কক্সবাজার শহরের মাঝিরঘাট থেকে নুনিয়ারছড়া পর্যন্ত বাঁকখালী নদীর জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের জায়গা দখল করে চলছে পাকা স্থাপনা নির্মাণের কাজ। এরই মধ্যে নদীচরে থাকা প্যারাবনের কয়েক হাজার গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। গতকাল দুপুরে জেলা শহরের পেশকারপাড়া এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

কক্সবাজার শহরের উত্তর পাশ ঘেঁষে মহেশখালী চ্যানেল হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে খরস্রোতা নদী বাঁকখালী। এ নদীর মোহনা ঘিরেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান পর্যটন শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্তু সেই নদীই দখল-দূষণে এখন সরু খালে পরিণত হচ্ছে। প্রভাবশালী দখলদারেরা নদীতীরের প্যারাবন কেটে ও চর ভরাট করে একের পর এক পাকা স্থাপনা গড়ে তুলছেন। সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রশাসনিক শিথিলতার সুযোগে নদী মোহনার নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় যেন দখলের মচ্ছব চলছে।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার সামনে দিয়ে তিন-চার শ গজ এগোলেই কস্তুরাঘাট। গত কয়েক মাসে কস্তুরাঘাট এলাকায় নদীবন্দরের জন্য নির্ধারিত জমিও দখল হয়ে গেছে। নৌবন্দরের ৩০০ একর জায়গাজুড়ে এখন পাকা দালান ও স্থাপনা।

কক্সবাজার শহরের সঙ্গে নদীর ওপারের খুরুশকূলের সংযোগ স্থাপনের জন্য দুই বছর আগে ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু ও সড়ক তৈরি করা হয়েছে কস্তুরাঘাটে। সেতুটিতে উঠতেই বাঁ পাশে নৌবন্দরের জমি, ডান পাশে কক্সবাজার পৌরসভার বর্জ্য ফেলার ভাগাড়। এই ভাগাড় থেকে পূর্ব দিকে শহরের মাঝিরঘাট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার নতুন সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এই সেতু ও সড়ক তৈরির পর স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদীতীরের জমি দখল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করছেন। এ জন্য ভুয়া কাগজপত্র বানানোর অভিযোগও রয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ২০১৩ সাল থেকে বাঁকখালীর পাড়ে পৌরসভার বর্জ্য ফেলা শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে ভাগাড়টিই দখলের চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসন কস্তুরাঘাট সেতুর দুই পাশের চার শতাধিক পাকা-আধা পাকা স্থাপনা উচ্ছেদ করে গুঁড়িয়ে দেয়। দখলমুক্ত করা হয় নৌবন্দরের জমি। কিন্তু দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা জমি দখলে গত ৫ আগস্টের পর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে দখলদার চক্র। দখলদারেরা এরই মধ্যে নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত হাজারো স্থাপনা গড়ে তুলেছে।

স্থানীয় টেকপাড়ার বাসিন্দা আইনজীবী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিস্তীর্ণ প্যারাবন কেটে নদীতীরের জমি দখল করা হয়েছে। আবার এসব নদী দখলদারদের অন্যতম হাতিয়ার আদালতের নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু কথা হলো, জমির মালিকানা যদি সঠিক থাকে তাহলে কেন আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিতে হবে। এতে বোঝা যায় কাগজপত্রগুলো সবই ভুয়া!’

নদীতীরের জমি দখল করে দালান ও স্থাপনা তৈরি হচ্ছে বলে স্বীকার করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াছমিন চৌধুরী বলেন, ‘কেউ কেউ এসব স্থাপনা ব্যক্তিগত জমিতে করা হচ্ছে দাবি করে কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয়। এর মধ্যে কাগজপত্র দেখে নদীতীরের অবৈধ দখল উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’

উপকূল রক্ষার প্রহরী উজাড়

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড় থেকে সৃষ্ট বাঁকখালী নদী রামুর ওপর দিয়ে কক্সবাজার শহরের উত্তর পাশ হয়ে আঁকাবাঁকা পথে মিশেছে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে। সেই নদীর তীরে এক যুগ আগে গড়ে তোলা হয়েছিল প্যারাবন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো সামুদ্রিক দুর্যোগ থেকে উপকূলকে বাঁচাতে এ বনাঞ্চল প্রহরীর ভূমিকায় ছিল। ক্রমান্বয়ে প্যারাবন উজাড় করে সেই জমিতে খননযন্ত্র দিয়ে নদী থেকে মাটি তুলে রাতারাতি ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভরাট করা জমিতে টিনের ঘের দিয়ে প্লট আলাদা করা। তীরের জমি দখল করে স্থাপনা গড়ায় নদীর গতিপথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা জানান, ২০২১ সাল থেকে এই প্যারাবনের লক্ষাধিক বাইন ও কেওড়াগাছ উজাড় করা হয়েছে। এতে অন্তত ২০০ প্রজাতির পাখির আবাসস্থলসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত ৪০০ একর প্যারাবন এবং নৌবন্দরের জমি দখল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় বাঁকখালী নদীর তীর দখল হচ্ছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ১৬ এপ্রিল এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর তাঁরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) জমির উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ২০২১ সাল থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাঁচটি মামলা দেওয়া হয়েছে। সব মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সম্প্রতি দখলের ঘটনায় কয়েকজন দখলদারের বিরুদ্ধে নোটিশ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আগামী রোববার (২৭ এপ্রিল) তাঁর কার্যালয়ে শুনানি রয়েছে।

তালিকা হলেও দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি

২০২০ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ১৩০ জন দখলদারের নতুন তালিকা করেছিল। ওই তালিকায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানসহ প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবীর নাম রয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন জানান, প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি কস্তুরাঘাটে বাঁকখালীর তীর দখল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেছেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের নামে কোনো সাইনবোর্ড লাগাননি কিংবা অন্য কোনোভাবে নাম ব্যবহার করেননি। পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা জেলা প্রশাসন দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

বাঁকখালী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়া জরুরি বলে মনে করেন কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে জেনেই কিছু ব্যক্তি জোয়ার-ভাটা এলাকায় ভুয়া কাগজ বানিয়ে নদীর তীরের জমির মালিকানা দাবি করছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মতে, নদীর জমি উদ্ধারে একটি জরিপ প্রক্রিয়া চলছে। শিগগির এ জরিপ শেষ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে আজ বৃহস্পতিবার নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাঁকখালী নদীর দখল-দূষণ পর্যবেক্ষণে আসছেন। বিকেলে নৌবন্দরের জমির সীমানা পিলার নির্ধারণ এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠকে বসবেন দুই উপদেষ্টা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত