Ajker Patrika

তামাকের ছোবলে হালদা হুমকিতে মাছ ও গাছ

  • চলতি মৌসুমে হালদা চরের ২০ একর জমিতে ১১ চাষি তামাক চাষ করেছেন
  • গত এক দশকে তামাক চাষ কমলেও সম্প্রতি তা বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে
  • তামাক পোড়ানোর চুল্লির জ্বালানি হিসেবে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে বনের গাছ
মানিকছড়ি (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি 
খেত থেকে তামাকগাছ কাটার পর বাড়িতে নেওয়ার জন্য তোলা হচ্ছে মোটরসাইকেলে। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে। ছবি: আজকের পত্রিকা
খেত থেকে তামাকগাছ কাটার পর বাড়িতে নেওয়ার জন্য তোলা হচ্ছে মোটরসাইকেলে। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে। ছবি: আজকের পত্রিকা

দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদার উজান খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে অবাধে শুরু হয়েছে তামাক চাষ। গত এক দশকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এই উপজেলায় তামাক চাষ ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হলেও সম্প্রতি তা বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এতে তামাকের বিষ মিশছে হালদায়। এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে হালদা চরের ২০ একর জমিতে ১১ জন চাষি তামাক চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে খেত থেকে তামাক সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। পোড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে সাতটি চুল্লিও প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব চুল্লির জ্বালানি হিসেবে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে বনের গাছ।

উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র বলেছে, হালদা নদীর উৎপত্তি খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায়। পরে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির ওপর দিয়ে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান উপজেলা হয়ে কর্ণফুলীর মোহনায় গিয়ে সাগরে মিশেছে এটি। এই হালদার মিঠাপানি রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ, ডলফিনসহ অনেক প্রজাতির জলজ প্রাণী ও মাছের বংশবৃদ্ধির অভয়ারণ্য। কিন্তু কালপরিক্রমায় হালদা বিষাক্ত হয়ে উঠছে। আশঙ্কাজনক হারে কমছে পোনা উৎপাদন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সমতলের পাশাপাশি ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে হালদার উজান খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে ব্যাপক হারে শুরু হয় তামাক চাষ। তামাকের পাতা ও চুল্লি থেকে নির্গত পানিতে দূষিত হতে থাকে হালদা। ২০১৬ সালে হালদায় মাছের ডিম উৎপাদন চরমভাবে কমে যায়। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন গবেষকেরা।

তামাক চাষ বন্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হয় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে। ২০২১-২২ সালের দিকে এখানকার প্রায় ৯৯ শতাংশ তামাকচাষি কৃষিকাজে ফেরেন। কিন্তু ২০২৩ সাল থেকে তামাক কোম্পানিগুলো যৌথভাবে এই এলাকার তামাকচাষিদের প্রণোদনা প্রায় ৪ গুণ বাড়িয়ে দিয়ে আবার তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। পরে কিছু কৃষক তামাক চাষে সম্পৃক্ত হন। এবার ২০ একর জমিতে ১১ চাষি তামাক চাষ করেন।

তামাকচাষি মো. ঝন্টু মিয়া বলেন, ‘এবার তামাক কোম্পানি আমাদের অগ্রিম টাকা দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু শর্তে অনেক কড়াকড়ি করেছে। যেমন তামাক চাষ ও চুল্লিতে পুড়িয়ে কোম্পানির গুদামে পৌঁছে দিলে শুকনা পাতার কেজি ২০০-২২০ টাকা হারে পরিশোধ করবে। আগে দামও কম, শর্তেও কড়াকড়ি ছিল না।’

গাড়ীটানা বন বিভাগের বন কর্মকর্তা (রেঞ্জার) কাজী তামিল রাসুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, বনের গাছ কেটে তামাক পোড়ানোর সুযোগ নেই। চুল্লিতে কাঠের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত বৃহস্পতিবার হালদা চরে তামাকের বিষাক্ততা পরিদর্শনে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া এবং হালদা রক্ষা কমিটির সম্পাদক মোহাম্মদ আলীসহ একটি প্রতিনিধিদল। এ সময় হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া হালদায় তামাকের বিষাক্ততায় উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘হালদা নদীতে ২০১৬ সালে ব্রুড মাছ ডিম না ছাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয় মানিকছড়ি এলাকায় হালদা নদীর তীরে ব্যাপক হারে তামাক চাষকে। ২০২১-২২ সালের দিকে এখানকার প্রায় ৯৯ শতাংশ তামাকচাষিকে মূল ধারার কৃষিকাজে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হই। এই সফলতা তামাক কোম্পানিগুলো মেনে নিতে পারেনি। তারা তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন চাষিদের। এতে কিছু লোভী কৃষক আবার তামাক চাষে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তামাক চাষ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে হালদা নদীর মৎস্য প্রজনন হেরিটেজ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

মানিকছড়ি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, হালদাপারে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করে বিকল্প চাষাবাদে কৃষকদের সম্পৃক্ত করতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত