Ajker Patrika

অ্যাম্বুলেন্স আছে, চালক নেই—ভোগান্তিতে ঝালকাঠির রোগীরা

আরিফ রহমান, ঝালকাঠি
ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল।

জরুরি সেবার অন্যতম বাহন অ্যাম্বুলেন্স। অথচ চালক না থাকায় সম্পূর্ণ অচল অবস্থায় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে টানা ৯ দিন ধরে তিনটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স গ্যারেজে পড়ে আছে। ফলে রোগী পরিবহন ও জীবন রক্ষায় ভয়াবহ বিঘ্ন ঘটছে। আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে—প্রশাসনিক গাফিলতি, অস্বচ্ছ বদলি প্রক্রিয়া এবং কিছু প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজিতে এমন ঘটনা ঘটছে।

জানা যায়, গত ১ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক আদেশে সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালক মো. জামাল হোসেন এবং সিভিল সার্জনের চালক মো. আবু বকর ছিদ্দিককে ভোলায় বদলি করা হয়। কিন্তু তাঁদের বদলির পর সদর হাসপাতালে কোনো বিকল্প চালক না দিয়ে আদেশ কার্যকর করায় হাসপাতালের জরুরি পরিবহনসেবা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ও মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. আবুয়াল হাসান বলেন, ‘বদলির চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি সিভিল সার্জন মহোদয়কে জানানো হয়েছিল। তিনি চালকদের রিলিজ না দিতে বলেন। কিন্তু আদেশে “অটো রিলিজ” শর্ত থাকায় তাঁরা নিজেরাই ভোলায় যোগ দেন। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।’

আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মেহেদী হাসান সানি জানান, বদলির পরপরই বিষয়টি বিভাগীয় পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো বিকল্প চালক আসেননি।

জানতে চাইলে চালক জামাল হোসেন বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়েছিল, তিন কর্মদিবসের মধ্যে যোগদান না করলে চতুর্থ দিন থেকে তা কার্যকর হবে। সে অনুযায়ী ৪ জুলাই আমি ভোলায় যোগদান করেছি।’

তবে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ‘অটো রিলিজ’ সাধারণত জাতীয় জরুরি প্রয়োজনে প্রযোজ্য হয়। একটি সাধারণ বদলিতে এই শর্ত প্রয়োগ যৌক্তিক নয়। এ সিদ্ধান্তে স্থানীয় বাস্তবতা পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।’

সরকারি তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ফেলে রাখা হয়েছে গ্যারেজে।
সরকারি তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ফেলে রাখা হয়েছে গ্যারেজে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, জামাল হোসেন ও আবু বকর ছিদ্দিক পরস্পর ভগ্নিপতি এবং তাঁদের বাড়ি ভোলায়। অতীতেও তাঁরা ভোলায় বদলি হয়ে সুবিধা নিয়েছেন। এবারও ‘অটো রিলিজ’ সুবিধার আড়ালে তাঁরা সেখানে ফিরে যান।

জামাল হোসেন ২০০৪ সালে চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। এরপর ভোলা সদর ও টিভি হাসপাতালে ছয় বছর এবং বরিশালের মুলাদীতে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। আবু বকর ছিদ্দিক ২০১১ সালে মনপুরায় যোগ দিয়ে তজুমুদ্দিন, দৌলতখান ও ভোলা সদরে প্রায় ১২ বছর কর্মরত ছিলেন।

একজন অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটি আদেশের অপপ্রয়োগ। ঢাকায় প্রভাবশালী মহলের সুপারিশে বদলির আদেশটি হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের।’

এদিকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় রোগীদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। একদিকে টাকা গুনতে হচ্ছে তিন গুণ, অন্যদিকে বাড়তি ঝামেলাও পোহাতে হচ্ছে। ঝালকাঠি থেকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে ভাড়া আসে ৪০০ টাকা। এখন সেখানে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সকে দিতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

রানাপাশা গ্রামের ইমরান হোসেন বলেন, ‘আম্মা অসুস্থ হওয়ায় সদর হাসপাতালে নিলাম। ডাক্তার বরিশালে স্থানান্তর করেন। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে প্রাইভেট গাড়িতে নিতে হয়েছে।’

শেকেরহাটের মকবুল হোসেন বলেন, ‘ভাইয়ের বউকে ঝালকাঠি হাসপাতাল থেকে বরিশালে স্থানান্তর করলে ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সকে। অথচ সরকারি গাড়িতে খরচ হতো ৪০০ টাকা।’

সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে করে স্থানান্তরে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে করে স্থানান্তরে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

নবগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা ইমাম হোসেন বিমান বলেন, ‘সরকারি সেবার নামে শুধু কাগজে সুবিধা দেখি, বাস্তবে গরিবের কপালে শুধু ভোগান্তি।’

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র একজন চালকের মাধ্যমে সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু রাজস্ব আয় সত্ত্বেও কোনো অতিরিক্ত চালক নিয়োগ কিংবা চালক পুল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও সুপারিশের মাধ্যমে বদলির আদেশটি তড়িঘড়ি করে করিয়েছেন। এর পেছনে আর্থিক লেনদেনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ঝালকাঠির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সত্যবান সেনগুপ্ত বলেন, ‘চালক নেই, অথচ গাড়ি আছে—এ যেন কল্পকাহিনি। এটি শুধু প্রশাসনিক গাফিলতি নয়, দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি।’

বিষয়টি জানার পর বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। দ্রুত বিকল্প চালক দিয়ে সমস্যা সমাধান করা হবে।’ তবে স্থানীয় বাস্তবতা বিবেচনা না করে আদেশটি কেন দেওয়া হলো, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

চিকিৎসাসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ প্রশাসনিক গাফিলতি, অনৈতিক প্রভাব ও বদলি সিন্ডিকেটের কারণে ঝালকাঠির সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন সেই জরুরি সেবা থেকে, যা হয়তো বাঁচিয়ে রাখতে পারত একটি জীবন। এখন প্রশ্ন উঠছে—এই চরম দুরবস্থার দায় নেবে কে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত