Ajker Patrika

জুতার সেলাইয়ে আটকে আছে এক জীবনের গল্প

শিমুল চৌধুরী, ভোলা 
আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ১৫: ২৪
ছেঁড়া জুতায় সুতা বুনেই ৭৬ বছর  কেটে গেলো রমেশের। অথচ ভাগ্যের কোন ছেঁড়া দাগই রঙ-কালিতে ঢাকতে পারেননি। ভোলার নবীপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
ছেঁড়া জুতায় সুতা বুনেই ৭৬ বছর কেটে গেলো রমেশের। অথচ ভাগ্যের কোন ছেঁড়া দাগই রঙ-কালিতে ঢাকতে পারেননি। ভোলার নবীপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

সকালের আলো ফোটার আগেই ভোলার নবীপুর এলাকায় একটি টিনের ছাউনির নিচে, রাস্তার ধারে নিজের ছোট্ট জগৎ সাজিয়ে বসেন রমেশ চন্দ্র দাস। কাঠের এক চৌকি, পাশে রাখা নেহাই, পুরোনো রঙের বোতল আর চামড়া কাটার যন্ত্র—এই নিয়েই তাঁর কারখানা। কিন্তু পা-জোড়া কিংবা হাত-জোড়া নয়, রমেশের পুরো জীবনেরই যেন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ছেঁড়া জুতা’। যে জুতা তিনি সেলাই করেন, তা যেন আসলে আমাদের সমাজেরই চিত্র—ছেঁড়া, অবহেলিত আর অনাদরে ভরা।

আজকাল বাজারে মাত্র ৫০ টাকা খরচ করলেই একজোড়া প্লাস্টিকের জুতা পাওয়া যায়। কেউ আর পুরোনো জুতা সেলাই করাতে চায় না। মুচির কাজ হারিয়েছে কদর। কিন্তু রমেশ থেমে যাননি। থেমে যাওয়ার উপায়ও নেই। ছয়জনের সংসার, বয়সের ভার, আর অভাবের কশাঘাতে জর্জরিত তিনি, তবু প্রতিদিন হাজির হন ফুটপাতে।

রমেশ বলেন, ‘কোনো দিন আয় হয় ৫০ টাকা, কোনো দিন ১৮০। আবার কোনো দিন এক টাকাও আসে না। শীতকালে একটু বেশি আয় হয়—২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তাতেও কি চলে ছয়জনের পেট?’

তিন মেয়ের বিয়েতে ঋণের পাহাড় উঠেছে। অসুখ হলেও চিকিৎসা করাতে পারেন না। সরকার থেকে শুধু তিন মাস অন্তর ১৬৫০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পান। এটাই তাঁর সামাজিক নিরাপত্তা।

তিনি বলেন, ‘আমার বয়স যখন ৯ বছর, তখন থেকেই ছেঁড়া জুতা সেলাই করছি। এখন বয়স ৭৬। জীবনটা গেল সুঁই-সুতা আর কালি-চামড়ার সঙ্গে যুদ্ধ করেই।

রমেশ যে জায়গায় বসে কাজ করেন, সেটা ‘জৈনপুরী পীর সাহেব’-এর দানকৃত একটি জমি। পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের যুগীরঘোল এলাকায় সেই ফুটপাতটুকুই এখন তাঁর জীবনের কেন্দ্র। ৭৬ বছর ধরে সেখানেই ছেঁড়া জুতায় সুতা বুনেছেন, অথচ ভাগ্যের কোনো ছেঁড়া দাগই রং-কালিতে ঢাকতে পারেননি।

ভোলা সদর উপজেলার সমাজসেবা কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রমেশ চন্দ্র দাস বয়স্ক ভাতা পান বটে, তবে তাঁর মতো অসংখ্য বঞ্চিত পেশাজীবীর জন্য সরকারের আরও সহায়তা প্রয়োজন।’

রমেশ চন্দ্র দাস আমাদের চোখে হয়তো এক সাধারণ ‘মুচি’। কিন্তু তাঁর জীবন আসলে আমাদের রাষ্ট্র আর সমাজের একটা অনুরণন, যেখানে কাজের কোনো মান নেই, নেই পেশার সম্মান, নেই নিরাপত্তার ছায়া। এক জীবনের পুঞ্জীভূত কষ্ট, নীরব আত্মত্যাগ আর নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকার সংগ্রাম যেন জুতোর প্রতিটি সেলাইরেখায় ফুটে ওঠে।

কখনো কি আমরা ভাবি—রমেশরা হারিয়ে গেলে আমাদের সমাজের ছেঁড়া জুতোগুলো আর কে সেলাই করবে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত