Ajker Patrika

আয়েশাদের বাড়ির আঙিনায় মিয়ানমারের গুলি

আমানুর রহমান রনি, উখিয়া, কক্সবাজার থেকে
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯: ২৪
আয়েশাদের বাড়ির আঙিনায় মিয়ানমারের গুলি

আয়েশা বেগম। সত্তরোর্ধ্ব এই নারী ভালো করে দাঁড়াতে পারেন না। কথা বলতে গেলে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বলেন। তাও তাঁর স্বর যেন বের হতে চায় না, কথা বলার সময় শরীর কাঁপে। কেঁপে কেঁপে যা বললেন, তা যেন সব সীমান্তবাসীর কথা।

এই নারীর বসবাস কক্সবাজারের উখিয়া থানার রহমতের বিল নামক মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায়। গত মঙ্গলবার (‍৬ ফেব্রুয়ারি) রাখাইনে আরকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ বলতে গেলে তাঁর বাড়ির সামনেই ঘটে।

আয়েশা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী কাদের বসু মারা গেছেন বছর দশেক আগে। বড় ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতেই তাঁর বাস। মেয়েকে বিয়ে দিলেও নিজের কাছেই রেখেছেন। বড় ছেলেও থাকেন তাঁর সঙ্গে। মঙ্গলবার রাতভর বৃষ্টির মতো গুলির শব্দ পান। কোনো রকমে সেদিন রাত পার করেন। সকালে বাংলাদেশ সীমান্ত সড়কের ওপর দিয়ে বুলেট তাঁর ঘরে এসে পড়ে।

আয়েশা বেগম বাড়িতে এসে পড়া গুলি হাতে নিয়ে দেখিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় প্রশ্ন করেন, ‘এই গুলির দানা যদি কারও মাথায় বা গায়ে লাগে, তাহলে সে কি আর বাঁচবে?’ সেদিনই বাড়ি ছেড়ে বালুখালী চলে যান তিনি। পরদিন গোলাগুলি থামার পর বাড়িতে ফেরেন। কিন্তু আতঙ্ক কাটেনি।

রহমতের বিলের উত্তরপাড়ার আরেক বাসিন্দা পারভিন আক্তার কাপড় গুছিয়ে বস্তায় ভরে রেখেছেন। দুই দিন বালুখালীতে ভাইয়ের বাড়িতে ছিলেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত যেন ভাইয়ের বাড়িতে যেতে পারেন, সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন তিনি।

পারভিন আক্তার বলেন, ‘দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে এখানে কোনোভাবেই থাকা সম্ভব নয়। গুলির শব্দে মাটিতে শুয়ে ছিলাম এক দিন। এরপর আমার ভাই খবর দিলে ভাইয়ের বাসায় চলে যাই।’

কখন এলাকা ছাড়তে হয় তাই বস্তায় কাপড় ভরে প্রস্তুত হয়ে আছেন পারভিন আক্তার। ছবি: আজকের পত্রিকারাখাইনে চলমান যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের প্রায় ২৮০ কিলোমিটার সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে এ রকমের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সীমান্তবর্তী অন্তত ৫ হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তমব্রু, ঘুমধুম এলাকার লোকজন কেউ কেউ গত বুধবার থেকে বাড়ি ফেরা শুরু করেছে।

বর্তমানে টেকনাফ সীমান্তবর্তী এলাকার মিয়ানমার অংশে যুদ্ধ চলছে। আরকান আর্মিরা বান্দরবান এলাকার সীমান্তবর্তী থেকে রাখাইন রাজ্যে বিজিপি ঘাঁটি ও বিওপি দখল করতে করতে মংডুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই দুই তিন-দিন টেকনাফ সীমান্ত অঞ্চলে বড় ধরনের গোলাগুলির আশঙ্কা রয়েছে।

সীমান্তে এই গোলাগুলির কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন কৃষকেরা। মাঠভর্তি ফসল, কিন্তু জমির কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে সীমান্তের ওপার থেকে ছুটে আসায় গুলিতে অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েকজন।

রহমতের বিল এলাকার রহমতের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি কামাল উদ্দিন মিয়াজী বলেন, ‘আমাদের জমিজমা সব সীমান্তবর্তী এলাকায়, কৃষকেরা কাজ করতে পারছেন না, সন্তানেরা বাইরে নামতে পারছে না, স্কুলে যেতে পারছে না, স্কুল বন্ধ। মানুষ নিজের ঘরেও নিরাপদ নয়।’

কামাল উদ্দিন বলেন, ‘সীমান্তের হাজার হাজার মানুষ আতঙ্ক নিয়ে ঘরে থাকছে। কত দিন কোথায় গিয়ে থাকবে মানুষ! এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। সরকারের উচিত মিয়ানমারকে জানিয়ে দেওয়া যে, গোলাগুলি যেন বাংলাদেশে না আসে।’

গোলাগুলির কারণে লাখ লাখ টাকার ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেক কৃষক। বীজতলায় কেউ কেউ পানি দিতে পারছেন না। বিজিবি কৃষকদের সীমান্তবর্তী আবাদি জমিতে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। তমব্রুর মধ্যমপাড়ার কৃষক মো. তৈয়ব আলী বলেন, ‘১২ থেকে ১৩ বিঘা জমিতে আবাদ করেছি। বাদাম, বেগুন এবং মরিচ চাষ করেছি। বাদাম তোলার সময় হয়েছে কিন্তু তুলতে পারছি না। সময়মতো বাদাম তুলতে না পারলে সব বাদামে গাছ জন্মাবে অথবা ইঁদুরে কেটে ফেলবে। বেগুন লাগানোর পর আর তুলতে পারিনি। কবে খেতে যেতে পারব তাও জানি না।’

বাড়িতে এসে পড়া বন্দুকের গুলি দেখাচ্ছেন এক স্থানীয় বাসিন্দা। ছবি: আজকের পত্রিকাএদিকে পরিস্থিতির উন্নতির কোনো আশা দেখছে না প্রশাসনও। তবে বাংলাদেশ অংশে যেন গোলাবারুদ বা গোলার অংশ না আসে, সে জন্য বিজিবি কাজ করছে। বুধবার দুপুরে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী সদস্যদের (বিজিপি) ফেরত দেওয়ার জন্য দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পত্রালাপ চলছে। মানবিক কারণে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব ফেরত দেওয়া হবে।

বিজিবি-প্রধানের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত ২৬৪ বিজিপি সদস্যকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুজন নারী ও দুই শিশু রয়েছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইমিগ্রেশন সদস্য ও অন্যান্য সংস্থার ৩২৭ জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাঁদের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ সাপেক্ষে নিরাপদ আশ্রয় এবং আহতদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেল কেনা স্থগিত করল চীন

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

চীনের সহায়তায় বিদ্রোহীদের কাছে হারানো অঞ্চল আবার দখলে নিচ্ছে মিয়ানমার

এলাকার খবর
Loading...