Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ কীভাবে শেষ হতে পারে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৬ জুন ২০২৫, ২২: ০৫
কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে শহীদ রাজয়ি বন্দর ও আশপাশ। ছবি: এএফপি
কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে শহীদ রাজয়ি বন্দর ও আশপাশ। ছবি: এএফপি

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের কেবল শুরু। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস ও সামরিক বাহিনীকে পঙ্গু করে দিতে ‘যত দিন লাগবে’ ইসরায়েল তত দিন আঘাত হানতে থাকবে। এটি প্রাথমিকভাবে কয়েক সপ্তাহ হতে পারে। ইরান এরই মধ্যে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরায়েলের দিকে, তবে দেশটির প্রতিশোধ নেওয়ার বিকল্প পথ সীমিত। সামনে অনেকটাই অনিবার্য রক্তপাত অধ্যায়। তাই এখনই ভাবার সময়, এই যুদ্ধ কীভাবে শেষ হতে পারে এবং কীভাবে উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে।

ইরানের পরাজয়, ইসরায়েলের পিছু হটা অথবা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ—যেকোনো কিছুই হতে পারে। এ নিয়ে ফরেন পলিসিতে নিবন্ধ লিখেছেন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে যুদ্ধ, অপ্রচলিত হুমকি ও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচির ইন্টার্ন ইসেলিন ব্র্যাডি এবং সিনিয়র ফেলো ও জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ফরেন সার্ভিস স্কুলের অধ্যাপক ড্যানিয়েল বাইম্যান। তাঁদের নিবন্ধটি বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হলো।

প্রথম সম্ভাব্য পরিণতি

ইরান একাধিক দৃশ্যমান সামরিক হামলা চালিয়ে দাবি করতে পারে যে, তারা ইসরায়েলিদের পাল্টা আঘাত দিয়েছে। এরপর দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে পারে। অর্থাৎ, এটি হবে মুখ রক্ষা করে একপ্রকার পরোক্ষ আত্মসমর্পণ।

এমনই ঘটেছিল ২০২৪ সালে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘর্ষের সময়। ইসরায়েল ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছিল এবং হিজবুল্লাহর বহু শীর্ষ নেতাদের হত্যা করেছিল। হিজবুল্লাহর ছিল বিপুল রকেট মজুত ও হাজার হাজার যোদ্ধা। এরপরেও কার্যত কোনো জবাব না দিয়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে যায়। এখন ইরানও একই অবস্থায় পড়েছে।

হিজবুল্লাহর ২০২৪ সালের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলো ব্যর্থ হয়েছিল। হিজবুল্লাহসহ অন্য প্রক্সিগুলোর ক্ষমতাও কমেছে। ইসরায়েলি হামলায় ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা নিহত হওয়ায় দেশটির সামরিক কমান্ড ভেঙে পড়েছে। যদিও ইরান দ্রুত নতুন নেতাদের বসাচ্ছে, তবু কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। কারণ, ইসরায়েল বারবার নতুন নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করতে সিদ্ধহস্ত। এই অবস্থায় ইরান হয়তো এখন কিছুটা পিছু হটে পরে বড় প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

দ্বিতীয় পরিণতি

ইরান হয়তো ধৈর্য ধরে কয়েকটি সফল সন্ত্রাসী ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারবে। কিছু ক্ষেপণাস্ত্র হয়তো ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সক্ষম হবে কিংবা অন্য কোনো কৌশলে। তবে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে যুদ্ধ থামানোর জন্য।

ইসরায়েল সাধারণত এমন হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের প্রাথমিক সমর্থন পায়। কিন্তু তারাই পরে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। এরই মধ্যে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য শান্তির আহ্বান জানিয়েছে। যদিও ইসরায়েল ইউরোপীয়দের উপেক্ষা করতে পারে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতামতকে তারা কখনো ফেলে দেয় না।

ট্রাম্প এরই মধ্যে আবারও পারমাণবিক আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ‘ইরানকে এখনই চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে, না হলে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আর কোনো মৃত্যু নয়, আর কোনো ধ্বংস নয়, এখনই করো, পরে নয়!’

তেহরানের কাছে এই প্রস্তাব আকর্ষণীয় হতে পারে। দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এবং নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়া দরকার। কিন্তু ইসরায়েলি হামলার মধ্যে আলোচনায় বসা তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে কঠিন। ট্রাম্প এমন চুক্তিকে নিজের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখাতে চাইবেন, ফলে ইরান আরও দুর্বল ও চাপের মুখে পড়বে।

তৃতীয় পরিণতি আরও ভয়াবহ

যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইসরায়েলি হামলার আগে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার হুমকি দিয়েছিল। এমনটি ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার কারণে ইরান মনে করতে পারে, ওয়াশিংটন এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের হামলায় অংশ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে, তবে তেহরান এটিকে প্রতারণা হিসেবে দেখতে পারে। কেননা মার্কিনিদের সঙ্গে পরমাণু আলোচনার আড়ালে হামলার প্রস্তুতি চলছিল।

যুক্তরাষ্ট্র হয়তো নিজেও যুদ্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে—যেমন, ইসরায়েল যা শেষ করেনি, তা বোমা মেরে শেষ করা, বিশেষ করে ফরদো পারমাণবিক স্থাপনাগুলো।

ইরান নিজের ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনের প্রক্সি বা ভাড়াটে গুন্ডাদের ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার জন্য উসকে দিতে পারে। তখন ইয়েমেন, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা হতে পারে। এমনকি ইরান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসও ব্যবহার করতে পারে, যেমনটি তারা অতীতে করেছে।

জর্ডানের সশস্ত্র বাহিনী ১৩ জুন ঘোষণা করেছে, তারা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন তাদের আকাশসীমায় গুলি করে নামিয়েছে। ২০২৪ সালেও তারা একইভাবে ইসরায়েলের দিকে ছোড়া মিসাইল ঠেকিয়েছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করলে জর্ডান, সৌদি আরব বা কুয়েতের ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারে।

চতুর্থ সম্ভাবনা

যুদ্ধ কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ নাও হতে পারে। বড় ধরনের বিমান হামলা বন্ধ হলেও নিম্নস্তরের সংঘর্ষ মাসের পর মাস চলতে পারে। ইসরায়েল মাঝেমধ্যে ড্রোন হামলা, গুপ্তহত্যা ও নাশকতা চালাবে। ইরান সন্ত্রাসী হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়বে। এটি পূর্ণযুদ্ধ হবে না, আবার শান্তিও নয়।

এই ধরনের চলমান সংঘর্ষে ইরান হয়তো গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পারে, যেটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকবে—ইসরায়েলি হামলার অজুহাতে। যদি ইসরায়েল সব ইউরেনিয়াম মজুতের স্থান ধ্বংস করতে না পারে, তাহলে তেহরানের পক্ষে গোপনে এগোনো কঠিন হবে না।

স্বাভাবিকভাবেই, এসবের সংমিশ্রণও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে পারমাণবিক চুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে। ইরান হয়তো আপাতত মেনে নেবে, কিন্তু ভবিষ্যতে প্রতিশোধ নিতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাবে—চিরস্থায়ী প্রতিদানমূলক সংঘাতের দিকে যাত্রা শুরু হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত