Ajker Patrika

পশ্চিমা বিশ্ব এখনই কেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থার’ হুমকি দিচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৯ মে ২০২৫, ১২: ০১
গাজায় ত্রাণের জন্য ভীড় করে আছেন স্থানীয়রা। ছবি: আনাদোলু
গাজায় ত্রাণের জন্য ভীড় করে আছেন স্থানীয়রা। ছবি: আনাদোলু

গত শুক্রবার সকালেও ডিউটিতে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিলেন গাজার শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলা আল-নাজ্জার। যুদ্ধবিধ্বস্ত খান ইউনিসের আল-নাসের হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেদিনই হাসপাতালে আহত শিশুদের চিকিৎসা করার সময় তাঁর বাড়িতে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। নিহত হন তাঁর ১০ সন্তানের মধ্যে ৯ জনই।

এই হামলায় গুরুতর আহত হন তাঁর স্বামী, যিনি নিজেও চিকিৎসক। তাঁদের একমাত্র জীবিত সন্তান—১১ বছরের ছেলেটিকে তাঁর মায়ের হাসপাতালেই নিয়ে যাওয়া হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাকে বাঁচানো যায়। একই দিনে গাজার উত্তরের জাবালিয়ায় একটি পরিবারসহ ৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। ওই সময় কাছেই ছিলেন এ বছরের পুলিৎজার বিজয়ী ফিলিস্তিনি কবি ও লেখক মুস’আব আবু ত্বোয়াহা।

তিনি যে ছবি তুলেছেন, তাতে দেখা যায়—প্রায় দুই বছরের একটি শিশুর মরদেহ, যার মাথার অর্ধেকই উড়ে গেছে। এই ছবি হাজার হাজার মানুষ দেখেছে এক্সে। সেই শিশুকে কাঁধে নিয়ে উদ্ধারকর্মীরা যে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, সেটিই বলে দিচ্ছে পুরো গল্প।

এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনার পাশাপাশি গাজায় ইসরায়েলের নতুন দফার সহিংসতা এবং দীর্ঘদিনের ত্রাণ অবরোধ পরিস্থিতিকে মানবিক সংকটে পরিণত করেছে। এতে করে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তাভাবনা শুরু করেছে।

ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গত সপ্তাহে জানায়, তারা ইইউ-ইসরায়েল অ্যাসোসিয়েশন চুক্তির অনুচ্ছেদ-২ পুনর্বিবেচনা করছে। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে উঠবে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে।

এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা এক যৌথ বিবৃতিতে গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে। তারা জানিয়েছে, গাজার মানবিক দুর্ভোগ এখন ‘অসহনীয়’। সতর্ক করে বলা হয়েছে, ইসরায়েল যদি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, নেতানিয়াহুর সরকার যদি এই হামলা অব্যাহত রাখে এবং ত্রাণ সহায়তার ওপর থেকে অবরোধ না তোলে, তাহলে আরও নির্দিষ্ট এবং কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর জবাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই দেশগুলোর নেতাদের ‘হামাসকে ক্ষমতায় রাখতে চায়’ বলে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, এসব দেশ ‘গণহত্যাকারী, ধর্ষক, শিশু হত্যাকারী ও অপহরণকারীদের পক্ষ নিচ্ছে।’

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের অভূতপূর্ব হামলার জবাবে ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয় এবং ২৫০ জনের মতো জিম্মি হয়। পাল্টা হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

গত সোমবার স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলভারেজ ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার দাবি জানান। তিনি বলেন, গাজায় ত্রাণসহায়তা অবশ্যই শর্তহীনভাবে প্রবেশ করতে হবে এবং ইসরায়েল এতে বাধা দিতে পারবে না। তিনি গাজাকে আখ্যা দেন ‘মানবতার জন্য উন্মুক্ত দগদগে ঘা’ হিসেবে। তাঁর মতে, এখন নীরব থাকা মানে গণহত্যায় অংশ নেওয়া।

সৌদি আরবও দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছে। একই দিনে যুক্তরাজ্যের আট শতাধিক আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও সাবেক বিচারপতি এক খোলা চিঠিতে তাঁদের গভীর উদ্বেগ জানান। তাঁরা ব্রিটিশ সরকারকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গাই গুডউইন-গিল বলেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি নির্লজ্জ উপেক্ষা এবং এটি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, যুক্তরাজ্য চাইলে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের ওপর আর্থিক ও অভিবাসন নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। তাঁর মতে, সব ইসরায়েলির জন্য যুক্তরাজ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে ভিসা বাধ্যতামূলক করা উচিত।

তিনি বলেন, যেহেতু ইসরায়েলে অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত, তাই এদের যুদ্ধকালীন ভূমিকাও খতিয়ে দেখা দরকার। যদিও ইসরায়েল সমালোচনার জবাবে প্রায়ই ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ তকমা লাগায়, তার পরও বহু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

অধিকতর খোলামেলা সমালোচনায় এবার জড়িয়েছেন লেখক, সংগীতশিল্পী ও মানবাধিকারকর্মীরাও। বুধবার ৩৮০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এক খোলা চিঠিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।

চিঠিতে বলা হয়, ইসরায়েলের মন্ত্রী স্মতরিচ ও বেন গাভিরের বক্তব্যেই স্পষ্ট যে গাজায় তাদের উদ্দেশ্য গণহত্যা। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে এটি নিয়ে আর কোনো বিতর্ক নেই।

এর আগে ৭ মে জাতিসংঘের ৩০ জনের বেশি বিশেষ দূত ও স্বাধীন পর্যবেক্ষক গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের তীব্র নিন্দা করে বলেন, ‘রাষ্ট্রগুলো যখন গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার নিয়ে তর্ক করছে, তখন ইসরায়েল গাজায় জীবন ধ্বংস করে চলেছে।’ তাঁদের ভাষায়, কেউই রেহাই পাচ্ছে না—শিশু, প্রতিবন্ধী, মা, সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা জিম্মিরা পর্যন্ত নয়। শুধু ১৮ মার্চেই প্রায় ৬০০ ফিলিস্তিনি হতাহত হন, যাদের মধ্যে ৪০০ জনই ছিল শিশু।

বুধবারের চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা চুপ থেকে এই অপরাধকে সমর্থন করতে পারি না। এটি কেবল মানবতা ও মানবাধিকারের প্রশ্ন নয়, আমাদেরও নৈতিক দায়িত্ব।’ তবে যুক্তরাজ্য এখন পর্যন্ত শুধু কয়েকজন বসতি স্থাপনকারী নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে কিছু সংগঠনকেও, যারা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ এবং অবৈধ বসতি স্থাপনে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ আছে। এসব নিষেধাজ্ঞায় ভ্রমণ ও সম্পদ জব্দসহ কিছু বিধিনিষেধ থাকলেও, ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবে এসব ব্যক্তির যুক্তরাজ্যে কোনো সম্পদ থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।

তবে এসব পদক্ষেপের প্রতীকী গুরুত্ব অনেক। ব্রিটিশ আইনি সংস্থা পিটার্স অ্যান্ড পিটার্সের সিনিয়র পার্টনার মাইকেল ও’কেইন বলেন, ‘এটিকে আমরা বলি সিগন্যালিং। সরকার জানিয়ে দেয়, আপনার আচরণ অগ্রহণযোগ্য।’ বিশেষ করে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির ও অর্থমন্ত্রী স্মতরিচের ওপর কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার আহ্বান উঠেছে। পরিস্থিতি যেমন যাচ্ছে, এসব বাস্তবায়িত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

গত বছর সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্য সরকার গাজায় ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহে ব্যবহৃত প্রায় ৩০টি রপ্তানি লাইসেন্স স্থগিত করেছিল। এবার পরিস্থিতি আরও কঠোর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যদিও এখনো ইইউ, যুক্তরাজ্য বা কানাডার হুমকিতে ইসরায়েলের অবস্থানে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি, তবে আন্তর্জাতিক স্তরে ক্ষোভ জমে উঠেছে।

এই ক্ষোভকে কেন্দ্র করেই আগামী ১৭ জুন নিউইয়র্কে একটি ফরাসি-সৌদি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেখানে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ‘অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ’ নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হচ্ছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা অ্যান-ক্লেয়ার লেজেন্দ্রে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেলনের এক প্রস্তুতি বৈঠকে বলেন, ‘এখন সময় এসেছে মাঠের বাস্তবতা মেনে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথে এগোনোর। এটি শুধু আদর্শ নয়, এটি বাস্তবায়নের মতোই জরুরি।’

আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত