Ajker Patrika

ইন্টারনেট-দুনিয়ার একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভাঙবে কি 

ফজলুল কবির
আপডেট : ০৯ মে ২০২২, ১৭: ৩৮
ইন্টারনেট-দুনিয়ার একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভাঙবে কি 

বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে, মনের অজান্তেই হাত বা কার্সর চলে যায় স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া আইকনে। শপিং করতে বা শপিংয়ে যাওয়ার আগে বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য ই-কমার্স সাইটগুলোয় বা তেমন দক্ষ না হলে নিদেনপক্ষে গুগলে ঢুঁ মারাটা তো আজকের দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘরের মধ্যেই আস্ত সিনেমা হল ঢুকে পড়ার গল্প তো এখন পুরোনো। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব সত্যিই এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কার হাতের? নিজের হাতের দিকে না তাকিয়ে বরং সত্যিকারের হাতটি খুঁজুন। ভেবে দেখুন আদতে কতগুলো আইকনে আপনার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে না চাইতেই।

হ্যাঁ, ১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব? এক কথায় উত্তর দেওয়ার সুযোগ নেই।

একটু বুঝে নেওয়া যাক বিষয়টি। থ্রি-ডব্লিউ-এর নেতৃত্বাধীন আজকের ইন্টারনেট জমানার শুরুর সময় গণতন্ত্রবাদী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা স্তরের মানুষ বেশ আশা দেখেছিল। অনেকে তো একে একেবারে বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। বলা হচ্ছিল, তথ্য কুক্ষিগত করার চল শেষ হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে ছিল নিরাপত্তার ধোঁয়াটে বিষয়াদিও। কিন্তু এর একটিও কি দেখা গেছে? নাকি সময়ের সঙ্গে এই সবকিছুকেই মানুষ গুটিকয় কিছু করপোরেশনের হাতে বন্দী হতে দেখছে?

 বর্তমান দুনিয়ায় থ্রি-ডব্লিউ ও ইন্টারনেট আদতে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমার্থক হয়ে উঠেছে, যেখানে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্যের দুনিয়াকে বন্দী অবস্থায় আমরা দেখি। আর এটি করা হয়েছে ধীরে ও কৌশলী ধারায়। ডিজিটাল রেভল্যুশন নামে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি যে ইন্টারনেটের যাত্রা, তা আর বিপ্লব হয়ে ওঠেনি সাধারণের জন্য। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন এটি আনতে পারেনি। অথচ এর যাত্রাবিন্দুতে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা বহু মানুষ একে তাদের সম্ভাব্য হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ভেবেছিল, পুঁজির মালিক হিসেবে গুটিকয়ের যে শাসন, তাকে তারা এর মাধ্যমে ভেঙে দিতে পারবে।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরীক্ষাগার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করে ইন্টারনেট। আজ এই ইন্টারনেটই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, শিক্ষা, বিনোদন, ব্যবসা ইত্যাদির সবচেয়ে সহজ পথ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া শাসনের কাঠামোকে হটাতে পারেনি, বরং তাকে আরও কেন্দ্রীভূত করেছে। ইন্টারনেটের যাত্রা শুরুর সে সময়ে মার্কিন সমাজবিদ ডেনিয়েল বেল শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজের বদলে তথ্য-সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্নের কতটা অর্জন হয়েছে। ইউরোপের সার্ন পরীক্ষাগার থেকে বিশ্বভ্রমণে বেরোনো ইন্টারনেট এখনো তার ভ্রমণ অক্ষুণ্ন রেখেছে। তবে তা মুখ্যত করপোরেট পুঁজির হাত ধরে। তার পরনে মুক্তমত ও তথ্যের স্বাধীনতার খোলস থাকলেও ভেতরে আছে একচেটিয়াকরণের হাড়-মাংস।

এর আদলটিও অন্য যেকোনো পুঁজিবাদী কাঠামোর মেনে চলা তিনটি মূলনীতিকেই অনুসরণ করে। প্রথমত, এটি পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে আড়াল করে; দ্বিতীয়ত, গুটিকয় করপোরেট খেলোয়াড়ের জন্যই শুধু প্রতিযোগিতার ভূমিটি উন্মুক্ত রাখে এবং তৃতীয়ত, সাধারণ জনতা বলতে যাদের বোঝায়, তাদের সামনে প্রভাববলয়ে ঢোকার পথটি সম্ভাব্য সব বাধা দিয়ে আকীর্ণ করে তাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার ‘মহান আদর্শ’ মেনে চলার ফুসলানি দেয়। এটি তিন শ্রেণির মানুষের জন্য তিনটি ভিন্ন সম্ভাবনার কথা বলে।

মার্ক জাকারবার্গ

প্রথমত, এটি জ্ঞানপিপাসু শ্রেণিকে নিজের দিকে টেনে নেয়। বলা হয়, ইন্টারনেট হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগার, যেখানে এসে জড়ো হতে থাকবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো জ্ঞান। উইকিপিডিয়ার মতো উন্মুক্ত বিশ্বকোষগুলো এই সম্ভাবনার একটি বাস্তব উদাহরণ হিসেবে সামনে হাজির থাকে। সত্যিই তো, আজ যেকোনো কিছু জানার জন্য ইন্টারনেটে একটু ঢুঁ মারলেই তো চলছে। তাহলে কথা তো অসত্য নয়। 

দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা বা আশঙ্কা সামনে আনা হয়, তা হলো নিরাপত্তা। মূলত রক্ষণশীল ও সামরিক-মনস্কদের লক্ষ্য করেই এই ‘নিরাপত্তা’ কার্ডটি খেলা হয়। দক্ষ রাষ্ট্রের মতো করেই জনমানসে এই ইন্টারনেটকে একটি প্রতিরক্ষা বর্ম হিসেবে হাজির করা হয়। বলা হয়, সবকিছু ভেঙে পড়লে এই ইন্টারনেটই বিকল্প যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। আজ ইন্টারনেট একধরনের সর্বজনীন হয়ে ওঠার পর এর আবার নানা ধরনও তৈরি করা হয়েছে। গড়ে উঠছে সাইবার আর্মিও। 

আর তৃতীয় সম্ভাবনা হিসেবে ‘গণতন্ত্রের’ কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এটি মূলত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা লোকজনের জন্য এক উৎকৃষ্ট বড়ি। এই তিন সম্ভাব্যতাই আবার একটি অভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। আর তা হলো—ভয়। মুফতে পাওয়া ‘জ্ঞানকোষ’ হারানো, ‘গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব হওয়া এবং অতি অবশ্যই সামরিক ভয়। যে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এর জন্ম হয়েছিল, সেই স্নায়ুযুদ্ধ কখনোই মানুষের পিছু ছাড়েনি। আর আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এই সামরিক ভয়কে তো বাস্তব করে তুলেছে। তথ্যহীনতা বা তথ্যের প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় বা ভয় মানুষকে বিস্তর ‘অপতথ্যের’ ভয়ের দুনিয়ায় আজ নিয়ে এসেছে।

পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠার কারণেই কিনা, এরও রয়েছে পুঁজির মতোই ক্ষুধা। প্রতিনিয়তই সে নিজেকে বাড়িয়ে তুলছে। প্রবৃদ্ধির দৌড়ে কিন্তু ইন্টারনেট নিজেই হাজির। সেটা কেমন? ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতি মিনিটে ভিডিও আপলোডের পরিমাণ কততে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানেন? মিনিটে ৫০০ ঘণ্টা।

কী আছে এই প্রতি মিনিটের ৫০০ ঘণ্টা আপলোড হওয়া ভিডিওগুলোতে? তথ্য। হ্যাঁ, তথ্যই আছে। কোনটি সত্য বা কোনটি মিথ্যা, সে মীমাংসা পরে। মূল কথা হলো, তথ্য আছে এসবের মধ্যে, সে এবার সিনেমা, নাটক, মিম, কৌতুক, তথ্যচিত্র, টিউটোরিয়াল—যে আঙ্গিকেই হোক না কেন। আদতে গত ৩০ বছরের ইন্টারনেট-জীবন মানুষকে এক তথ্যের সাগরে নিয়ে এসেছে। এই তথ্যের সমুদ্রের মধ্য থেকে কোনটি সে নেবে, আর কোনটি নেবে না—তা নির্বাচন করাটা এক কঠিন বিষয় হয়ে উঠেছে। তার চেয়ে বেশি যা কঠিন হয়েছে, তা হলো মার্কিন কবি ও অ্যাকটিভিস্ট জন পেরি বারলো ঘোষিত সাইবার স্পেসের স্বাধীনতা। ১৯৯৫ সালে তিনি এই সাইবার স্পেসের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বাণিজ্যিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। ফলে বারলো ঘোষিত স্বাধীনতা যেন বলতে না-বলতেই হাতে চলে এল।

আজকের প্রযুক্তি দুনিয়ায় মহিরুহ হয়ে ওঠা চার প্রতিষ্ঠান—আমাজন, গুগল, মেটা ও অ্যাপলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে সেই ক্ষণিকের স্বাধীনতা কতটা হৃত হয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের ব্যবসায় দাঁড়ানোর পরই এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোকে কিনতে শুরু করে। কতটা? জন্মের পর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাপল মোট ১২৩টি ছোট-বড় কোম্পানিকে কিনেছে। এর মধ্যে ২৭টি ছিল নিজ ঘরানার প্রতিষ্ঠান। বাকি সবই তার জন্য নতুন ক্ষেত্র। আমাজন এ ক্ষেত্রে নিজের ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ৪০টি। আর নতুন ধারার কিনেছে ৭১টি। গুগল শুধু সার্চ ইঞ্জিনই কিনেছে ৮১টি। আর নতুন ধারার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিনেছে ১৮৭টি। এই দৌড়ে ফেসবুক বা হালের মেটা কিছুটা পিছিয়ে আছে। তারা নিজ ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ২৮টি, আর নতুন ধারার ৭৭টি। এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে অন্যদের বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করেছে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠেছে একচেটিয়া। আর নতুন ধারার প্রতিষ্ঠান কিনে তারা নিজেদের ‘অস্ত্রাগার’ সমৃদ্ধ করেছে। প্রতিটি নতুন ধারার প্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়ে তারা একইভাবে সংশ্লিষ্ট ধারায় নতুন কারও বেড়ে ওঠার পথকে রুদ্ধ করেছে।

এ তো গেল ২০২১ সাল পর্যন্ত হিসাব, যা জানাল ওয়াশিংটন পোস্ট। জেফ বেজোসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু নিজেদেরও এই মহলে ঢুকে পড়া আটকাতে পারেনি। তারা জানিয়েছে, ইন্টারনেট-দুনিয়ায় নিজেকে একচেটিয়া করে তুলতে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বেজোস যে বিনিয়োগ শুরু করেন, সে পথ ধরেই ওয়াশিংটন পোস্টও তাঁর থলিতে গিয়ে জমা হয়। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ হাজার ওয়েবসাইটের মধ্যে অর্ধেকেরই হোস্টিং অথোরিটি চলে আসে বেজোসের হাতে। সে যাক। ২০২১ সালের পর কী হলো? ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানাচ্ছে, ২০২১ সালে টেক-জায়ান্টরা অন্য কোম্পানি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। পরিমাণটা কত? ২৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার!

এগুলো যে মানুষের জীবনকে সহজ করেনি, এমন নয়। করেছে। বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে এসব প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু আলাপটি প্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে নয়; বরং এর কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে। যে তথ্যের প্রাপ্যতার জন্য মানুষ এত কিছুর সঙ্গে নিজের সমন্বয় করল, তা হাতছাড়া হওয়া নিয়ে। সাইবার স্পেসের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, কীভাবে—সে প্রশ্নটি মগজ থেকে একেবারে উধাও হওয়া নিয়েই বরং এ প্রশ্ন। মানুষ এখন চূড়ান্ত ভোক্তায় পরিণত হয়েছে। তথ্য বলতে যে নিরাকার একটি বস্তুকে মানুষ বোঝে, তা এখন নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মূল সূত্র এখন সে। অথচ এই তথ্য-দুনিয়ার নিয়ন্তারা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেকি ‘গণতন্ত্রপনা’ দিয়ে এই অস্পৃশ্য ব্যাপারটি আবার আড়াল করা যাচ্ছে সহজেই।

ইলন মাস্ক

কতটা? ইন্টারনেট বস্তুটি যে মার্কিন মুলুক থেকে যাত্রা করেছিল ধীরে ধীরে, তার অধিকর্তাদের একচেটিয়াপনা থামানোর পথ খুঁজে এখন রীতিমতো হয়রান মার্কিন আইনসভা ও বিচার বিভাগই। চিরাচরিত পুঁজির কারবারিরাও এখন এই নয়া দুনিয়ায় নিজের জায়গাটি করে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। করবেন না কেন? ২০২১ সালে অনলাইনে পণ্য বিক্রি হয়েছে কত জানেন? ৪ লাখ ২০০ কোটি ডলারের। আরেকটু হলেই তা জার্মান অর্থনীতিকে (সাড়ে ৪ লাখ কোটি ডলার) ছাড়িয়ে যেত।

মজার বিষয় হলো, এই এত এত একচেটিয়া গল্পের পরও, এত কিছু সামনে থাকার পরও, ইন্টারনেট বস্তুটি কিন্তু সামনে সটান এগিয়ে যাচ্ছে এক ‘নিরপেক্ষতার’ মুখোশ পরে। এর পেছনে এর ভেতরে থাকা সম্ভাবনার শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে কেন্দ্রে থাকা গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও। সম্ভাবনাটি হচ্ছে, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর, প্রযুক্তির মালিকানা বুঝে নেওয়ার। আর পৃষ্ঠপোষকতা? সেটা স্বয়ং রাষ্ট্রের এবং পুঁজির তো বটেই। রাষ্ট্র এটি একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আবার অক্ষতও রাখতে চায়।

একটু বুঝে নেওয়া যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর সত্যিকারের দুনিয়ায় মানুষ বিস্তর বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন কারও বাড়িতে না গিয়েও ঈদের শুভেচ্ছা জানানো যাচ্ছে, চাইলে অনলাইন সালাম ও সালামি আদান-প্রদানও চলছে হরদম। এ জন্য কারও সংস্পর্শে আসার প্রয়োজনই পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে ফিরতে অনায়াসে মোবাইল স্ক্রিনে একটি লাভ ইমো, লাইক, স্যাড ইত্যাদি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের উপস্থিতি। শুভেচ্ছাবার্তা লিখতে আলসেমি লাগলেও সমস্যা নেই, অজস্র ডিজিটাল কার্ড তৈরি আছে; খুঁজতেও হবে না। সাজেশনে আসবে, বেছে নিয়ে একটা দিলেই হলো। যাকে পাঠানো হলো, তার মানসিক পরিস্থিতি যেমন বিবেচ্য নয়, তেমনি যে পাঠাচ্ছে তারও মানসিক অবস্থা এখানে একেবারে ঊহ্য। তাহলে সয়াবিন তেল বা অন্য যেকোনো ইস্যুতে জনদুর্ভোগের বেলায় কী ঘটছে? এ সম্পর্কিত খবরের তলায় একটি অ্যাংরি ইমো বা বেশি খেপে গেলে একটা স্ট্যাটাস, একটা প্রোফাইল পিকচার বা এমন যেকোনো কিছু দিলেই দায়িত্ব চুকে গেল। এতে তেলের দাম না কমলেও, ওয়াসার পানি পরিষ্কার না হলেও, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ না হলেও এমনকি কিছুই না হলেও কাজটি কিন্তু হয়ে গেল। এবার পাশ ফিরে আরামে ঘুমানো যেতেই পারে। এমন মোক্ষম একটি প্রতিরক্ষা বর্মকে তবে রাষ্ট্র কেন হাতছাড়া করবে? মাঝেমধ্যে একটু বকে দিলেও একে রক্ষায়, একে বেড়ে উঠতে দিতে রাষ্ট্র বরং সব রকম চেষ্টা করবে। এ কারণেই মার্কিন সিনেট থেকে শুনানি শেষে মার্ক জাকারবার্গ হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে পারেন। তিনি জানেন, বিশ্বের সব সিনেটই তাঁকে পাশে চায়।

 প্রযুক্তি মোগলদের সুরক্ষায় অন্য পুঁজিপতিরাও সদা তৎপর। তারা তাদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ধসিয়ে না দিয়ে নিজেরাই একেকটি সাম্রাজ্য গড়ায় বরং মন দিচ্ছে। কারণ, এটাই পুঁজির ধর্ম। দুর্বলের সবল হয়ে ওঠায় সবলদের বিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকবে কেন? থাকার কথা নয়, নেইও। ফলে ইন্টারনেট ক্যাপিটালিজম ভাঙা নয়, বরং একে আরও দৃঢ় করতেই তারা বেশি নিবিষ্ট। উভয়েরই প্রয়োজন এক বিপুল ভোক্তা শ্রেণি। প্রচলিত পুঁজিপতিরা তাই নিজেদের পছন্দমতো একেকটি ভার্চুয়াল মিত্র খুঁজে নিয়েছে ও নিচ্ছে। যার সঙ্গে যার মিল হয় আরকি! ফলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তো বটেই একাধিক খাত মিলিয়ে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে গুগল, ফেসবুক বা মেটা, অ্যাপল, আমাজন, ইউটিউব, এয়ারবিএনবি, পেপাল, নেটফ্লিক্স, আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান। এমনকি জুড়ি খুঁজে দেওয়ার মতো বিষয়েও তৈরি হচ্ছে নানা ম্যাচমেকার প্ল্যাটফর্ম, যাদের কিছু কিছু এরই মধ্যে নিজেদের ভিত শক্ত করে একচেটিয়া বাণিজ্যের দিকেই এগোচ্ছে। 

এহেন একচেটিয়া ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বসে তাই যতই সমাজ বদল বা স্বাধীনতার গল্প ও তর্ক হোক না কেন, তা দিন শেষে পণ্য হিসেবেই বিক্রি করছে সাম্রাজ্যপতিরা। ব্যক্তি ও তার তাবৎ অনুভূতি ও ক্রিয়া আজ ভোক্তা ও পণ্যে পুনঃ পুনঃ রূপায়ণের চক্রে আবদ্ধ, যেন নিজের লেজকেই গিলে খাওয়া সেই সাপ সে। পুরাণ নয়, এ আজকের দিনের নিদারুণ বাস্তবতা।

বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে ভারত কেন বেজার

রাশিয়ার জব্দ ১৬২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইউক্রেনের জন্য কোথা থেকে অস্ত্র কেনা হবে, তা নিয়ে বিভক্ত ইইউ

মব সৃষ্টি করে নারীর টাকা-চেইন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে

পুতিন যুদ্ধ বন্ধে ‘অস্বীকৃতি জানানোয়’ রাশিয়ার ওপর ট্রাম্পের ‘প্রথম’ নিষেধাজ্ঞা

‎টঙ্গী থেকে নিখোঁজ ইমামকে পঞ্চগড়ে উদ্ধার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে ভারত কেন বেজার

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে জনমত আবারও তীব্র হচ্ছে। লালমনিরহাটে বিএনপির আয়োজনে তিস্তা বাঁচাও-কেন্দ্রিক এক বিশাল মশাল সমাবেশ হয়েছে। বাংলাদেশের তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা ভারত। কারণ, দেশটির কারণেই তিস্তা নিয়ে পানিবণ্টন চুক্তি হলেও তা কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশে তিস্তা নদী মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি বাড়তে থাকায় ভারত কেন বেজার হয়েছে, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য উইক।

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ৩৪
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

১৯ অক্টোবর নয়াদিল্লি ছিল বেশ সতর্ক অবস্থায়। সেদিন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষার্থী শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন করেন। হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, জ্বালানো হয়েছিল মশাল। তাঁদের দাবি—তিস্তা নদী মাস্টারপ্ল্যান অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাঁরা মনে করেন, এই প্রকল্প বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে এক নতুন বিপ্লব ঘটাবে।

এই বিক্ষোভ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের নানা প্রান্তে তিস্তা নিয়ে ক্ষোভ জমছে। কারণ, ভারত-বাংলাদেশের বহুদিনের পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ রয়েছে। এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে তিস্তা নদী—৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এক আন্তর্জাতিক জলধারা, যা একসময় কৃষির প্রাণস্রোত ছিল, এখন পরিণত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে।

তিস্তার উৎপত্তি পূর্ব হিমালয়ের পাওহুনরি পর্বত থেকে। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অতিক্রম করে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে প্রবেশ করে। পরে যমুনা নদীর সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। দুই দেশই তিস্তার পানি কৃষি ও সেচের কাজে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের ছয়টি উত্তরাঞ্চলীয় জেলায় কয়েক লাখ কৃষক শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতিতে ফসল ফলাতে হিমশিম খান। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইএফপিআরআই) হিসাবে, তিস্তার পানির স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন ধান হারায়।

অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা সেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গজলডোবা ব্যারাজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদী ৫৪টি। তবে তিস্তা ব্যবস্থাপনা বরাবরই দুই দেশের মধ্যে বিরোধের বিষয়। ১৯৮৩ সালে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তিতে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারতের এবং ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের ভাগে পড়ে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১ সালে নতুন একটি সমঝোতার আশা জেগেছিল, যেখানে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পানির অংশ নির্ধারণ করা হয়।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের কৃষকদের ক্ষতির আশঙ্কায় সেই চুক্তির বিরোধিতা করেন এবং আলোচনা থমকে যায়। এর পর থেকে অগ্রগতি বলতে কার্যত কিছুই হয়নি। এর ফলে ঢাকায় এমন ধারণা তৈরি হয় যে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ভারত হয় অনিচ্ছুক, নয়তো অক্ষম, যদিও তাদের রয়েছে কৌশলগত ও ভৌগোলিক সুবিধা।

বাংলাদেশের জনগণের দাবির বিপরীতে ভারত নীরব—এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তিস্তা নিয়ে চীনের সহায়তা চাইছে। ২০২৫ সালের মার্চে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিং সফরে গিয়ে চীনকে ‘পানিব্যবস্থাপনায় পারদর্শী’ বলে প্রশংসা করেন। সেখানে তিনি ৫০ বছরের তিস্তা মাস্টারপ্ল্যান হাতে পান, যা নদী পুনর্বাসন ও অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর জোর দেয়।

চীন তিস্তা প্রকল্পে ঋণ, অনুদান ও বিনিয়োগ মিলিয়ে ২১০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার ঘোষণা দেয়। যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্টে (টিআরসিএমআরপি) অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জলাধার নির্মাণ, নদী খনন, সড়ক ও স্যাটেলাইট শহর উন্নয়ন পরিকল্পনা।

এ ছাড়া দুই দেশ যৌথভাবে ইয়ারলুন সাংপো-যমুনা (বাংলাদেশে যা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নামে পরিচিত) নদীর পানিবিজ্ঞান খাতে তথ্য বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নেয়, যা নতুন দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করেছে। কারণ, এতে চীনের পানিনিয়ন্ত্রণ দক্ষিণ এশিয়ার নিম্নাঞ্চলের প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে। এর পাশাপাশি চীন বাংলাদেশের মোংলা বন্দর, চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক অঞ্চল, টেক্সটাইল, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ডিজিটাল অর্থনীতিতেও বিনিয়োগ করছে, যা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে দুই দেশের সহযোগিতাকে গভীর করছে।

ভারতের কাছে এটি কেবল পানি নয়, ‘নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির প্রশ্ন’। তিস্তা প্রকল্পের অবস্থান ভারতের কৌশলগত ‘শিলিগুড়ি করিডর’–এর কাছাকাছি, যাকে বলা হয় ‘চিকেনস নেক’। মাত্র ৬০ কিলোমিটার লম্বা ও ২২ কিলোমিটার চওড়া এই স্থলপথ ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ফলে ভারতের দৃষ্টিতে এর আশপাশে কোনো ‘বিদেশি শক্তির’ উপস্থিতি সরাসরি নিরাপত্তা ঝুঁকি।

এরই মধ্যে ভারত সরকার ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের বিশাল বাঁধ প্রকল্প নিয়েও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। তিস্তা ইস্যু সামনে আসার সময়টাও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তিস্তা ইস্যুকে কাজে লাগাতে পারে। অপর দিকে আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় অনুগত হওয়ার অভিযোগে। তিস্তার তাড়না আরও বেড়েছে ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে। সেই মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তিস্তা প্রশ্নে জাতীয় বিতর্ক এখন নতুন মাত্রা পাচ্ছে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে ভারত কেন বেজার

রাশিয়ার জব্দ ১৬২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইউক্রেনের জন্য কোথা থেকে অস্ত্র কেনা হবে, তা নিয়ে বিভক্ত ইইউ

মব সৃষ্টি করে নারীর টাকা-চেইন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে

পুতিন যুদ্ধ বন্ধে ‘অস্বীকৃতি জানানোয়’ রাশিয়ার ওপর ট্রাম্পের ‘প্রথম’ নিষেধাজ্ঞা

‎টঙ্গী থেকে নিখোঁজ ইমামকে পঞ্চগড়ে উদ্ধার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিবিসির নিবন্ধ /গাজায় পারলেও ইউক্রেনে কেন ব্যর্থ ট্রাম্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ০০
ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে পারলেও ইউক্রেনে ব্যর্থ হচ্ছেন মূলত অঞ্চলটিতে তাঁর প্রভাব বলয়ের ব্যর্থতার কারণে। ছবি: সংগৃহীত
ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে পারলেও ইউক্রেনে ব্যর্থ হচ্ছেন মূলত অঞ্চলটিতে তাঁর প্রভাব বলয়ের ব্যর্থতার কারণে। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শীর্ষ দুই নেতার আসন্ন বৈঠক নিয়ে ছড়িয়ে পড়া খবরগুলো এখন বেশ অতিরঞ্জিত বলেই মনে হচ্ছে। কয়েক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বুদাপেস্টে ‘দুই সপ্তাহের মধ্যেই’ বৈঠক করবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। দুই দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের প্রাথমিক আলোচনাও বাতিল হয়েছে।

হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি কোনো অর্থহীন বৈঠক করতে চাই না। সময় নষ্ট করতে চাই না, দেখি কী হয়।’ বৈঠক হবে কি হবে না—এই দোলাচলই যেন ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে ট্রাম্পের চেষ্টার সর্বশেষ অধ্যায়। গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি করানোর পর থেকে বিষয়টি তাঁর বিশেষ নজরে এসেছে।

গত সপ্তাহে মিসরে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি উদ্‌যাপনকালে ট্রাম্প তাঁর প্রধান কূটনৈতিক আলোচক স্টিভ উইটকফের দিকে ফিরে বলেন, ‘এবার আমাদের রাশিয়ার বিষয়টা মীমাংসা করতে হবে।’ তবে গাজা ইস্যুতে উইটকফ ও তাঁর দল যে অনুকূল পরিস্থিতি পেয়েছিলেন, তা ইউক্রেন যুদ্ধে পুনরায় সৃষ্টি করা কঠিন। চার বছর ছুঁইছুঁই সময় ধরে চলছে এই যুদ্ধ।

উইটকফের মতে, গাজা চুক্তি সম্ভব হয়েছিল মূলত ইসরায়েলের এক অপ্রত্যাশিত ভুল পদক্ষেপের কারণে। আর সেটি ছিল কাতারে হামাসের আলোচকদের ওপর হামলা। এতে যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা ক্ষুব্ধ হয়। একই সঙ্গে এই হামলা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ট্রাম্পের চাপ প্রয়োগের পথ খুলে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির পথে আগায়।

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে তাঁর প্রথম মেয়াদ থেকেই ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছেন, পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি বসতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিও বদলে দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে সমর্থন জানিয়ে আবারও সেই ঘনিষ্ঠতা দেখিয়েছেন।

ইসরায়েলিদের মধ্যে ট্রাম্প এখন নেতানিয়াহুর চেয়েও জনপ্রিয়। ফলে ইসরায়েলি নেতার ওপর তাঁর প্রভাবও অনন্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরব বিশ্বের কয়েকটি প্রধান দেশের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর কূটনৈতিক প্রভাব ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী।

কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সে ধরনের প্রভাববলয় নেই। গত ৯ মাসে তিনি পুতিন ও জেলেনস্কি—দুজনকেই কখনো চাপ, কখনো সমঝোতার মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ফল হয়নি বললেই চলে। তিনি রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু বুঝতে পেরেছেন, এই পদক্ষেপগুলো নিলে বৈশ্বিক অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে এবং যুদ্ধ আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

আলাস্কায় পুতিনকে স্বাগত জানান ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
আলাস্কায় পুতিনকে স্বাগত জানান ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে ভলোদিমির জেলেনস্কির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও দেশটিতে অস্ত্র পাঠানোও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে ইউরোপীয় মিত্রদের উদ্বেগের মুখে তিনি আবার পিছু হটেন। ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো সতর্ক করে বলেছিল, ইউক্রেনের পতন পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। মূলত সেই আশঙ্কা থেকেই ট্রাম্প পিছু হটেন।

ট্রাম্প প্রায়ই নিজের ‘চুক্তি করার দক্ষতা’ নিয়ে গর্ব করেন। দাবি করেন, সামনাসামনি বৈঠকেই তিনি সমাধান বের করে ফেলতে পারেন। কিন্তু পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে তাঁর বৈঠকগুলোর কোনোটি যুদ্ধের সমাধান এগিয়ে নেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, পুতিন হয়তো ট্রাম্পের এই ‘চুক্তির নেশা’ ও মুখোমুখি আলোচনার প্রতি বিশ্বাসকে নিজের পক্ষে ব্যবহার করছেন।

গত জুলাইয়ে পুতিন আলাস্কায় এক সম্মেলনের প্রস্তাবে রাজি হন। সে সময় মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান সিনেটরদের সমর্থিত রাশিয়ার একটি নিষেধাজ্ঞা বিলে ট্রাম্পের স্বাক্ষরের সম্ভাবনা তৈরি হয়। পরে সেই বিল স্থগিত করা হয়। গত সপ্তাহে খবর ছড়ায়, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে টমাহক ক্রুজ মিসাইল ও প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি-এয়ার মিসাইল পাঠানোর কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। আর ঠিক তখনই পুতিন ফোন করেন ট্রাম্পকে। আর ট্রাম্প ঘোষণা দেন সম্ভাব্য এক সম্মেলনের, যা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে।

পরদিন ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠক ছিল টান টান, জেলেনস্কি ফিরে যান খালি হাতে। ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেন, তাঁকে পুতিন প্রভাবিত করতে পারেননি। তাঁর ভাষায়, ‘জীবনে অনেকবার আমি সেরা চালবাজদের সঙ্গে খেলেছি, কিন্তু প্রতিবারই ভালোভাবে বেরিয়ে এসেছি।’

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প জেলেনস্কির সঙ্গে একাধিকবার উত্তপ্ত বসচায় জড়িয়ে পড়েন। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প জেলেনস্কির সঙ্গে একাধিকবার উত্তপ্ত বসচায় জড়িয়ে পড়েন। ছবি: এএফপি

তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পরে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘যে মুহূর্তে আমাদের জন্য দূরপাল্লার অস্ত্র পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে গেল, রাশিয়া প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কূটনীতিতে আগ্রহ হারাল।’

অল্প ক’দিনের মধ্যেই ট্রাম্প একের পর এক দোদুল্যমান অবস্থান প্রকাশ করেছেন। একদিকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর ভাবনা, অন্যদিকে পুতিনের সঙ্গে বুদাপেস্টে বৈঠকের পরিকল্পনা, আর ব্যক্তিগতভাবে জেলেনস্কিকে চাপ দিয়েছেন পুরো দনবাস অঞ্চল ছাড়তে। শেষ পর্যন্ত তিনি অবস্থান নিয়েছেন যুদ্ধবিরতির আহ্বানে। তাঁর প্রস্তাবিত বর্তমান যুদ্ধরেখা ধরে অস্ত্রবিরতি রাশিয়া স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

গত বছর নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করতে পারবেন। এখন তিনি সে দাবি থেকে সরে এসে স্বীকার করছেন, যুদ্ধ থামানো তাঁর কল্পনার চেয়ে অনেক কঠিন কাজ। এটা এক বিরল স্বীকারোক্তি। বিশেষ করে, নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং এক এমন শান্তির কাঠামো গড়ার জটিলতা, যেখানে কোনো পক্ষই লড়াই ছাড়তে চায় না, বা ছাড়তে পারে না—এমন অবস্থানে যুদ্ধ থামানো আসলেই কঠিন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে ভারত কেন বেজার

রাশিয়ার জব্দ ১৬২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইউক্রেনের জন্য কোথা থেকে অস্ত্র কেনা হবে, তা নিয়ে বিভক্ত ইইউ

মব সৃষ্টি করে নারীর টাকা-চেইন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে

পুতিন যুদ্ধ বন্ধে ‘অস্বীকৃতি জানানোয়’ রাশিয়ার ওপর ট্রাম্পের ‘প্রথম’ নিষেধাজ্ঞা

‎টঙ্গী থেকে নিখোঁজ ইমামকে পঞ্চগড়ে উদ্ধার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মহাকাশে ডেটা সেন্টার স্থাপনে কেন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর তোড়জোড়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ১৩
খুব শিগগিরই হয়তো ডেটা সেন্টারগুলো দুনিয়ার বুকে না থেকে মহাশূন্যে চলে যাবে। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
খুব শিগগিরই হয়তো ডেটা সেন্টারগুলো দুনিয়ার বুকে না থেকে মহাশূন্যে চলে যাবে। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অগ্রগতি ডেটা সেন্টারের চাহিদা ক্রমেই বাড়াচ্ছে। কিন্তু তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের জন্য কম্পিউটার থাকা এই গুদামের মতো জায়গাগুলোর জন্য প্রচুর জমি প্রয়োজন এবং এরা বিপুল পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে, যার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) নিঃসরণ হয়।

গোল্ডম্যান স্যাকসের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ডেটা সেন্টারের শক্তি চাহিদা ১৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। কিছু ডেটা সেন্টার নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে, আবার কিছু সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে সাইটের নিজস্ব নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন সুবিধাসহ। তবে সোলার বা উইন্ড ফার্মের মতো ক্লিন এনার্জির উৎসগুলোর জন্যও যথেষ্ট জমি প্রয়োজন।

আর তাই এখন কিছু প্রতিষ্ঠান ডেটা সেন্টারকে মহাকাশে স্থাপনের কথা ভাবছে, যাতে ব্যবহারের জন্য জমি খুঁজে পাওয়ার সমস্যা এড়ানো যায়। মহাকাশ আরও ভালো সূর্যালোক পাওয়ার সুযোগ দেয়। এ ছাড়া সেখানে মেঘের কোনো আনাগোনা নেই, রাতের অন্ধকার নেই, নেই ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে সৃষ্ট বিড়ম্বনা।

ইউরোপে এএসসিইএনডি (ASCEND) প্রকল্প মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। গত বছর ফ্রান্সের থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস, যা ইউরোপীয় কমিশনের তহবিলে ASCEND-এর সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল—দেখিয়েছে যে ডেটা সেন্টারকে মহাকাশে পাঠিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সৌরশক্তি ব্যবহার করা সম্ভব হলে ‘তথ্য হোস্টিং ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য আরও পরিবেশবান্ধব এবং সার্বভৌম সমাধান’ হতে পারে। এই বিষয়ে থ্যালিস অ্যালেনিয়া মহাকাশের হাভিয়ের রোশে বলেন, ‘তবে এটি বেশ কয়েকটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ওপর নির্ভর করবে।’

যদিও রকেট উৎক্ষেপণের সময় মোট নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড বর্তমানে বিমান শিল্পের তুলনায় খুব কম, কিন্তু রকেট বায়ুমণ্ডলের অনেক উঁচুতে দূষক পদার্থ ছাড়ে। কারণ, এই রকেটগুলো দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থানে থাকে। ASCEND-এর গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারগুলো যদি কার্যকরভাবে কার্বন নির্গমন কমাতে চায়, তবে এমন একটি লঞ্চারের বিকাশ প্রয়োজন হবে, যা বর্তমান লঞ্চারের তুলনায় তার জীবদ্দশায় ১০ গুণ কম কার্বন নির্গমন করে। কখন এমন রকেট তৈরি হবে, তা এখন স্পষ্ট নয়। স্পেসএক্স, যা ফ্যালকন লঞ্চ ভেহিকেলের ফ্লিটের মাধ্যমে রকেটের ব্যয় কমানো হয়েছে, কিন্তু এখনো পরিবেশবান্ধব নতুন রকেট ডিজাইন প্রকাশের কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি।

আবুধাবিভিত্তিক স্টার্টআপ মাদারি স্পেস থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস পরিচালিত একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাক্সিলারেটর প্রোগ্রামে সহযোগিতা করেছে। মাদারি এমন কয়েকটি কোম্পানির মধ্যে একটি, যারা প্রযুক্তিগত প্রদর্শনের জন্য ছোট কম্পিউটিং উপাদান মহাকাশে পাঠাচ্ছে।

মাদারির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শারিফ আল রোমাইসি, যিনি ইতিহাদ এয়ারওয়েজের পাইলটও, বলেছেন যে মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টার বিভিন্ন গ্রাহকের জন্য উপকারী হতে পারে, বিশেষ করে যারা পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। তিনি বলেছেন, ‘তাদের অপ্রক্রিয়াজাত পর্যবেক্ষণ তথ্য মহাকাশে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ করলে বিশ্লেষণে বিলম্ব কমবে এবং তারা সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’

তিনি আশা করছেন, ভবিষ্যতে একগাদা ডেটা স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করা হবে। যদিও সেই লক্ষ্য এখনো দূরে, তবে মাদারির প্রথম মিশন ২০২৬ সালের জন্য নির্ধারিত। তারা একটি টোস্টার ওভেনের মতো আকারের পেলোড—ডেটা স্টোরেজ ও প্রক্রিয়াকরণ উপাদান নিয়ে একটি স্যাটেলাইট পাঠাবে। এটি জাতিসংঘের আউটার স্পেস অফিসের ‘UNOOSA— Access to Space for All Initiative’-এর অংশ।

অন্যরা এরই মধ্যে উৎক্ষেপণ সম্পন্ন করেছে। গত মে মাসে চীন মহাকাশভিত্তিক কম্পিউটিং কনস্টেলেশনের জন্য ১২টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। দেশটি অন্তত ২ হাজার ৮০০টি স্যাটেলাইট পাঠাতে চায়। সেটারই প্রথম ধাপ ছিল এটি। রোমাইসি বলেন, এটি মহাকাশকে ডেটা সেন্টারের সম্ভাব্য অবস্থান হিসেবে বিবেচনা করার জন্য একটি জাগরণের ডাক। তিনি বলেন, ‘এটি এমন এক বাস্তবতা, যা ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে।’

ফ্লোরিডাভিত্তিক কোম্পানি লোনস্টার ডেটা হোল্ডিংস মার্চে জানিয়েছিল, তারা সফলভাবে চাঁদে একটি ছোট ডেটা সেন্টারের পরীক্ষা চালিয়েছে। তবে সিস্টেমটি চাঁদের আলোকিত পার্শ্বে ল্যান্ড করার পর অল্প সময়ের জন্য চালু ছিল। নভেম্বরে ওয়াশিংটনভিত্তিক স্টারক্লাউড একটি স্যাটেলাইট চালু করবে, যা এনভিডিয়ার এইচ–১০০ গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) দ্বারা সজ্জিত থাকবে। কোম্পানিটি সিএনএন-কে জানিয়েছে, এই স্যাটেলাইট কক্ষপথে সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটিং ক্ষমতার রেকর্ড গড়বে।

স্টারক্লাউডের সিইও ফিলিপ জনস্টন বলেন, ‘আমার ধারণা, ১০ বছরের মধ্যে প্রায় সব নতুন ডেটা সেন্টার মহাকাশে তৈরি করা হবে। কারণ, স্থলভিত্তিক নতুন এনার্জি প্রজেক্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে আমরা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছি।’ তিনি যোগ করেন, এর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো শূন্যে বিশাল পরিমাণ তাপ বিতরণ করা এবং উচ্চ বিকিরণ পরিবেশে চিপগুলোকে সচল রাখা।

তবু এই খাতের জন্য এখনো খুব প্রাথমিক পর্যায় এবং এমন ডেটা সেন্টার চালু করা যা পৃথিবীতে থাকা ডেটা সেন্টারগুলোর বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে খরচও একটি বড় বিষয়। কারণ, পাঠানোর খরচ নির্ভর করে পেলোডের ওজনের ওপর।

লোনস্টার স্যাটেলাইট নির্মাতা সিডাসের সঙ্গে ১২০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেছে, যাতে তারা ছয়টি ডেটা স্টোরেজ স্যাটেলাইট তৈরি ও কক্ষপথে স্থাপন এবং এর পরবর্তী সেবা দেয়। তারা পরিকল্পনা করছে, প্রথমটি ২০২৭ সালে লঞ্চ করবে। এটি হবে একটি ১৫-পেটাবাইটের সিস্টেম। চাঁদ থেকে প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকবে এটি। পরের পাঁচটি স্যাটেলাইটের প্রতিটি স্টোরেজ ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে, একই ওজন ও শক্তি চাহিদা বজায় রাখা হবে। প্রতি লঞ্চে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে, যা অনেক স্থলভিত্তিক ডেটা সেন্টারের স্টোরেজের সামগ্রিক ব্যয়ের তুলনায় খুব কম।

তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মহাশূন্যে ডেটা সেন্টারের অর্থনৈতিক দিক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ফর স্পেস রিসার্চের পরিচালক কুয়েন্টিন এ পার্কার বলেন, ‘কার্যকরভাবে ব্যয় বিশ্লেষণ করলে সত্যিই ঠিক বলা যায় না যে এই ধরনের প্রকল্প দাঁড়াবে। পৃথিবীকেন্দ্রিক এখনো অনেক সমাধান আছে এবং এগুলো সম্ভবত মহাকাশে কিছু রাখার তুলনায় অনেক সস্তা। মহাকাশে রাখার সঙ্গে অনেক সমস্যা জড়িত।’

বিপরীতে মহাকাশে ডেটা সেন্টার স্থাপনের সমর্থকেরা দাবি করেন, মহাকাশে ডেটা রাখা ডেটা সেন্টার আক্রমণ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা পাবে। তবে পার্কার বলেছেন, মহাকাশের নিজস্ব কিছু ঝুঁকি আছে—রেডিয়েশন, ভ্রাম্যমাণ মহাকাশীয় আবর্জনা এবং মানবসৃষ্ট বস্তু মহাকাশে পাঠানোর পর সেগুলো পরিষ্কার করার কোনো সমাধান না থাকা অন্যতম।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, মহাকাশে মানুষের তৈরি আবর্জনার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, কোনো সংঘর্ষ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রযুক্তি নষ্ট করতে পারে। আরও কিছু মানুষ বলছে, মহাকাশে ডেটা সেন্টারের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে এবং সোলার ফ্লেয়ারের মতো স্পেস ওয়েদার সার্ভিসকে ব্যাহত করতে পারে। এ ছাড়া বেশ কিছু দেশ ‘কাউন্টারস্পেস প্রযুক্তি’ যেমন স্যাটেলাইট জ্যামিং সিস্টেম তৈরি করছে।

পার্কারের মতে, মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারের সমর্থকেরা হয়তো ‘সুবিধাগুলো অতিরঞ্জিত করে বলছেন এবং বড় অসুবিধাগুলো উল্লেখ করছেন না।’ তবে আল রোমাইসির মতে, আমাদের পৃথিবীর বাইরে তাকানো অপরিহার্য। তিনি বলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর বিপরীত বিষয় হলো প্রযুক্তিগত স্থবিরতা। আমরা এমন একপর্যায়ে পৌঁছাব, যেখানে শুধু ডেটা সেন্টার চালানোর জন্য আমাদের সম্পদ শেষ হয়ে যাবে।’

সিএনএন থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে ভারত কেন বেজার

রাশিয়ার জব্দ ১৬২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইউক্রেনের জন্য কোথা থেকে অস্ত্র কেনা হবে, তা নিয়ে বিভক্ত ইইউ

মব সৃষ্টি করে নারীর টাকা-চেইন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে

পুতিন যুদ্ধ বন্ধে ‘অস্বীকৃতি জানানোয়’ রাশিয়ার ওপর ট্রাম্পের ‘প্রথম’ নিষেধাজ্ঞা

‎টঙ্গী থেকে নিখোঁজ ইমামকে পঞ্চগড়ে উদ্ধার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধ

সি চিন পিংয়ের পর কে হবেন চীনের নেতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: সিজিটিএন
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ছবি: সিজিটিএন

বেইজিংয়ে এ সপ্তাহে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন চীনের শীর্ষ নেতারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উত্তাল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচির বাইরে রয়েছে এমন দুটি প্রশ্ন, যা চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, অথচ কেউ উচ্চারণ করতেও সাহস পাচ্ছে না। প্রশ্নটি হলো, সি চিন পিং আর কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন? আর তিনি না থাকলে চীনকে নেতৃত্ব দেবেন কে?

টানা ১৩ বছর ধরে চীনের ক্ষমতা সি চিন পিংয়ের হাতে। এই সময়ে তিনি এমন এক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা মাও সে-তুংয়ের পর আর কেউ পারেননি। এখনো তাঁর পদত্যাগের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তবে তাঁর এই ক্ষমতা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে তা রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ বপন করতে পারে। কারণ, সির হাতে এখনো কোনো উত্তরসূরি নেই, এমনকি নেই কাউকে মনোনীত করার স্পষ্ট সময়সূচিও।

প্রতিটি বছর পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সির অনুপস্থিতিতে চীনের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও গভীর হচ্ছে। যদি তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দেয়, তবে নতুন নেতা কি সির কঠোর নীতিতেই অবিচল থাকবেন, নাকি কিছুটা নমনীয় পথে হাঁটবেন; এই প্রশ্ন এখনই ভাবাচ্ছে চীনের নীতিনির্ধারকদের।

সি চিন পিং আসলে সেই পরিচিত দোটানার মুখে; যা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা অনেক কর্তৃত্ববাদী নেতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। উত্তরসূরি মনোনয়ন মানে এক প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি করা, যা নিজের প্রভাব দুর্বল করতে পারে। আবার উত্তরসূরি নির্ধারণে বিলম্ব করলে তার উত্তরাধিকার ও দলীয় ঐক্য দুটিই বিপদের মুখে পড়তে পারে। সির বয়স এখন ৭২, অর্থাৎ সম্ভাব্য উত্তরসূরি খুঁজতে হলে তাকাতে হবে আরও তরুণ প্রজন্মের দিকে; যাদের এখনো নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে এবং সির আস্থা অর্জন করতে হবে।

যদি শেষ পর্যন্ত সি কোনো উত্তরসূরি বেছে নেন, তবে একটি বিষয় প্রায় নিশ্চিত। আর তা হলো তাঁর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। কারণ, সি একাধিকবার বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মূল কারণ ছিল ‘ভুল উত্তরসূরি বাছাই’। তাঁর মতে, সংস্কারপন্থী মিখাইল গর্বাচেভকে মনোনয়ন দিয়েই সোভিয়েত নেতৃত্ব নিজের অস্তিত্ব ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল।

গত শুক্রবারও সেই বার্তাই যেন নতুন করে উচ্চারণ করলেন সি, যখন চীনের সেনাবাহিনী ৯ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। স্পষ্টত এটি ছিল আনুগত্যহীনতার প্রতি সির ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।

এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের চায়না অ্যানালাইসিস সেন্টারের ফেলো নিল থমাস বলেন, ‘সি নিশ্চয়ই উত্তরাধিকার নির্ধারণের গুরুত্ব জানেন, কিন্তু তিনিও বোঝেন যে এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা ইঙ্গিত দিলেই নিজের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁকে ঘিরে এখনকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটগুলো হয়তো এতটাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে যে উত্তরসূরি নির্ধারণের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে।’

চীনে সি চিন পিংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা খুবই স্পর্শকাতর এবং সেন্সরশিপের আওতাভুক্ত। শুধু হাতে গোনা কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা হয়তো জানেন, তিনি নিজে এই বিষয়ে কী ভাবছেন।

কিন্তু বিদেশি কূটনীতিক, বিশ্লেষক ও বিনিয়োগকারীরা এখন চেয়ে আছেন বেইজিংয়ের চলমান চার দিনের এই বৈঠকের দিকে। উল্লেখ্য, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এই অধিবেশন শুরু হয়েছে সোমবার থেকে, যেখানে শত শত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অংশ নিচ্ছেন।

বৈঠকটি সাধারণত বেইজিংয়ে জিংসি হোটেলে গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। এবারও সেখানে আগামী পাঁচ বছরের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুমোদনের আশা করা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও উন্নত উৎপাদনে বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জনকে সি চিন পিং তাঁর প্রধান লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিকে পরাস্ত করার বিষয়ে সি ও তাঁর সহযোগীরা এখনো দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী।

গত মাসে প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটির ওপর পার্লামেন্ট সদস্যদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল বিষয় হলো সামগ্রিক সক্ষমতার প্রতিযোগিতা। শুধু নিজেদের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও সামগ্রিক জাতীয় শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করেই আমরা কৌশলগত সুবিধা অর্জন করতে পারি।’

তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, এই সপ্তাহের বৈঠকটি হতে পারত চীনের পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্বের ইঙ্গিত পাওয়ার একটি সুযোগ; যদি সি তরুণ কর্মকর্তাদের মধ্যে কাউকে আরও দৃশ্যমান ভূমিকায় আনতে চাইতেন। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, তিনি এখনই কোনো বড় পদক্ষেপ নেবেন না। অন্তত ২০২৭ সালে তাঁর সম্ভাব্য চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদ শুরু হওয়ার আগে তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম।

সি চিন পিং ভালোভাবেই জানেন, নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব কীভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে নাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, এই অভিজ্ঞতা তাঁর পারিবারিক ইতিহাসেই আছে। তাঁর বাবা, একসময়কার জ্যেষ্ঠ নেতা, মাও সে-তুংয়ের হাতে অপসারিত হয়েছিলেন। আর ১৯৮৯ সালের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সময় স্থানীয় কর্মকর্তা হিসেবে সি প্রত্যক্ষ করেছেন, কীভাবে শীর্ষ পর্যায়ের মতবিরোধ দেশকে অস্থিরতার দিকে টেনে নিয়েছিল। সেই সময় দেং সিয়াওপিং দল থেকে সাধারণ সম্পাদক ঝাও জিয়াংকে সরিয়ে দিয়ে নতুন উত্তরসূরি হিসেবে জিয়াং জেমিনকে বেছে নেন।

চায়না স্ট্র্যাটেজিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার কে. জনসন বলেন, ‘চীনের রাজবংশীয় ইতিহাস আর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান-পতনের পাঠে যিনি এতটা নিমগ্ন, তাঁর কাছে উত্তরাধিকার প্রশ্নটা নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সি জানেন, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিয়ে ভাবা তাঁর জন্য অপরিহার্য।’

তবে আপাতত সি চিন পিং নিজেই বিশ্বাস করেন, চীনের উত্থান অব্যাহত রাখতে হলে নেতৃত্ব তাঁর হাতে থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। তিনি আগের নেতা হু জিনতাওয়ের স্বেচ্ছা অবসরের নজির ভেঙে দিয়েছেন। বরং ২০১৮ সালে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদের সীমা বাতিল করেছেন। ফলে এখন তিনি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত রাষ্ট্র, দল ও সেনাবাহিনীর শীর্ষে থাকতে পারেন।

কিন্তু সি যত বছর ক্ষমতায় থাকবেন, ততই এমন একজন উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে, যিনি একই সঙ্গে কয়েক দশক ধরে শাসন করার মতো যথেষ্ট তরুণ হবেন এবং সির ছায়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মতো পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ।

সি তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়োগ দিয়েছেন পার্টির সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্র; সাত সদস্যবিশিষ্ট পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁদের সবার বয়স এখন ৬০-এর ওপরে, ফলে তাঁরা নিজেরাই উত্তরসূরি হওয়ার পথে বার্ধক্যে পড়েছেন। সি নিজে ২০০৭ সালে ৫৪ বছর বয়সে এই কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন, যা তাঁকে পরবর্তী নেতা হওয়ার অন্যতম প্রধান ইঙ্গিত দিয়েছিল।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি সান ডিয়েগোর অধ্যাপক ও চীনের অভিজাত রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ ভিক্টর সি বলেন, ‘এমনকি ২০২৭ সালের পরবর্তী কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উন্নীত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা কর্মকর্তারাও সির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য বয়সে অনেকটাই এগিয়ে। অর্থাৎ, সির পরবর্তী উত্তরসূরি হওয়ার মতো তরুণ নন।’

ভিক্টর সির মতে, যদি সি আরও একটি মেয়াদ বা তারও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকেন, তবে পরবর্তী নেতা হতে পারেন ১৯৭০-এর দশকে জন্ম নেওয়া কেউ; যিনি এখন প্রাদেশিক প্রশাসনে বা কোনো কেন্দ্রীয় দপ্তরে কাজ করছেন। তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও কমিউনিস্ট পার্টি-বিশ্লেষক ওয়াং হসিন-হসিয়েন বলেন, ‘পার্টি ইতিমধ্যে এমন কিছু তরুণ কর্মকর্তাকে উন্নীত করছে, যাদের সঙ্গে এই প্রোফাইল মেলে।’

তবে সি তরুণ কর্মকর্তাদের নিয়েও সতর্ক। তিনি বারবার বলেছেন, কর্মকর্তাদের সামান্য দুর্বলতাও সংকটের মুহূর্তে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাঁর ভাষায়, ‘একটি বাঁধে ছোট ফাটলই শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ ধস নামাতে পারে।’

অধ্যাপক ওয়াং বলেন, ‘সি অন্যদের প্রতি অত্যন্ত অবিশ্বাসী, বিশেষ করে যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। বয়স যত বাড়ছে, সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের প্রজন্মের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ততই কমে আসছে। আর বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছরগুলোতে পার্টির শীর্ষ পর্যায় আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। কারণ সি সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের পরীক্ষা করবেন, আবার অনেককে বাদও দেবেন। আর এর ফাঁকে তাঁর আশপাশের কর্মকর্তারা নিজেদের প্রভাব ও টিকে থাকার জন্য আরও তীব্র প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন।

অধ্যাপক ভিক্টর সি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি উত্তরসূরি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরও খণ্ডিত করে তুলবে। কারণ সি একক কাউকে মনোনীত করতে পারবেন না। বরং একদল সম্ভাব্য উত্তরসূরিকে বেছে নিতে হবে, আর সেটি মানেই তাঁদের মধ্যে নিচু মানের ক্ষমতার লড়াই অনিবার্য।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে ভারত কেন বেজার

রাশিয়ার জব্দ ১৬২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইউক্রেনের জন্য কোথা থেকে অস্ত্র কেনা হবে, তা নিয়ে বিভক্ত ইইউ

মব সৃষ্টি করে নারীর টাকা-চেইন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে

পুতিন যুদ্ধ বন্ধে ‘অস্বীকৃতি জানানোয়’ রাশিয়ার ওপর ট্রাম্পের ‘প্রথম’ নিষেধাজ্ঞা

‎টঙ্গী থেকে নিখোঁজ ইমামকে পঞ্চগড়ে উদ্ধার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত