Ajker Patrika

ব্রিকসের অভ্যন্তরীণ বিভেদেও যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া, জোটের ভবিষ্যৎ কী?

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৩, ১৬: ৫৮
Thumbnail image

ব্রিকস! বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট। ২২ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে শুরু হতে যাচ্ছে জোটের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া জোটের ধারাবাহিক শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে কখনোই সদস্য কোনো দেশের নেতা অনুপস্থিত থাকেননি। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো সম্মেলনে অনুপস্থিত থাকবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর বাইরেও জোটের সম্প্রসারণ প্রশ্নে মতানৈক্য রয়েছে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে। এই অবস্থায় অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এই জোটের ভবিষ্যৎ কী? 

আয়োজক দেশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার দায়িত্ব ছিল পুতিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রোম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। ফলে পুতিনের বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় রামাফোসা অনেকটা বাধ্য হয়েই পুতিনকে সম্মেলনে আসার ব্যবস্থা করতে পারছেন না। পুতিন নিজেই সম্মেলনে সশরীরে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। 

পুতিনকে জোটের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারা এবং পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বাধ্যবাধকতা পূরণ করার যে দোটানা রয়েছে, রামাফোসার তা মূলত জোটের টানাপোড়েনের একটি অংশ মাত্র। সব মিলিয়ে জোটকে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কার্যকর করে তোলা, ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং সামগ্রিকভাবে কার্যকর করে তোলার কৌশল নির্ধারণেও টানাপোড়েন রয়েছে। 

সাধারণত একটি জোট গঠিত হয় সদস্য দেশগুলোর এক বা একাধিক সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে। কিন্তু ব্রিকসের বেলায় সেটি হয়নি। বরং মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাস ২০০১ সালে বিশ্বের শীর্ষ উদীয়মান চার অর্থনীতির দেশকে বোঝাতে ব্রিক (বিআরআইসি—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) ধারণার প্রবর্তন করে। দক্ষিণ আফ্রিকা শুরুতে এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ধারণাটি গ্রহণ করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত হয় ব্রিকস। 

জোটে নাম লেখালেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বেশ কিছু গভীর মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন—ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চললেও চীন-রাশিয়ায় তা নেই। শুধু তা-ই নয়, এ দুই দেশ পশ্চিমা গণতন্ত্র ও উদারনৈতিকতার বড় সমালোচকও। ভারত, চীন ও রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিধর হলেও ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা তা নয়। আবার ব্রাজিল ও রাশিয়ার পণ্যের অন্যতম বড় গন্তব্যস্থল চীন হলেও এর বিপরীত হার খুবই সামান্য। অর্থাৎ তাদের মধ্যে বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। 

কিন্তু জোটের বাকি সদস্য দেশগুলোর মোট অর্থনীতির আকার চীনের চেয়ে অনেক ছোট। এ ছাড়া ভারত ও চীনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘাতে দুই পক্ষের ২৪ জন সেনাসদস্য নিহত হন। 

যা-ই হোক, গোল্ডম্যান স্যাস যখন ব্রিক ধারণার প্রবর্তন করেন, তার কয়েক বছর পর ২০০৬ সালে ব্যাংকটি এসব দেশে বিনিয়োগ করার জন্য একটি ইকুইটি ফান্ড খুলেছিল। কিন্তু জোট গঠিত হয়ে যাওয়ার পর ব্যাংকটি ২০১৫ সালে সেই ইকুইটি ফান্ড বন্ধ করে দেয়। গোল্ডম্যান স্যাস যেহেতু মার্কিন প্রতিষ্ঠান, ফলে এর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীতির প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে বলেই ফান্ড বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করেন অনেকে। 

একই বছর ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘এখনো কি বিশ্বের কেউ ব্রিকস নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী?’ 

কেউ আগ্রহী হোক বা না হোক, জোটের সদস্য দেশগুলোর নেতারা ঠিকই আগ্রহী। কারণ, এই জোট ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে চীনের মতো দেশের সঙ্গে লেনদেনে সুযোগ দিয়েছে। সদস্য না হলে হয়তো দেশগুলো এই সুযোগ পেত না। এমনকি উন্নয়নশীল দেশের আরেকটি জোট জি-২০ থেকেও হয়তো দেশগুলো এই সুবিধা পায়নি বা পেত না। 

আবার রাশিয়ার জন্য এই জোট নিজেকে বিশ্বের ‘একঘরে’ রাষ্ট্র হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম হাতিয়ার। আবার চীনও একসময় জোট নিরপেক্ষ দেশ বলে পরিচিত ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর সঙ্গ পাচ্ছে। চীন একসময় কোনো পক্ষাবলম্বন না করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আমলে এসে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি অনেকটাই বদলে গেছে। দেশটি এখন আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেকটাই মুখোমুখি এবং সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়েছে। 

অবশ্য কেবল চীনই নয়, এই জোটের পাঁচ সদস্যই চায় এমন একটি বহুমেরু বিশ্ব, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মাতব্বরি তুলনামূলকভাবে কম থাকবে। 

 ২০০৯ সালে প্রথমবার ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১৪ সালে জোটটি নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়াতে, পরস্পরকে সহযোগিতা করতে নিজস্ব ব্যাংক স্থাপন করে—নাম দেওয়া হয় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)। ২০২২ সাল নাগাদ সাংহাই কেন্দ্রিক এই ব্যাংকের মূলধন দাঁড়ায় ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বব্যাংকের মোট সম্পদের চেয়ে এক-দশমাংশ কম। 

এনডিবি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো বিশ্বে ডলারের আধিপত্য কমিয়ে আনা এবং যেসব দেশ এনডিবি থেকে ঋণ নেবে, তাদের নিজস্ব মুদ্রায় ঋণের অন্তত ৩০ শতাংশ সরবরাহ করা। 

এর বাইরেও এরই মধ্যে জোটটি বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর তুলনায় ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে এগিয়ে গেছে।

সবকিছু বিবেচনায়, অন্যান্য দেশও এখন ব্রিকসের সদস্য হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। ব্রিকসে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতের মতে, ডজনখানেক রাষ্ট্র ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করার কথা ভাবছে। এ প্রসঙ্গে ইরানের প্রেসিডেন্টের এক উপদেষ্টার মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ব্রিকসের সদস্য হওয়াই এখন ইরানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, তুরস্ক, ভেনেজুয়েলাও সদস্য হওয়ার লাইনে রয়েছে বলে জানা গেছে। 

বাংলাদেশ, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এরই মধ্যে জোটের ব্যাংক এনডিবির সদস্য হয়েছে। এখন দেশগুলো জোটেরও সদস্য হতে চায় বলে খবর রয়েছে। তো সব মিলিয়ে বলা যায়, যদি এসব দেশ জোটের সদস্য হয়ে যায়, তাহলে এই জোটই হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল জোট—যেখানে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করে। 

ব্রিকস জোটের টিকে থাকার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও এর বিভক্ত হওয়ার কারণও কম নয়। যার কিছু কিছু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি জোটে নতুন সদস্য নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশগুলো। রাশিয়া ও চীন যেখানে জোটের সম্প্রসারণ চায়, সেখানে ভারত ও ব্রাজিল জোটে নতুন সদস্যকে স্বাগত জানাতে নারাজ। 

গত বছরের শীর্ষ সম্মেলনেও জোটে নতুন সদস্য গ্রহণের বিষয়টি আলোচিত হয়। এমনকি কী কী শর্তে এবং প্রক্রিয়ায় সদস্য নেওয়া হবে, সে বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল বিস্তারিত। তবে সমস্যা অন্যখানে। যেমন—ইরানের মতো ঘোরতর মার্কিনবিরোধী দেশ জোটের সদস্য হলে তা জোটের ভেতরে চীনের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবের পাল্লাই ভারী করবে। প্রায় একই কারণে জোটে নতুন সদস্যকে স্বাগত জানাতে চায় রাশিয়া; যাতে করে একটি পশ্চিমাবিরোধী প্রভাব বলয় গড়ে তোলা যায়। 

একই কারণে ভারত, ব্রাজিলও চায় না জোট সম্প্রসারিত হোক। দেশ দুটি, বিশেষ করে ভারত কোনোভাবেই চায় না জোটে চীনের প্রভাবের পাল্লা ভারী হোক এবং জোট একটি যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত হোক। প্রায় একই কারণে ব্রাজিলও চায় না ব্রিকস সম্প্রসারিত হোক। 

ভারত ও ব্রাজিল গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর হওয়ায় তারা চীন-রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক জোট করলেও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাদের কোনো বৈরিতা নেই। ফলে দেশ দুটি জোট টিকিয়ে রাখতে গিয়ে একদিকে ঝুঁকে পড়বে এমন সম্ভাবনাও কম। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বৈশ্বিক দক্ষিণের ছয়টি শীর্ষস্থানীয় শক্তি: ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্ক। বৈশ্বিক দক্ষিণের এই ‘সুইং স্টেটগুলো’ সুপার পাওয়ারের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত নয়। ফলে এরা নতুন বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে গতিশীলতা তৈরি করতে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে স্বাধীন। এরা সবাই জি-২০-এর সদস্য এবং ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয়। বৈশ্বিক দক্ষিণে এই ছয় দেশ বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রবণতার জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যারোমিটার হিসেবেও কাজ করে।

এ অবস্থায় পুতিনের শারীরিক অনুপস্থিতিতে হতে যাওয়া জোহানেসবার্গ শীর্ষ সম্মেলন ব্রিকসের জন্য ভবিষ্যৎ নির্ধারণী সম্মেলনই হয়ে উঠবে।

দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ঋণের ১৩০০ কোটির এক টাকাও দেননি হলিডে ইনের মালিক

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

গণ–সমাবেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিলেন বিএনপি নেতা

হেফাজতে যুবদল নেতার মৃত্যু, সেনা ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত