অনলাইন ডেস্ক
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি সত্য খুব দুর্বলভাবে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর তা হলো—সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো চায় পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিজের করে নিতে এবং অপর পক্ষকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে দিতে। ২০১১ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দুই-তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নয়, তাদের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেই ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা।
এরপর, ২০১৬ সালের এক জরিপে প্রায় অর্ধেক ইসরায়েলি ইহুদি একমত হয়, ‘আরবদের ইসরায়েল থেকে বিতাড়িত বা স্থানান্তর করা উচিত।’ ২০০০ সালে, যখন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নিয়ে আলোচনা চলছিল, তখনকার এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৪৭ শতাংশ ইসরায়েলি ও ১০ শতাংশ ফিলিস্তিনি একমত ছিলেন, স্কুল পাঠ্যক্রমে এমন শিক্ষা থাকা উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা ‘অন্য রাষ্ট্রে’ পড়ে থাকা নিজেদের ‘পিতৃভূমির’ অংশ ছাড় দেওয়ার চিন্তা করতে শেখে।
এই তিক্ত পরিসংখ্যানগুলোই দেখায় যে কেন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এত দীর্ঘ ও জটিল হয়ে উঠেছে। কারণ, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিরা দুটি বিপরীত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশ্বাসী। তাদের ইতিহাস ও ধর্মীয় দাবিদাওয়ার ভিত্তি একই ভূমির ওপর, কিন্তু একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। শতবর্ষের সহিংসতা ও উচ্ছেদের পর যদি অনেকেই অপর পক্ষকে একেবারে মুছে ফেলতে চায়—এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মাঠে এই বাস্তবতা তো আছেই, তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান মার্কিন প্রশাসনই প্রথমবারের মতো সেই আকাঙ্ক্ষাকে প্রশমিত করার বদলে উসকে দিচ্ছে।
এই অঞ্চলে শত বছর ধরে যে সংঘাত চলছে, তা নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা রাখে মূলত মধ্যপন্থীরা। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা বাদ দিলে দেখা যায়, এই অঞ্চলের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিগুলোকে রোধ করে মূলত মাঠের বাস্তবতা, আদর্শ নয়। কারণ, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের কেউই একে অপরকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পারে না, ভয়াবহ রক্তপাত ছাড়া। আর আন্তর্জাতিক সমাজও কখনোই এমন পরিণতি মেনে নেয়নি, যেখানে একটি পক্ষ আরেক পক্ষকে পুরোপুরি হটিয়ে দেবে। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া একের পর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট চেয়েছেন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা আলোচনার টেবিলেই নিজেদের বিরোধ মেটাক।
ফিলিস্তিনে ভূখণ্ড নিয়ে আপসের যেসব প্রচেষ্টা অতীতে হয়েছে, তা একের পর এক ব্যর্থ হয়েছে। তবে এসবের প্রভাব পড়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে একপক্ষীয়ভাবে দখলের বাসনাকে কিছুটা হলেও সংযত করেছে এসব প্রচেষ্টা। এই বাস্তবতা বোঝা যায় ইসরায়েলের রক্ষণশীল রাজনীতিক মাতান কাহানার এক বক্তব্য থেকে।
২০২২ সালে পশ্চিম তীরে একটি ইসরায়েলি বসতিতে শিক্ষার্থীদের তিনি বলেছিলেন, ‘যদি এমন কোনো বোতাম থাকত, যেটা চাপলে সব আরবরা উধাও হয়ে যেত, সুইজারল্যান্ডে চলে যেত, সেখানে চমৎকার জীবন কাটাত—তাহলে আমি সেই বোতামটা চেপে দিতাম। কিন্তু কী আর করা? এমন কোনো বোতাম তো নেই। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে—এই ভূখণ্ডে আমাদের কোনো না কোনোভাবে সহাবস্থান করেই চলতে হবে।’
কাহানার এই বক্তব্য গোপনে ফাঁস হয়ে যায়। পরে কাহানাকে ক্ষমাও চাইতে হয়। তবে ঘটনাটি এক গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে। সেটি হলো—যখন কাহানার মতো সেটলারপন্থী আইনপ্রণেতাও একই মতাদর্শের শ্রোতার সামনে এ ধরনের কথা বলেন, তখন বোঝা যায়, তাঁর মতো লোকও মনে করে ‘অপর পক্ষকে’ উৎখাতের স্বপ্ন অবাস্তব।
তবে এই ধারণায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। সেদিন হামাস ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালায়। ওই হামলায় অন্তত ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়। এই ঘটনার পর ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থীরা তাদের বহুদিনের অবদমিত ইচ্ছা বাস্তবায়নের সুযোগ খুঁজে পায়।
এর আগে, ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা থেকে সব বসতি উচ্ছেদ করে এলাকা ছেড়ে দিয়েছিল ফিলিস্তিনিদের হাতে। ১৮ বছর পর, ইসরায়েলি বাহিনী যখন গাজায় পুনরায় প্রবেশ করে তখন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারে থাকা চরমপন্থীরা সেই পুরোনো ঘড়ির কাঁটা পেছনে ঘোরানোর চেষ্টা করেন এবং যাঁরা তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন, তাঁদের বিতাড়নের কৌশলে নামেন।
২০২৩ সালের শেষ দিকে ইসরায়েলি আইনপ্রণেতা লিমোর সন হার-মেলেখ ঘোষণা দেন, ‘এই যুদ্ধের একমাত্র বিজয়চিহ্ন যা আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে, তা হলো—পুরো গাজা উপত্যকায় ইহুদি বসতি স্থাপন।’ ওই বছরের নভেম্বরে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ‘গাজা উপত্যকায় ফিরে যাওয়া’ শীর্ষক এক সম্মেলনে বক্তব্য দেন। কয়েক সপ্তাহ পর মধ্য ইসরায়েলে শতাধিক রাজনৈতিক কর্মী ‘গাজায় বসতির বাস্তব প্রস্তুতি’—এই শিরোনামে আয়োজিত এক সমাবেশে অংশ নেন।
এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নেতানিয়াহুর জোটের ৬৪ আইনপ্রণেতার মধ্যে ১৫ জন যোগ দেন জেরুজালেমে আয়োজিত আরও বড় এক সমাবেশে। সেখানে বক্তারা প্রকাশ্যে ‘গাজাবাসীদের স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ’—নামে পরিচিত একটি ধারণার পক্ষে মত দেন, যা কার্যত জাতিগত নিধনেরই আরেক নাম।
তবে জনমত বলছে, গাজা পুনর্বাসন বা এর দখল নেওয়ার পক্ষে নেই বেশির ভাগ ইসরায়েলি। এমনকি যেসব ইসরায়েলি ভবিষ্যতে গোটা ভূমি শাসনের স্বপ্ন দেখে, তাদেরও অনেকেই বাস্তবে হামাসের বিরুদ্ধে স্থায়ী সামরিক দখল বজায় রাখার কথা ভেবে পিছিয়ে যায়।
কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখন নির্ভর করছেন সেই সংখ্যালঘু কট্টর ডানপন্থীদের ওপর, যারা গাজা দখল ও বসতি স্থাপনের পক্ষেই জোরালো দাবি জানাচ্ছে। ২০২২ সালের শেষ জাতীয় নির্বাচনে নেতানিয়াহুর জোট মোট ভোটের মাত্র ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ পায়। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে দলগুলোর ওপর নির্ভর করছেন, সেগুলোর অধিকাংশই প্রকাশ্যেই আরববিদ্বেষী ও চরম ডানপন্থী। এ অবস্থায় নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগে চলমান বিচারের মুখোমুখি থাকায় নিজের অবস্থান রক্ষায় এসব চরমপন্থীদের প্রভাবের বাইরে যেতে পারছেন না।
এই বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও অনুধাবন করেছেন। তাই তাঁর প্রশাসন একযোগে প্রকাশ্য ও গোপন চাপ প্রয়োগের কৌশল নেয়, যেন নেতানিয়াহু চরম ডানপন্থী মিত্রদের দাবি মানতে বাধ্য না হন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা বারবার স্পষ্ট, ধারাবাহিক ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে আসছি, গাজা ফিলিস্তিনিদের ভূমি, এটি ফিলিস্তিনিদেরই ভূমি হয়ে থাকবে।’ মিলার নেতানিয়াহুর দুই মন্ত্রীর ‘উসকানিমূলক ও দায়িত্বহীন’ মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন। ওই দুই মন্ত্রী গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের ‘দেশত্যাগ’ উৎসাহিত করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মধ্যপ্রাচ্যে উড়ে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্রদের আশ্বস্ত করেন, ওয়াশিংটন গাজা থেকে জোরপূর্বক স্থানান্তরের বিরোধিতা করে। কাতারের দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের ঘরে ফেরার সুযোগ দিতে হবে। তাদের গাজা ছাড়তে চাপ দেওয়া চলবে না, দেওয়া উচিতও নয়।’
দোহা সফর শেষে ব্লিঙ্কেন ইসরায়েল যান এবং সেখানেও নেতানিয়াহুকে একই বার্তা দেন বলে জানা গেছে। পরদিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘ইসরায়েলের গাজা দখল বা সেখানকার জনগণকে জোর করে সরিয়ে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় নেই।’ সে সময় নেতানিয়াহুর দলের এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেছেন।’ বাইডেন প্রশাসনের তৎপরতায় আপাতত চরমপন্থী অবস্থানকে কিছুটা হলেও পেছনে সরিয়ে রাখা গেছে।
কিন্তু ট্রাম্প পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। ট্রাম্পের জয়ের দিনে নেতানিয়াহু তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তকে বরখাস্ত করেন। গ্যালান্ত গাজাকে ইসরায়েলি দখলে নিয়ে এর পুনর্বাসন পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছিলেন। মূলত, গাজাকে ফিলিস্তিনিদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি না হওয়ায় নেতানিয়াহুর সমালোচনা করে গ্যালান্ত। এভাবেই একদিনেই গাজা দখলের পথে বাইরের (বাইডেন) এবং ভেতরের (গ্যালান্ত) প্রধান প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায় নেতানিয়াহুর সামনে। এরপর, নেতানিয়াহুর ওপর গাজা দখলের চাপ আরও বাড়তে থাকে কট্টর ডানপন্থীদের দিক থেকে এবং এরপর ট্রাম্প নিজেও যেন সেই চাপে শামিল হয়ে যান।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে নেতানিয়াহুর পাশে বসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের গৃহীত উদ্যোগকে নাটকীয়ভাবে বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি গাজা দখলের ঘোষণা দেন, সেখানে বসবাসকারীদের স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন এবং গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরায়’ পরিণত করার পরিকল্পনা জানান।
এই ভাবনাটি হয়তো ট্রাম্পের মনে ভুলভাবে গঠিত একধরনের সহানুভূতি থেকেই এসেছে। তিনি হয়তো ভেবেছেন—ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি উন্নত ভবিষ্যৎ এনে দিতে পারে। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য যা–ই হোক, এই প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে অনেক ইসরায়েলির কাছে তাদের বহুদিনের ‘সর্বোচ্চ লক্ষ্য’ বাস্তবায়নের ইঙ্গিত হিসেবে গৃহীত হয়। কট্টর ডানপন্থী ইসরায়েলিদের কাছে এটি রীতিমতো ‘জাতিগত নির্মূলীকরণের’ বৈধ অনুমতি হিসেবে দেখা দেয়। একসময় যা ছিল অলীক কল্পনা, ট্রাম্পের ঘোষণার মাধ্যমে তা বাস্তব পরিকল্পনায় রূপ নেয় এবং পরিণত হয় সংঘাত শেষ করার পথে এক বড় বাধায়।
এরপর মে মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই হবে। গত সপ্তাহে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মহাপরিচালক ওয়াশিংটন সফর করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এই সফরে তিনি ‘স্বেচ্ছায়’ ‘লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে’ তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তরের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যেই গাজায় খাদ্যসংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিরা এখনো মুক্তি পায়নি।
ফলে যুদ্ধ শেষ করার পরিবর্তে ট্রাম্পের এই প্রস্তাব এখন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দিন না প্রেসিডেন্ট নিজে গাজাবাসীকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যের বিরোধিতা করে স্পষ্টভাবে অবস্থান নেন, তত দিন এই পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তাঁর যেকোনো উদ্যোগের অন্তরায় হয়ে থাকবে।
হামাস তারা নিশ্চিন্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের অজেয় যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না গাজার শেষ নাগরিকটিও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নেতানিয়াহু তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যা করা প্রয়োজন করেন, তা–ই করে যাবেন। তিনি চরম ডানপন্থীদের সন্তুষ্ট রাখতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন, যুদ্ধ শেষ করার চেয়ে তাদের লক্ষ্য পূরণই হবে প্রধান কাজ। অথচ ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন মুখে অন্তত এ ধরনের পরিণতি চান না।
ট্রাম্প বহুদিন তাঁর ‘রিভেরা’ পরিকল্পনার কথা বলেননি। বরং এখন তিনি ইসরায়েলকে সমঝোতায় যেতে চাপ দিচ্ছেন। গত ২৯ জুন ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘গাজায় চুক্তি করো। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনো!’ হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট সোমবার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের এই দীর্ঘমেয়াদি ও বর্তমানে গাজায় বিশেষভাবে নৃশংস হয়ে ওঠা সংঘাত নিয়ে প্রেসিডেন্টের বার্তা পরিষ্কার—তিনি চান হত্যা বন্ধ হোক, যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শান্তিচুক্তির পথ তৈরি হোক এবং সব জিম্মি যেন গাজা থেকে মুক্তি পায়।’
তবে সত্যি বলতে, প্রেসিডেন্টের বার্তা স্পষ্ট নয়। এটি পরস্পরবিরোধী। আর এটাই এখন মূল সমস্যা। এ সপ্তাহেই ট্রাম্প তাঁর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে পাঠিয়েছেন বিদেশ সফরে, সমঝোতা চুক্তির আশায়। কিন্তু যদি এই প্রশাসন শুধু আরেকটি সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে থেমে না থেকে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে এগোতে চায়, তাহলে অবশ্যই ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনৈতিক স্বপ্ন—গাজা তো বটেই, এমনকি পশ্চিম তীর জয়ের চিন্তাকেও—আর উৎসাহ দেওয়া যাবে না। দুই পক্ষই যে এখানেই থাকবে এবং কোনো একচেটিয়া দাবিই যে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে।
নেতানিয়াহু হয়তো চরমপন্থীদের খুশি রাখতে চাইবেন, কিন্তু তাঁর জোট এখন ভাঙনের পথে। ২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সমর্থন হারান, সেটি তাঁর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। তাই ট্রাম্প যেটিই বলেন, ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে, সেই নির্দেশই মানতে বাধ্য হবেন নেতানিয়াহু।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথার ওজন আছে। গাজা নিয়ে ‘গাজা-এ-লাগো’ ধরনের হস্তক্ষেপ করে ট্রাম্প যেমন একটি টেকসই যুদ্ধবিরতি বা মধ্যপ্রাচ্য শান্তির পথ কঠিন করে তুলেছেন, তেমনি তিনিই চাইলে তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল থেকে বেরিয়ে এসে পরিস্থিতি উল্টেও দিতে পারেন—যদি সত্যিই তা করার সদিচ্ছা থাকে।
দ্য আটলান্টিক থেকে অনুবাদ করেছে আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি সত্য খুব দুর্বলভাবে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর তা হলো—সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো চায় পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিজের করে নিতে এবং অপর পক্ষকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে দিতে। ২০১১ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দুই-তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নয়, তাদের প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত, সেই ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা।
এরপর, ২০১৬ সালের এক জরিপে প্রায় অর্ধেক ইসরায়েলি ইহুদি একমত হয়, ‘আরবদের ইসরায়েল থেকে বিতাড়িত বা স্থানান্তর করা উচিত।’ ২০০০ সালে, যখন দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নিয়ে আলোচনা চলছিল, তখনকার এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৪৭ শতাংশ ইসরায়েলি ও ১০ শতাংশ ফিলিস্তিনি একমত ছিলেন, স্কুল পাঠ্যক্রমে এমন শিক্ষা থাকা উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা ‘অন্য রাষ্ট্রে’ পড়ে থাকা নিজেদের ‘পিতৃভূমির’ অংশ ছাড় দেওয়ার চিন্তা করতে শেখে।
এই তিক্ত পরিসংখ্যানগুলোই দেখায় যে কেন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এত দীর্ঘ ও জটিল হয়ে উঠেছে। কারণ, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিরা দুটি বিপরীত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশ্বাসী। তাদের ইতিহাস ও ধর্মীয় দাবিদাওয়ার ভিত্তি একই ভূমির ওপর, কিন্তু একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। শতবর্ষের সহিংসতা ও উচ্ছেদের পর যদি অনেকেই অপর পক্ষকে একেবারে মুছে ফেলতে চায়—এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মাঠে এই বাস্তবতা তো আছেই, তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান মার্কিন প্রশাসনই প্রথমবারের মতো সেই আকাঙ্ক্ষাকে প্রশমিত করার বদলে উসকে দিচ্ছে।
এই অঞ্চলে শত বছর ধরে যে সংঘাত চলছে, তা নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা রাখে মূলত মধ্যপন্থীরা। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা বাদ দিলে দেখা যায়, এই অঞ্চলের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিগুলোকে রোধ করে মূলত মাঠের বাস্তবতা, আদর্শ নয়। কারণ, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের কেউই একে অপরকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পারে না, ভয়াবহ রক্তপাত ছাড়া। আর আন্তর্জাতিক সমাজও কখনোই এমন পরিণতি মেনে নেয়নি, যেখানে একটি পক্ষ আরেক পক্ষকে পুরোপুরি হটিয়ে দেবে। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া একের পর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট চেয়েছেন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা আলোচনার টেবিলেই নিজেদের বিরোধ মেটাক।
ফিলিস্তিনে ভূখণ্ড নিয়ে আপসের যেসব প্রচেষ্টা অতীতে হয়েছে, তা একের পর এক ব্যর্থ হয়েছে। তবে এসবের প্রভাব পড়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে একপক্ষীয়ভাবে দখলের বাসনাকে কিছুটা হলেও সংযত করেছে এসব প্রচেষ্টা। এই বাস্তবতা বোঝা যায় ইসরায়েলের রক্ষণশীল রাজনীতিক মাতান কাহানার এক বক্তব্য থেকে।
২০২২ সালে পশ্চিম তীরে একটি ইসরায়েলি বসতিতে শিক্ষার্থীদের তিনি বলেছিলেন, ‘যদি এমন কোনো বোতাম থাকত, যেটা চাপলে সব আরবরা উধাও হয়ে যেত, সুইজারল্যান্ডে চলে যেত, সেখানে চমৎকার জীবন কাটাত—তাহলে আমি সেই বোতামটা চেপে দিতাম। কিন্তু কী আর করা? এমন কোনো বোতাম তো নেই। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে—এই ভূখণ্ডে আমাদের কোনো না কোনোভাবে সহাবস্থান করেই চলতে হবে।’
কাহানার এই বক্তব্য গোপনে ফাঁস হয়ে যায়। পরে কাহানাকে ক্ষমাও চাইতে হয়। তবে ঘটনাটি এক গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে। সেটি হলো—যখন কাহানার মতো সেটলারপন্থী আইনপ্রণেতাও একই মতাদর্শের শ্রোতার সামনে এ ধরনের কথা বলেন, তখন বোঝা যায়, তাঁর মতো লোকও মনে করে ‘অপর পক্ষকে’ উৎখাতের স্বপ্ন অবাস্তব।
তবে এই ধারণায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। সেদিন হামাস ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালায়। ওই হামলায় অন্তত ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়। এই ঘটনার পর ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থীরা তাদের বহুদিনের অবদমিত ইচ্ছা বাস্তবায়নের সুযোগ খুঁজে পায়।
এর আগে, ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা থেকে সব বসতি উচ্ছেদ করে এলাকা ছেড়ে দিয়েছিল ফিলিস্তিনিদের হাতে। ১৮ বছর পর, ইসরায়েলি বাহিনী যখন গাজায় পুনরায় প্রবেশ করে তখন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারে থাকা চরমপন্থীরা সেই পুরোনো ঘড়ির কাঁটা পেছনে ঘোরানোর চেষ্টা করেন এবং যাঁরা তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন, তাঁদের বিতাড়নের কৌশলে নামেন।
২০২৩ সালের শেষ দিকে ইসরায়েলি আইনপ্রণেতা লিমোর সন হার-মেলেখ ঘোষণা দেন, ‘এই যুদ্ধের একমাত্র বিজয়চিহ্ন যা আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে, তা হলো—পুরো গাজা উপত্যকায় ইহুদি বসতি স্থাপন।’ ওই বছরের নভেম্বরে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ‘গাজা উপত্যকায় ফিরে যাওয়া’ শীর্ষক এক সম্মেলনে বক্তব্য দেন। কয়েক সপ্তাহ পর মধ্য ইসরায়েলে শতাধিক রাজনৈতিক কর্মী ‘গাজায় বসতির বাস্তব প্রস্তুতি’—এই শিরোনামে আয়োজিত এক সমাবেশে অংশ নেন।
এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নেতানিয়াহুর জোটের ৬৪ আইনপ্রণেতার মধ্যে ১৫ জন যোগ দেন জেরুজালেমে আয়োজিত আরও বড় এক সমাবেশে। সেখানে বক্তারা প্রকাশ্যে ‘গাজাবাসীদের স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ’—নামে পরিচিত একটি ধারণার পক্ষে মত দেন, যা কার্যত জাতিগত নিধনেরই আরেক নাম।
তবে জনমত বলছে, গাজা পুনর্বাসন বা এর দখল নেওয়ার পক্ষে নেই বেশির ভাগ ইসরায়েলি। এমনকি যেসব ইসরায়েলি ভবিষ্যতে গোটা ভূমি শাসনের স্বপ্ন দেখে, তাদেরও অনেকেই বাস্তবে হামাসের বিরুদ্ধে স্থায়ী সামরিক দখল বজায় রাখার কথা ভেবে পিছিয়ে যায়।
কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখন নির্ভর করছেন সেই সংখ্যালঘু কট্টর ডানপন্থীদের ওপর, যারা গাজা দখল ও বসতি স্থাপনের পক্ষেই জোরালো দাবি জানাচ্ছে। ২০২২ সালের শেষ জাতীয় নির্বাচনে নেতানিয়াহুর জোট মোট ভোটের মাত্র ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ পায়। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে দলগুলোর ওপর নির্ভর করছেন, সেগুলোর অধিকাংশই প্রকাশ্যেই আরববিদ্বেষী ও চরম ডানপন্থী। এ অবস্থায় নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগে চলমান বিচারের মুখোমুখি থাকায় নিজের অবস্থান রক্ষায় এসব চরমপন্থীদের প্রভাবের বাইরে যেতে পারছেন না।
এই বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও অনুধাবন করেছেন। তাই তাঁর প্রশাসন একযোগে প্রকাশ্য ও গোপন চাপ প্রয়োগের কৌশল নেয়, যেন নেতানিয়াহু চরম ডানপন্থী মিত্রদের দাবি মানতে বাধ্য না হন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা বারবার স্পষ্ট, ধারাবাহিক ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে আসছি, গাজা ফিলিস্তিনিদের ভূমি, এটি ফিলিস্তিনিদেরই ভূমি হয়ে থাকবে।’ মিলার নেতানিয়াহুর দুই মন্ত্রীর ‘উসকানিমূলক ও দায়িত্বহীন’ মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন। ওই দুই মন্ত্রী গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের ‘দেশত্যাগ’ উৎসাহিত করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মধ্যপ্রাচ্যে উড়ে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্রদের আশ্বস্ত করেন, ওয়াশিংটন গাজা থেকে জোরপূর্বক স্থানান্তরের বিরোধিতা করে। কাতারের দোহায় এক সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের ঘরে ফেরার সুযোগ দিতে হবে। তাদের গাজা ছাড়তে চাপ দেওয়া চলবে না, দেওয়া উচিতও নয়।’
দোহা সফর শেষে ব্লিঙ্কেন ইসরায়েল যান এবং সেখানেও নেতানিয়াহুকে একই বার্তা দেন বলে জানা গেছে। পরদিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘ইসরায়েলের গাজা দখল বা সেখানকার জনগণকে জোর করে সরিয়ে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় নেই।’ সে সময় নেতানিয়াহুর দলের এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেছেন।’ বাইডেন প্রশাসনের তৎপরতায় আপাতত চরমপন্থী অবস্থানকে কিছুটা হলেও পেছনে সরিয়ে রাখা গেছে।
কিন্তু ট্রাম্প পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। ট্রাম্পের জয়ের দিনে নেতানিয়াহু তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তকে বরখাস্ত করেন। গ্যালান্ত গাজাকে ইসরায়েলি দখলে নিয়ে এর পুনর্বাসন পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছিলেন। মূলত, গাজাকে ফিলিস্তিনিদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি না হওয়ায় নেতানিয়াহুর সমালোচনা করে গ্যালান্ত। এভাবেই একদিনেই গাজা দখলের পথে বাইরের (বাইডেন) এবং ভেতরের (গ্যালান্ত) প্রধান প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায় নেতানিয়াহুর সামনে। এরপর, নেতানিয়াহুর ওপর গাজা দখলের চাপ আরও বাড়তে থাকে কট্টর ডানপন্থীদের দিক থেকে এবং এরপর ট্রাম্প নিজেও যেন সেই চাপে শামিল হয়ে যান।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে নেতানিয়াহুর পাশে বসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের গৃহীত উদ্যোগকে নাটকীয়ভাবে বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি গাজা দখলের ঘোষণা দেন, সেখানে বসবাসকারীদের স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন এবং গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরায়’ পরিণত করার পরিকল্পনা জানান।
এই ভাবনাটি হয়তো ট্রাম্পের মনে ভুলভাবে গঠিত একধরনের সহানুভূতি থেকেই এসেছে। তিনি হয়তো ভেবেছেন—ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি উন্নত ভবিষ্যৎ এনে দিতে পারে। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য যা–ই হোক, এই প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে অনেক ইসরায়েলির কাছে তাদের বহুদিনের ‘সর্বোচ্চ লক্ষ্য’ বাস্তবায়নের ইঙ্গিত হিসেবে গৃহীত হয়। কট্টর ডানপন্থী ইসরায়েলিদের কাছে এটি রীতিমতো ‘জাতিগত নির্মূলীকরণের’ বৈধ অনুমতি হিসেবে দেখা দেয়। একসময় যা ছিল অলীক কল্পনা, ট্রাম্পের ঘোষণার মাধ্যমে তা বাস্তব পরিকল্পনায় রূপ নেয় এবং পরিণত হয় সংঘাত শেষ করার পথে এক বড় বাধায়।
এরপর মে মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই হবে। গত সপ্তাহে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মহাপরিচালক ওয়াশিংটন সফর করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এই সফরে তিনি ‘স্বেচ্ছায়’ ‘লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে’ তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তরের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যেই গাজায় খাদ্যসংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিরা এখনো মুক্তি পায়নি।
ফলে যুদ্ধ শেষ করার পরিবর্তে ট্রাম্পের এই প্রস্তাব এখন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দিন না প্রেসিডেন্ট নিজে গাজাবাসীকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যের বিরোধিতা করে স্পষ্টভাবে অবস্থান নেন, তত দিন এই পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তাঁর যেকোনো উদ্যোগের অন্তরায় হয়ে থাকবে।
হামাস তারা নিশ্চিন্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের অজেয় যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না গাজার শেষ নাগরিকটিও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নেতানিয়াহু তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যা করা প্রয়োজন করেন, তা–ই করে যাবেন। তিনি চরম ডানপন্থীদের সন্তুষ্ট রাখতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন, যুদ্ধ শেষ করার চেয়ে তাদের লক্ষ্য পূরণই হবে প্রধান কাজ। অথচ ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন মুখে অন্তত এ ধরনের পরিণতি চান না।
ট্রাম্প বহুদিন তাঁর ‘রিভেরা’ পরিকল্পনার কথা বলেননি। বরং এখন তিনি ইসরায়েলকে সমঝোতায় যেতে চাপ দিচ্ছেন। গত ২৯ জুন ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘গাজায় চুক্তি করো। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনো!’ হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট সোমবার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের এই দীর্ঘমেয়াদি ও বর্তমানে গাজায় বিশেষভাবে নৃশংস হয়ে ওঠা সংঘাত নিয়ে প্রেসিডেন্টের বার্তা পরিষ্কার—তিনি চান হত্যা বন্ধ হোক, যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শান্তিচুক্তির পথ তৈরি হোক এবং সব জিম্মি যেন গাজা থেকে মুক্তি পায়।’
তবে সত্যি বলতে, প্রেসিডেন্টের বার্তা স্পষ্ট নয়। এটি পরস্পরবিরোধী। আর এটাই এখন মূল সমস্যা। এ সপ্তাহেই ট্রাম্প তাঁর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে পাঠিয়েছেন বিদেশ সফরে, সমঝোতা চুক্তির আশায়। কিন্তু যদি এই প্রশাসন শুধু আরেকটি সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে থেমে না থেকে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে এগোতে চায়, তাহলে অবশ্যই ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনৈতিক স্বপ্ন—গাজা তো বটেই, এমনকি পশ্চিম তীর জয়ের চিন্তাকেও—আর উৎসাহ দেওয়া যাবে না। দুই পক্ষই যে এখানেই থাকবে এবং কোনো একচেটিয়া দাবিই যে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে।
নেতানিয়াহু হয়তো চরমপন্থীদের খুশি রাখতে চাইবেন, কিন্তু তাঁর জোট এখন ভাঙনের পথে। ২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সমর্থন হারান, সেটি তাঁর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। তাই ট্রাম্প যেটিই বলেন, ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে, সেই নির্দেশই মানতে বাধ্য হবেন নেতানিয়াহু।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথার ওজন আছে। গাজা নিয়ে ‘গাজা-এ-লাগো’ ধরনের হস্তক্ষেপ করে ট্রাম্প যেমন একটি টেকসই যুদ্ধবিরতি বা মধ্যপ্রাচ্য শান্তির পথ কঠিন করে তুলেছেন, তেমনি তিনিই চাইলে তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল থেকে বেরিয়ে এসে পরিস্থিতি উল্টেও দিতে পারেন—যদি সত্যিই তা করার সদিচ্ছা থাকে।
দ্য আটলান্টিক থেকে অনুবাদ করেছে আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান।
ফ্রান্স ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায় ও স্থায়ী শান্তির পক্ষে। মাখোঁ নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের পোস্টে এই অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায়সংগত ও টেকসই শান্তির প্রতি ফ্রান্সের ঐতিহাসিক অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফ্রান্স
১ ঘণ্টা আগেগত জুনে ইসরায়েলি শহরগুলোতে একের পর এক আঘাত হানে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এ সময় ইসরায়েলের টার্মিনাল হাই অ্যালটিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) ইন্টারসেপ্টরের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এই সংকট মুহূর্তে এগিয়ে আসে মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য সৌদি আরবকে ইন্টারসেপ্টর সরবরাহ
৭ ঘণ্টা আগেদুই দেশের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয় ২০০৮ সালে। আন্তর্জাতিকভাবে ওই ৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার এলাকা ‘বিরোধপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে পরিচিত। মূলত দুটি মন্দিরের মালিকানা নিয়ে বিরোধ দুই দেশের। ২০০৮ সালে ওই দুই মন্দিরের একটিকে (প্রিয়াহ ভিহিয়ার) বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে ইউনেসকোর কাছে আবেদন করে কম্বোডিয়া
১ দিন আগেদ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানকে নিজেদের মতবাদ অনুযায়ী পুনর্গঠনের পথে এগোতে শুরু করে তালেবান। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে—চিকিৎসা কেন্দ্র, কারাগার, সামরিক ঘাঁটি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কট্টর ইসলামি আদর্শে গড়ে তোলা।
২ দিন আগে