Ajker Patrika

ইউক্রেন যুদ্ধের ‘আফগানাইজেশন’ এড়ানোর কৌশলে রাশিয়া

আব্দুর রহমান
আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২২, ০০: ১৬
ইউক্রেন যুদ্ধের ‘আফগানাইজেশন’ এড়ানোর কৌশলে রাশিয়া

ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নিচ্ছে তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। রাশিয়া ইউক্রেনে তার কথিত ‘বিশেষ অভিযানের’ দৃষ্টি এবং সীমা উভয়ই নিবদ্ধ করেছে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে। যেখানে দনবাস, দনেৎস্ক, লুহানস্ক এবং মারিউপোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো রয়েছে। সর্বশেষ, রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও এর নিকটবর্তী চেরনিহিভের আশপাশ থেকে সৈন্য অপসারণ করবে। ঘোষণা অনুযায়ী এরই মধ্যে অপসারণ শুরুও হয়ে গেছে। কিন্তু ইউক্রেন জয় করা ছাড়াই রাশিয়ার রণকৌশলে হঠাৎ এমন পরিবর্তন বিশ্লেষকদের মনে নতুন প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে। 

বিশ্লেষকদের ধারণা, রাশিয়া একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিকর যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চায়। কারণ দেশটি এরই মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের নানাবিধ অবরোধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। এমতাবস্থায় একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কেবল রাষ্ট্রনেতা হিসেবে পুতিনের জন্যই নয় রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার জন্যও আত্মঘাতী হয়ে উঠবে। ফলে রাশিয়ার জন্য বিকল্প পথ খুঁজে দেখাটা বাধ্যতামূলক। যদিও রুশ জেনারেলদের ঘোষণা অনুসারে এই পথেই যুদ্ধ এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। গত ২৬ মার্চ রুশ সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের প্রধান ডেপুটি চিফ কর্নেল জেনারেল সের্গেই রুদস্কয় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক পরিকল্পনার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের পরবর্তী প্রাথমিক লক্ষ্য পূর্ব ইউক্রেন।’ ফলে, এখন যখন রাশিয়া কিয়েভ এবং তার আশপাশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করার ঘোষণা দেয়, তখন এটি বলা যেতেই পারে যে—রাশিয়া সম্ভবত যুদ্ধকে এভাবেই এগিয়ে নিতে চেয়েছে। 

কিন্তু কেন সমগ্র ইউক্রেন জয় না করেই, এমনকি রাজধানী কিয়েভের পতন না ঘটিয়েই রাশিয়া এত কাছে এসে ফিরে যাচ্ছে? এর জবাব রয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মাইখিলো পোদোলিয়াকের মন্তব্যে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএনের একটি প্রতিবেদনে পোদোলিয়াকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের মিত্রদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে—তারা ইউক্রেন যুদ্ধের যে “আফগানাইজেশন” চায় এবং সেই প্রক্রিয়ায় রাশিয়াকে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ক্লান্তিকর যুদ্ধে জড়িয়ে রাখতে চায় তা কখনোই ঘটবে না। বরং রাশিয়া দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেন ছাড়া ইউক্রেনের সব অঞ্চল ছেড়ে দেবে এবং সেখানে মাইন পুঁতে রাখবে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করবে।’ 
 
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মাইখিলো পোদোলিয়াক। পোদোলিয়াক গত শতকের আশির দশকে রাশিয়া কর্তৃক আফগানিস্তান আক্রমণের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আফগানাইজেশন হলো সেই প্রক্রিয়া—যার মাধ্যমে আফগান গেরিলারা রুশ বাহিনীকে বছরের পর বছর ধরে ঠেকিয়ে রেখে দুর্বল করে দিয়েছিল। আমাদের কতিপয় অংশীজন বিশ্বাস করতে চায় যে—ইউক্রেনেও একইরকম কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু রাশিয়া অন্য কিছুই মনে করে। তারা পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেখানে কঠোর পরিস্থিতির নির্দেশ দিচ্ছে।’ 

তবে বিশ্লেষকদের অনুমান, এই যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতার দুর্বলতা অনেকটাই উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বৈদেশিক নীতিবিষয়ক ম্যাগাজিন ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত, ‘ইউএস গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি আফটার ইউক্রেন’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হচ্ছে, ‘কয়েক মাসের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে দুর্বল ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থা। তাই যে যাই মনে করুক না কেন—এটি স্পষ্ট যে, রাশিয়া এখনো তার হারানো সাম্রাজ্য (সোভিয়েত রাজ্য) পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট শক্তিশালী নয় এবং ইউরোপ নতুন করে নিজেদের সমরাস্ত্রে সজ্জিত করায় তা সেই সম্ভাবনা আরও কমে যাবে।’

কিন্তু রাশিয়া সম্ভবত নিজেদের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন এবং ইতিহাস থেকে বেশ খানিকটা শিক্ষা নিয়েছে। আর তাই যেমনটা পশ্চিমা বিশ্ব চেয়েছে যে—পোদোলিকের ভাষ্যমতে—রাশিয়া ইউক্রেনে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ক্লান্তিকর যুদ্ধে ব্যস্ত থাক তা সম্ভবত হচ্ছে না। পশ্চিমারা যে আফগানাইজেশনের কথা ভাবছে সেরকমটা হওয়ার সম্ভাবনা পোদোলিয়াক নিজেই নাকচ করে দিয়েছেন তাঁর বক্তব্যে। রাশিয়াও আফগানিস্তানে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায় না বলেই দেশটির পদক্ষেপে মনে হচ্ছে। এ কারণেই রাশিয়া সমগ্র ইউক্রেন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে কেবল দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে নেওয়ায় মনস্থির করেছে।

পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় রাশিয়ার সুবিধা দুটি। প্রথমত সেখানকার অধিকাংশ অধিকবাসী রুশভাষী এবং অনেকটা রাশিয়াপন্থী। দ্বিতীয়ত সেই অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ এরই মধ্যে হয় রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে নয়তো রাশিয়ার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে, এখানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকা মানে সমর ব্যয় কমে যাওয়া। যা রাশিয়ার যুদ্ধক্লিষ্ট অর্থনীতিকে বেশ খানিকটা স্বস্তি দেবে।

 আফগানিস্তান ত্যাগ করছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ছবি: রয়টার্স এ ছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়েও এই অঞ্চলে রুশ উপস্থিতি থাকা সম্ভব—রুশ সেনাবাহিনীর শারীরিক উপস্থিতি বজায় না রেখেও। তবে যেহেতু রাশিয়া এখনো ওই অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণরূপে সৈন্য প্রত্যাহারের কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি তাই ধরে নেওয়া যায়, রাশিয়া ওই অঞ্চলেই নিজের উপস্থিতি পোক্ত করতে চায়। এটিই কি তবে রাশিয়ার দর কষাকষির ট্রাম্প কার্ড হতে যাচ্ছে। এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের খানিকটা অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। 

তবে ঘটনা সেখানেই থেমে নেই। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুসারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রাশিয়া ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে। এই সৈন্য প্রত্যাহার ধীর গতিতে হলেও লক্ষ্যণীয় হারেই হচ্ছে। সৈন্য প্রত্যাহারের কথা জানালেও রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ‘শক্তিশালী হামলা’ চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জেলেনস্কি। জেলেনস্কির উপদেষ্টাও রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের কোনো ইঙ্গিত দেননি। উল্টো পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়াকে ঠেকাতে ভারী অস্ত্র সহায়তা চেয়েছেন বলে জানিয়েছে সিএনএন।

সুতরাং, জেলেনস্কির সন্দেহ এবং তাঁর উপদেষ্টার পশ্চিমাদের কাছে ভারী অস্ত্র সহায়তা প্রার্থনা এই ইঙ্গিতই দেয় যে, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেন কেন্দ্র করে রাশিয়ার যে লক্ষ্য তা সহজে অর্জিত হবে না। পশ্চিমা বিশ্ব যদি ইউক্রেনকে গোপনে ভারী অস্ত্র সরবরাহ করে তবে সেই অঞ্চলেও যে পোদোলিয়াক কথিত ‘আফগানাইজেশনের’ মতো পরিস্থিতি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইউটিউবে ১০০০ ভিউতে আয় কত

বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে সরকার, ভয়ে কলকাতায় দিলীপ কুমারের আত্মহত্যা

মেয়াদোত্তীর্ণ ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রণে সার্ভার, ঝুলে আছে ৭ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স

সাবেক সেনাপ্রধান হারুন ছিলেন চট্টগ্রাম ক্লাবের গেস্ট হাউসে, দরজা ভেঙে বিছানায় মিলল তাঁর লাশ

যুবককে ধর্ষণের প্রত্যয়নপত্র দিলেন ইউপি চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত