ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যাকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাঁর দেশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং ‘পেনাল্টি’ আরোপ করেছেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই শুল্কের খামখেয়ালিপনার মুখে ভারত ভয় পাবে না, তবে কৌশল বদলাতে পারে—বলে মনে করেন শশী থারুর। কংগ্রেসের এই এমপি বলেছেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখবে, তবে সম্পর্কটা হতে পারে আগের চেয়ে বেশি স্বার্থভিত্তিক। আদর্শ নয়, নিজের লাভ-ক্ষতির দিকটাই গুরুত্ব পাবে। একই সঙ্গে ভারত নিজেকে আরও স্বনির্ভর করে তোলার দিকেও নজর দেবে।
শশী থারুর
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ভারসাম্যমূলক। দুই দেশের মধ্যে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির মতো কিছু অভিন্ন মূল্যবোধ রয়েছে। কিন্তু আবার অনেক সময়ই দুই দেশের জাতীয় স্বার্থ ভিন্ন পথে চলে। তাই সম্পর্কটি কখনো খুব ঘনিষ্ঠ, আবার কখনো কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
তবে সাম্প্রতিক কিছু কূটনৈতিক ঘটনায় ভারত দারুণ অস্বস্তিতে পড়েছে। এখন নয়াদিল্লিতে মধ্যে প্রশ্ন উঠছে—এই সম্পর্ক কি বড় কোনো পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে?
ভারতের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এক ধরনের ‘ভূরাজনৈতিক নাটকীয়তা’ দেখিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাত থামানোর কৃতিত্ব তাঁরই। তিনি বলেন, তিনি পাকিস্তানকে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাই পাকিস্তান পিছু হটেছে। ভারত এই দাবিতে খুবই ক্ষুব্ধ। কারণ, একদিকে ভারত তার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে খুব সংবেদনশীল, আর অন্যদিকে ট্রাম্পের এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দুজনেই বলেছেন, সেই সময় ট্রাম্প তাঁদের কারও সঙ্গে ফোনেও কথা বলেননি। সংঘাতের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাণিজ্য বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। ফলে ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।
হয়তো ট্রাম্প পাকিস্তানের ওপর কিছুটা চাপ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের ওপর তাঁর কোনো প্রভাব ছিল না। ভারত এমনিতেই শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। তাই বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ বা সংঘাতে জড়ানোর কোনো ইচ্ছাই ভারতের ছিল না।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কাশ্মীরের পেহেলগামে তথাকথিত ‘পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা’ ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ পরিচালনা করে। এটি ছিল নির্ভুল, দ্রুত এবং সীমিত পাল্টা ব্যবস্থা। এতে পাকিস্তানের ভেতরে ৯টি চিহ্নিত জঙ্গি ঘাঁটি ও অন্যান্য স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল শুধুই সেই সন্ত্রাসীরা, যারা ভারতীয় পর্যটকদের হত্যা করেছিল। এটা কোনোভাবেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার পদক্ষেপ ছিল না। তবে পাকিস্তান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যে, সন্ত্রাসীরা তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে হামলা করেছে।
পাকিস্তান এরপর পাল্টা হামলা চালায় এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাতে থাকে। ভারত জবাবে পাকিস্তানের ১১টি বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়, তবে তা ছিল আবারও হিসেব করে নেওয়া এবং কৌশলগতভাবে পরিমিত এক প্রতিক্রিয়া। এরপর পাকিস্তানও ভারতের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানে এবং ভারতের বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে, যার মধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমানও ছিল।
এই দ্বিতীয় দফা হামলার পরই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে আগ্রহ দেখায়। হয়তো যুক্তরাষ্ট্র সেসময় পাকিস্তানকে চাপ দিয়েছিল। তবে এতে ট্রাম্পের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি নিজেই কৃতিত্ব দাবি করেছেন, যা ভারতের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—তাঁরা কোনো হুমকি বা প্রলোভনে নয়, নিজেদের সিদ্ধান্তেই এই সব পদক্ষেপ নিয়েছে।
ট্রাম্পের এমন আচরণ ভারতে অনেকের মনে প্রশ্ন তুলেছে। তবে এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, যা ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। চলতি বছরের জুন মাসে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেন। সেখানে পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। ভারতের সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই আসিম মুনিরকে একজন কট্টর ইসলামপন্থী ও ভারতবিদ্বেষীয় হিসেবে দেখে। তাঁর সঙ্গে ট্রাম্পের এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চীনের ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থানও ভারতের কাছে ধোঁয়াশাপূর্ণ। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তিনি চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন তিনি উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেন, বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেন, এমনকি চীনকে সরাসরি আক্রমণাত্মক ভাষায় আক্রমণও করেন।
কিন্তু এখন ট্রাম্পের অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। একদিকে তিনি চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে আবার শুল্ক বসাচ্ছেন, আর অন্যদিকে তিনি বলছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আমন্ত্রণে তিনি বেইজিং সফর করতে পারেন। আবার কখনো তিনি চীনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য সমঝোতা চাইছেন বলেও মন্তব্য করছেন। এই দ্বৈত আচরণে ভারত বিভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—এই নতুন চীন নীতিতে ভারতের অবস্থান কোথায়? আদৌ কি ট্রাম্পের মাথায় ভারত আছে?
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলেও যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং চীনের প্রভাব প্রতিরোধে একটি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করত।
ভারত নিজেও তখন ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’ বা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছে। অর্থাৎ, সরাসরি কোনো শিবিরে যায়নি, বরং নিজের স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত কোয়াড জোট (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত) পুনরুজ্জীবিত করতেও উৎসাহ দেখিয়েছে।
এটা ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ, চীন কেবল ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করছে না, বরং পাকিস্তানকেও জোরালো সমর্থন দিচ্ছে। এখন চীন সরাসরি ভারতের শিল্প খাতকে দুর্বল করার কৌশল নিয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভারতীয় প্রকৌশলী শিক্ষার্থীদের যাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, ভারতীয় কারখানাগুলোর কাছে উন্নত চীনা যন্ত্রপাতি পৌঁছানো বন্ধ করছে।
ইতিমধ্যে এর প্রভাব ভারতের ইলেকট্রনিকস ও উৎপাদন শিল্পে পড়তে শুরু করেছে। এদিকে চীনের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে—ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকেও তারা প্রভাবিত করছে। ভারতের সরকারি ও বেসরকারি উভয় মহলই চীনকে এখন বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখানে অস্পষ্ট। ভারতের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, অন্তত পাকিস্তানকে চীন যে সামরিক গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছে—বিশেষ করে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করার সাহায্য—সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরব হবে।
কিন্তু ট্রাম্প এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বরং তিনি আবার ভারতের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপ করেছেন। ৩০ জুলাই তিনি ঘোষণা দেন, ভারতের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। একই সঙ্গে তিনি ভারতকে আরও এক ধরনের ‘পেনাল্টি’ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই শাস্তি হতে পারে আরও ১০ শতাংশ শুল্ক, কারণ ভারত এখনো রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র কিনছে।
যদি বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তবে ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককেও ট্রাম্প ব্যবহার করতে পারেন—এমন ভয়ও এখন ভারতের মধ্যে রয়েছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতের কৌশলগত দুশ্চিন্তা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আগে কখনো ভারতের জন্য নির্ভরযোগ্য অংশীদার ছিল না—সে ইতিহাস ভারত ভুলে যায়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিপিএস ডেটা চেয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে ভারত নিজেই তার নিজস্ব ন্যাভিগেশন সিস্টেম গড়ে তোলে।
এখন ভারতের সামনে দুটি প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—১. ভারত কি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করবে? ২. নাকি যুক্তরাষ্ট্রকেও একইভাবে দূরে ঠেলে দিয়ে বাস্তববাদী কূটনীতি অনুসরণ করবে? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো—একটি সম্পর্ক যদি কোনো এক ব্যক্তির খামখেয়ালিপূর্ণ মেজাজের ওপর নির্ভর করে, তাহলে সেই সম্পর্কের মূল্যই বা কতটুকু?
ভারত অবশ্য হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। কিন্তু এটা ঠিক যে, ভবিষ্যতে ভারত অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। ভারতের কোনো সামরিক চুক্তিভিত্তিক জোটে অংশ নেই, তাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের তুলনায় ভারতের কৌশলগত স্বাধীনতা অনেক বেশি।
সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত এখন কিছুটা ভিন্ন পথে হাঁটার কথা ভাবছে। এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের জুলাই মাসের বেইজিং সফরে। এটা দেখায় যে, ভারত চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে চাইছে। তবে এর মানে এই নয় যে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দিচ্ছে। বরং ভারত এখন আত্মনির্ভরতার ওপর জোর দিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আগের মতো আদর্শভিত্তিক না রেখে বাস্তব স্বার্থভিত্তিক করে তুলছে।
ভারতের নতুন কৌশলগত নীতির মূল কথা হলো, ‘সন্ত্রাসে কোনো ছাড় নয়, সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা থাকবে এবং প্রয়োজন হলে দ্রুত জবাব দেওয়া হবে।’ পাকিস্তানে থাকা জঙ্গি ঘাঁটিতে ভারতের হামলা এই নীতির বাস্তব উদাহরণ।
যত দিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, ভারত সেই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। কিন্তু সেই সম্পর্ক যদি একপেশে হয়ে পড়ে, তবে ভারত নিজস্ব পথেই হাঁটবে। কারণ, এখনকার বাস্তবতা এটাই—ভারতকে নিজের স্বার্থে, নিজের মতো করে পথ বেছে নিতে হবে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকা সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ভারসাম্যমূলক। দুই দেশের মধ্যে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির মতো কিছু অভিন্ন মূল্যবোধ রয়েছে। কিন্তু আবার অনেক সময়ই দুই দেশের জাতীয় স্বার্থ ভিন্ন পথে চলে। তাই সম্পর্কটি কখনো খুব ঘনিষ্ঠ, আবার কখনো কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
তবে সাম্প্রতিক কিছু কূটনৈতিক ঘটনায় ভারত দারুণ অস্বস্তিতে পড়েছে। এখন নয়াদিল্লিতে মধ্যে প্রশ্ন উঠছে—এই সম্পর্ক কি বড় কোনো পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে?
ভারতের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এক ধরনের ‘ভূরাজনৈতিক নাটকীয়তা’ দেখিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাত থামানোর কৃতিত্ব তাঁরই। তিনি বলেন, তিনি পাকিস্তানকে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাই পাকিস্তান পিছু হটেছে। ভারত এই দাবিতে খুবই ক্ষুব্ধ। কারণ, একদিকে ভারত তার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে খুব সংবেদনশীল, আর অন্যদিকে ট্রাম্পের এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দুজনেই বলেছেন, সেই সময় ট্রাম্প তাঁদের কারও সঙ্গে ফোনেও কথা বলেননি। সংঘাতের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাণিজ্য বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। ফলে ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।
হয়তো ট্রাম্প পাকিস্তানের ওপর কিছুটা চাপ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের ওপর তাঁর কোনো প্রভাব ছিল না। ভারত এমনিতেই শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। তাই বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ বা সংঘাতে জড়ানোর কোনো ইচ্ছাই ভারতের ছিল না।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কাশ্মীরের পেহেলগামে তথাকথিত ‘পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা’ ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ পরিচালনা করে। এটি ছিল নির্ভুল, দ্রুত এবং সীমিত পাল্টা ব্যবস্থা। এতে পাকিস্তানের ভেতরে ৯টি চিহ্নিত জঙ্গি ঘাঁটি ও অন্যান্য স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল শুধুই সেই সন্ত্রাসীরা, যারা ভারতীয় পর্যটকদের হত্যা করেছিল। এটা কোনোভাবেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার পদক্ষেপ ছিল না। তবে পাকিস্তান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যে, সন্ত্রাসীরা তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে হামলা করেছে।
পাকিস্তান এরপর পাল্টা হামলা চালায় এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাতে থাকে। ভারত জবাবে পাকিস্তানের ১১টি বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়, তবে তা ছিল আবারও হিসেব করে নেওয়া এবং কৌশলগতভাবে পরিমিত এক প্রতিক্রিয়া। এরপর পাকিস্তানও ভারতের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানে এবং ভারতের বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে, যার মধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমানও ছিল।
এই দ্বিতীয় দফা হামলার পরই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে আগ্রহ দেখায়। হয়তো যুক্তরাষ্ট্র সেসময় পাকিস্তানকে চাপ দিয়েছিল। তবে এতে ট্রাম্পের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি নিজেই কৃতিত্ব দাবি করেছেন, যা ভারতের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—তাঁরা কোনো হুমকি বা প্রলোভনে নয়, নিজেদের সিদ্ধান্তেই এই সব পদক্ষেপ নিয়েছে।
ট্রাম্পের এমন আচরণ ভারতে অনেকের মনে প্রশ্ন তুলেছে। তবে এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, যা ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। চলতি বছরের জুন মাসে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেন। সেখানে পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। ভারতের সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই আসিম মুনিরকে একজন কট্টর ইসলামপন্থী ও ভারতবিদ্বেষীয় হিসেবে দেখে। তাঁর সঙ্গে ট্রাম্পের এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চীনের ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থানও ভারতের কাছে ধোঁয়াশাপূর্ণ। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তিনি চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন তিনি উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেন, বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেন, এমনকি চীনকে সরাসরি আক্রমণাত্মক ভাষায় আক্রমণও করেন।
কিন্তু এখন ট্রাম্পের অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। একদিকে তিনি চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে আবার শুল্ক বসাচ্ছেন, আর অন্যদিকে তিনি বলছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আমন্ত্রণে তিনি বেইজিং সফর করতে পারেন। আবার কখনো তিনি চীনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য সমঝোতা চাইছেন বলেও মন্তব্য করছেন। এই দ্বৈত আচরণে ভারত বিভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—এই নতুন চীন নীতিতে ভারতের অবস্থান কোথায়? আদৌ কি ট্রাম্পের মাথায় ভারত আছে?
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলেও যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং চীনের প্রভাব প্রতিরোধে একটি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করত।
ভারত নিজেও তখন ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’ বা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছে। অর্থাৎ, সরাসরি কোনো শিবিরে যায়নি, বরং নিজের স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত কোয়াড জোট (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত) পুনরুজ্জীবিত করতেও উৎসাহ দেখিয়েছে।
এটা ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ, চীন কেবল ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করছে না, বরং পাকিস্তানকেও জোরালো সমর্থন দিচ্ছে। এখন চীন সরাসরি ভারতের শিল্প খাতকে দুর্বল করার কৌশল নিয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভারতীয় প্রকৌশলী শিক্ষার্থীদের যাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, ভারতীয় কারখানাগুলোর কাছে উন্নত চীনা যন্ত্রপাতি পৌঁছানো বন্ধ করছে।
ইতিমধ্যে এর প্রভাব ভারতের ইলেকট্রনিকস ও উৎপাদন শিল্পে পড়তে শুরু করেছে। এদিকে চীনের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে—ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকেও তারা প্রভাবিত করছে। ভারতের সরকারি ও বেসরকারি উভয় মহলই চীনকে এখন বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখানে অস্পষ্ট। ভারতের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, অন্তত পাকিস্তানকে চীন যে সামরিক গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছে—বিশেষ করে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করার সাহায্য—সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরব হবে।
কিন্তু ট্রাম্প এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বরং তিনি আবার ভারতের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপ করেছেন। ৩০ জুলাই তিনি ঘোষণা দেন, ভারতের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। একই সঙ্গে তিনি ভারতকে আরও এক ধরনের ‘পেনাল্টি’ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই শাস্তি হতে পারে আরও ১০ শতাংশ শুল্ক, কারণ ভারত এখনো রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র কিনছে।
যদি বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তবে ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককেও ট্রাম্প ব্যবহার করতে পারেন—এমন ভয়ও এখন ভারতের মধ্যে রয়েছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতের কৌশলগত দুশ্চিন্তা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আগে কখনো ভারতের জন্য নির্ভরযোগ্য অংশীদার ছিল না—সে ইতিহাস ভারত ভুলে যায়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিপিএস ডেটা চেয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে ভারত নিজেই তার নিজস্ব ন্যাভিগেশন সিস্টেম গড়ে তোলে।
এখন ভারতের সামনে দুটি প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—১. ভারত কি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করবে? ২. নাকি যুক্তরাষ্ট্রকেও একইভাবে দূরে ঠেলে দিয়ে বাস্তববাদী কূটনীতি অনুসরণ করবে? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো—একটি সম্পর্ক যদি কোনো এক ব্যক্তির খামখেয়ালিপূর্ণ মেজাজের ওপর নির্ভর করে, তাহলে সেই সম্পর্কের মূল্যই বা কতটুকু?
ভারত অবশ্য হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। কিন্তু এটা ঠিক যে, ভবিষ্যতে ভারত অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। ভারতের কোনো সামরিক চুক্তিভিত্তিক জোটে অংশ নেই, তাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের তুলনায় ভারতের কৌশলগত স্বাধীনতা অনেক বেশি।
সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত এখন কিছুটা ভিন্ন পথে হাঁটার কথা ভাবছে। এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের জুলাই মাসের বেইজিং সফরে। এটা দেখায় যে, ভারত চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে চাইছে। তবে এর মানে এই নয় যে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দিচ্ছে। বরং ভারত এখন আত্মনির্ভরতার ওপর জোর দিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আগের মতো আদর্শভিত্তিক না রেখে বাস্তব স্বার্থভিত্তিক করে তুলছে।
ভারতের নতুন কৌশলগত নীতির মূল কথা হলো, ‘সন্ত্রাসে কোনো ছাড় নয়, সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা থাকবে এবং প্রয়োজন হলে দ্রুত জবাব দেওয়া হবে।’ পাকিস্তানে থাকা জঙ্গি ঘাঁটিতে ভারতের হামলা এই নীতির বাস্তব উদাহরণ।
যত দিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, ভারত সেই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। কিন্তু সেই সম্পর্ক যদি একপেশে হয়ে পড়ে, তবে ভারত নিজস্ব পথেই হাঁটবে। কারণ, এখনকার বাস্তবতা এটাই—ভারতকে নিজের স্বার্থে, নিজের মতো করে পথ বেছে নিতে হবে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকা সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের এই সম্পর্কের টানাপোড়েন সরাসরি আগের স্নায়ুযুদ্ধের মতো নয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল—একদিকে মার্কিন পুঁজিবাদ, অন্যদিকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র। কিন্তু বর্তমান দ্বন্দ্বের পেছনে মূলত কৌশলগত আধিপত্য, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা কাজ করছে।
১১ ঘণ্টা আগেভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের স্বাক্ষরিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘ সময় আলোচনার পর এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম। কারণ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দুই দেশের মোট রপ্তানির ২ দশমিক ৫ শতাংশের কম। তা সত্ত্বেও দুই সরকার একে ‘ঐতিহাসিক’ বলে প্রচার করছ
১ দিন আগেচলতি বছরের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির গতি কিছুটা কমে এলেও তা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু গত শুক্রবার প্রকাশিত জুলাই মাসের পরিসংখ্যানে চাকরির হার ব্যাপক কম দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ট্রাম্প। ওই পরিসংখ্যানকে ‘জাল’ দাবি করে এর জন্য দায়িত্বশীল সরকারি সংস্থার প্রধানকে
১ দিন আগেভারতের অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা সামরিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর চীনা জে-১০সি যুদ্ধবিমানের হামলায় ফরাসি রাফালের পতন পশ্চিমা সামরিক প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তবে রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এর মূল কারণ ছিল ভারতের
১ দিন আগে