Ajker Patrika

ধর্মীয় প্রতীক, ইতিহাস ও যুদ্ধবার্তা: ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আরেক ফ্রন্ট

অনলাইন ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

এক সপ্তাহ পেরোলো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। একের পর এক ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র আর বোমায় যখন উত্তপ্ত দুপক্ষের ভূখণ্ড, তখন সামাজিক মাধ্যমও হয়ে উঠেছে রণক্ষেত্র। একদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি, অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু—নিজেদের সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টে একের পর এক ধর্মীয় ইতিহাস সংক্রান্ত পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন। দুই নেতার এসব পোস্টে স্পষ্ট হচ্ছে—এই লড়াই কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং দীর্ঘদিনের আদর্শিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক সংঘর্ষেরও বহিঃপ্রকাশ।

গত মঙ্গলবার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ দাবি করেন, তখনই খামেনি পোস্ট করেন, ‘হায়দারের নামের বরকতে যুদ্ধ শুরু হলো। খায়বারে জুলফিকার হাতে ফিরেছেন আলি।’ এটি ছিল কেবল একটি যুদ্ধ ঘোষণা নয়, বরং শিয়া ইসলামের এক মহান ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। খায়বার ছিল মদিনার উত্তরে একটি ইহুদি দুর্গ, যেখানে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিরা এক অসাধারণ বিজয় অর্জন করেন। সেই বিজয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন আলি ইবনে আবু তালিব, প্রথম শিয়া ইমাম, যিনি এক হাতে ঢাল আর অন্য হাতে জুলফিকার তরবারি নিয়ে মারহাব নামক তৎকালীন অপরাজেয় ইহুদি যোদ্ধাকে পরাজিত করেন। খামেনির এই টুইট পরে ‘#খায়বার’ হ্যাশট্যাগে রূপ নেয়, যা শিয়াপন্থী ও প্রতিরোধবাদী গোষ্ঠীগুলোর পোস্টে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ধর্মীয় প্রেক্ষাপট টানতে পিছিয়ে নেই নেতানিয়াহুও। হিব্রু বাইবেলের এক শ্লোক থেকে চলমান সামরিক অভিযানের নাম দিয়েছেন ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। হিব্রু বাইবেলের সংখ্যা গ্রন্থের (বুক অব নাম্বার), ২৩ নম্বর অধ্যায়ের ২৪ নম্বর শ্লোকে ইসরায়েলের বিজয়সংক্রান্ত একটি ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে, ‘দেখো, এই জাতি এক মহাসিংহের মতো জেগে উঠবে এবং নিজেকে মেলে ধরবে এক যৌবনোদ্দীপ্ত সিংহের মতো। যতক্ষণ না শিকারের রক্ত পান করবে, ততক্ষণ সে থামবে না।’

হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে নেতানিয়াহু একটি কাগজে এই বাক্যটি লিখে জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়াল-এর একটি ফাটলে ঢুকিয়ে রাখেন। অনেকে মনে করছেন, নেতানিয়াহুর এই আচরণ ছিল ইসরায়েলের আসন্ন হামলার একটি কৌশলী বার্তা—যেখানে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে শক্তি ও অগ্রযাত্রার এক প্রতীকী ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে।

তবে নেতানিয়াহু এখানেই থামেননি। তিনি ইরানি জনগণের উদ্দেশে দেওয়া পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘আজ আমরা ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সামরিক অভিযানে রয়েছি—অপারেশন রাইজিং লায়ন। গত ৫০ বছর ধরে আপনাদের ওপর যারা শাসন করেছে সেই ইসলামি শাসনব্যবস্থা আজ আমাদের ধ্বংস করতে উদ্যত। কিন্তু আমাদের বিরোধ ইরানের জনগণের সঙ্গে নয়—বরং ওই শাসনব্যবস্থার সঙ্গে।’

এই বক্তব্যে তিনি ইরানিদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের ‘ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের’ স্মৃতিচারণ করেন। উল্লেখ করেন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর পারস্যের সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের কথা, যিনি ব্যাবিলন দখলের পর বন্দী ইহুদিদের জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তাদের উপাসনালয় পুনর্নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ইসরায়েলের জাতীয় জাদুঘরে ‘সাইরাস সিলিন্ডার’ নামক এক প্রাচীন পাণ্ডুলিপিকে গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রাচীন দলিল হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।

তবে নেতানিয়াহুর নির্বাচিত প্রতীক ‘রাইজিং লায়ন’ শুধু বাইবেলের একটি শ্লোক থেকেই নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন না কেউ কেউ। ঐতিহাসিকভাবে ইরানের শাহবংশীয় যুগের জাতীয় পতাকায় একটি তলোয়ারধারী সিংহ ও সূর্যের ছবি ছিল। যা ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরানের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। বর্তমানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলনেও এটি ব্যবহৃত হয়। ফলে, নেতানিয়াহুর এই নামকরণ সরাসরি শুধু ধর্মীয় বার্তা নয়, বরং ইসলামপূর্ব ইরানকে ইঙ্গিত করে ইসলামি শাসনের বিরুদ্ধে এক আদর্শিক লড়াইয়ের প্রতীকও বটে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সামাজিকমাধ্যমের প্রতীকযুদ্ধ বুঝিয়ে দিচ্ছে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত কেবল সামরিক হামলা বা পাল্টা হামলার বিষয় নয়—এটি এক দীর্ঘকালীন আদর্শিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক সংঘর্ষ। যখন দুই নেতা নিজেদের জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অতীতের ধর্মীয় প্রতীক ও যুদ্ধগাথা তুলে আনেন, তখন বোঝা যায়, সংঘাতের এই ক্ষেত্র কেবল আকাশপথে বা ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়—এটি ধর্মীয় বিশ্বাস, ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের দখল সংক্রান্ত এক বিস্তৃত যুদ্ধের বার্তা দিচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত