Ajker Patrika

ভারতীয়দের উচ্চমানের গবেষণা যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিজ্ঞানের রূপ

অনলাইন ডেস্ক
ভারতীয়দের উচ্চমানের গবেষণা যেভাবে বদলে দিচ্ছে বিজ্ঞানের রূপ

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ ভারত। দেশটির বিপুল পরিমাণ মেধাবী মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতেও ভারতীয়রা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। ২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞান জার্নালে যে পরিমাণ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ভারতীয় গবেষকেরা গবেষণাপত্র প্রকাশের দিক থেকে তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরপরই তাদের অবস্থান। 

বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল নেচারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, গবেষণাপত্র প্রকাশের দিক থেকে ভারতীয়রা তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও তাদের গবেষণাপত্র থেকে উদ্ধৃতি (সাইটেশন) হয় খুবই কম। সেই তালিকা করলে ভারতের অবস্থান হয় ১৫৩ তম। এমনকি ২০২০ সালে ভারতীয় গবেষকেরা যে পরিমাণ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন তার ৩০ শতাংশ থেকে কখনোই কোনো উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি। যেখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ২০ শতাংশ। 

তবে এত প্রতিকূলতা থাকলেও ভারতীয় গবেষকেরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ও ব্যাপক উদ্ধৃত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ক্ষেত্র হলো—বায়ু দূষণ, হাইড্রোজেন অর্থনীতি, পারকিনসন রোগের চিকিৎসা ও রোগ-প্রতিরোধী ইস্টের উৎস আবিষ্কার। নেচার জার্নাল বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছে। 

বেশ কয়েক বছর ধরেই ভারতীয় শহরগুলো বায়ুদূষণের কারণে ব্যাপকভাবে ভুগছে। সমস্যাটি ভারতে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই প্রেক্ষাপটে বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বেশ অবদান রেখেছেন। তাদের একজন হলেন শচীন গুণ্ঠে। তিনি ভারতের চেন্নাইয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষক। তিনি বছর ২০২০ সালে ভারতের বায়ু দূষণ নিয়ে মৌলিক কিছু কাজ করেছেন। 

শচীন গুণ্ঠে এবং অপর এক গবেষক আহমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির নরেন্দ্র ওঝা মিলে ভারতের বায়ুদূষণের উৎসগুলো এবং সেগুলো কীভাবে পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া করে সেই বিষয়টি আবিষ্কার করেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন বায় দূষক পদার্থ নিয়েও কাজ করেন। তাদের এই গবেষণা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক উদ্ধৃত হয়েছে। পরে শচীন গুণ্ঠে তাঁর গবেষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব আটলান্টার পেংফেই লিউয়ের সঙ্গে আরও বিস্তারিত গবেষণা করেন। বিশেষ করে দিল্লির বায়ু দূষণ নিয়ে তারা ব্যাপক কাজ করেন এবং ২০২২ সালে তাঁরা এই বিষয়ে একটি নতুন গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন।

জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য বা সবুজ জ্বালানিতে প্রবেশের অন্যতম চাবিকাঠি বলা হয়, হাইড্রোজেন জ্বালানিকে। এই জ্বালানি খাতকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বিকশিত হয়েছে হাইড্রোজেন ইকোনমি বা হাইড্রোজেন অর্থনীতি। ভারত সরকারও এই সুযোগ লুফে নিতে চলতি বছর ঘোষণা করেছে, তারা ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর অন্তত ৫০ লাখ টন হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে চায়।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে একটি কৌশল। আর তা হলো—একটি তড়িৎ রাসায়নিক জল বিভাজক ব্যবস্থায় দুটি ইলেকট্রোড স্থাপন করা হবে। সেখানে বিদ্যুৎ প্রয়োগ করা হলে রাসায়নিক বিক্রি ঘটবে এবং এর ফলে অ্যানোডে অক্সিজেন এবং ক্যাথোডে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপাদন হবে। ভারতের বেশ কয়েকটি গবেষক দল এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের একজন হলেন—কানপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কৃষ্ণ বিশ্বাস। 

কৃষ্ণ বিশ্বাস এবং তাঁর সহকর্মীরা প্রথমবারের মতো দেখান যে, কোবাল্ট, লোহা, গ্যালিয়াম, নিকেল ও জিংকের সমন্বয়ে কম খরচে হাই-এনট্রপি সংকর ধাতু ব্যবহার করে অক্সিজেন-উৎপাদনকারী অ্যানোড নির্মাণ করা সম্ভব। এই অ্যানোডগুলো দুর্দান্ত স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করে। টানা ১০ ঘণ্টা ব্যবহারের পরও এসব অ্যানোড ৮০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন সক্ষমতা ধরে রাখে। অথচ রুথেনিয়াম অক্সাইডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি অত্যাধুনিক অ্যানোডগুলোর সক্ষমতা একই সময়ে ৩০ শতাংশে নেমে আসে। এই গবেষণার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত অবদান রাখা আরেক বিজ্ঞানী হলেন সুব্রত কুণ্ডু। 
 
পারকিনসন রোগে উৎস খুঁজে পেতেও ভারতীয় বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন। ২০২০ সালে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষক সামির মাজি এই রোগের উৎস খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখেন। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেই বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন যে, আলফা-সিনিউক্লেইনের অস্বাভাবিক সমষ্টির কারণে পারকিনসন রোগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ঠিক কী কারণে আলফা-সিনিউক্লেইন জমাট বাঁধে সেই কারণটি কেউ খুঁজে পাওয়ার পথ দেখাতে পারছিলেন না। কিন্তু সামির মাজি এই গবেষণায় নতুন পথ দেখিয়েছেন। 

বিগত কয়েক বছরের ভারতীয় বিজ্ঞানীরা ওষুধ-প্রতিরোধী ইস্টের উৎস খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রেও অসাধারণ অগ্রগতি দেখিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারির উত্থানের ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন একটি ভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ২০১৯ সালে ইস্ট ক্যান্ডিডা অরিসকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘জরুরি হুমকি’ বলে অভিহিত করেছিল। 

সাধারণত সি. অরিস প্রধানত বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা যায়। এটি গুরুতর ও মারাত্মক রক্তপ্রবাহের সংক্রমণের কারণ হতে পারে। বিগত কয়েক বছরে এই ইস্ট থেকে সংক্রমিত রোগের ব্যাপারে ব্যাপক খবর পাওয়া যেতে পারে। পরে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আমাদের কাছে যে ওষুধ রয়েছে সেগুলো এই ইস্টকে প্রতিরোধ করতে পারে না। 

কিন্তু এই ইস্টের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় রোগের চিকিৎসায়ও অগ্রগতি হচ্ছিল না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ভারতীয় বিজ্ঞানী অনুরাধা চৌধুরী। তিনি দিল্লি ইউনিভার্সিটির ছত্রাক বিশেষজ্ঞ। তিনি এই ইস্টের উৎস খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে একাধিক ও ধারাবাহিক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তাঁর সেই নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। এর ধারাবাহিকতায় তিনি ২০২০ সালে আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রায় ৬০০ রোগীর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখতে পান, মূলত দূষিত চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি থেকে এই ছত্রাকটি ছড়ায়। 

ভারতীয় গবেষকেরা এর বাইরেও আরও একাধিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তারই নজির—সম্প্রতি দেশটি চাঁদে গবেষণা যান পাঠিয়েছে, যান পাঠিয়েছে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করতেও। এমনকি গভীর সমুদ্র অনুসন্ধানে বানাচ্ছে মনুষ্যবাহী ডিপ সি সাবমারসিবল। এগুলো সবই ভারতীয় গবেষকদের সক্ষমতার প্রমাণ। 

অনুবাদ: আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত