Ajker Patrika

নিক্কেই এশিয়ার নিবন্ধ /বাংলাদেশকে জোটে নিলে যেভাবে লাভবান হবে আসিয়ান

অনলাইন ডেস্ক
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

এক সময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ। অথচ, এই দেশই ২১ শতকের শুরুর পর থেকে এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। অনেকে বাংলাদেশকে পরবর্তী ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন বিভিন্ন সময়ে। গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশ ক্রমশ নিজেকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছে।

গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য নিজের আঞ্চলিক পরিচয় নতুন করে ভাবার ও দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে নজর দেওয়ার নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।

দেশের অর্থনৈতিক গতিপথ ও আঞ্চলিক জোটে যোগদানের ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষা বিবেচনা করে, বাংলাদেশের জন্য এখনই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে গভীর সহযোগিতা অন্বেষণের উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশের আসিয়ানে যোগদান পারস্পরিকভাবে উপকারী হতে পারে।

বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করলে আসিয়ানের সরবরাহ শৃঙ্খলে সমন্বয় সাধন এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান বস্ত্র ও তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক হিসেবে বাংলাদেশ বড় আকারের উৎপাদন সক্ষমতা এবং সাশ্রয়ী শ্রমশক্তি সরবরাহ করে থাকে। এই সমন্বয় আন্তসীমান্ত বিনিয়োগ, শ্রম গতিশীলতা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের নতুন পথ খুলে দেবে। বিশেষ করে, আরও শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক মূল্য শৃঙ্খল তৈরির প্রেক্ষাপটে এটি গুরুত্বপূর্ণ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—দেশটির বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সবচেয়ে ব্যস্ততম বন্দর রয়েছে। এটি শুধু চীনের কাছাকাছিই নয়, আসিয়ানের জন্য ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বারও হতে পারে। ভৌগোলিক সুবিধা এবং শিল্পের পরিপূরকতা থাকা সত্ত্বেও আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বর্তমানে মোট বাণিজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ। অন্যান্য অ-আসিয়ান এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ৪২ শতাংশ, যেখানে ইউরোপের সঙ্গে ৩১ শতাংশ। এই বৈষম্য একটি উল্লেখযোগ্য অব্যবহৃত সম্ভাবনার দিক নির্দেশ করে।

বাংলাদেশ ও আসিয়ানের মধ্যে বাণিজ্য ও উৎপাদন সংযোগ গভীর করা বিদ্যমান বাধাগুলো কমাতে পারে। এটি আন্তঃ এশীয় সংহতি বাড়াতে এবং উভয় পক্ষকে বাহ্যিক ধাক্কা থেকে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল পুনর্গঠনের সময়ে এটি আরও জরুরি। আসিয়ানে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ হলো—জোটের অর্থনৈতিক পদচিহ্ন আরও পশ্চিমে প্রসারিত করা। এই সংযুক্তি বৈশ্বিক উৎপাদন ও রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে জোটের অবস্থানকেও শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের জন্য আসিয়ানের সদস্যপদ এক বিশাল বাজারে প্রবেশাধিকার দেবে এবং ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসিইপি) মতো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কাঠামোয় গভীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।

আসিয়ানের জন্য বাংলাদেশ একটি তরুণ কর্মশক্তি, ক্রমবর্ধমান ভোক্তা ভিত্তি এবং একটি সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্প ভিত্তি সরবরাহ করবে। এটি জোটের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে জোরদার করতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভিত্তির পাশাপাশি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহত্তম উৎস দেশ। বিশেষ করে, নির্মাণ ও কৃষি খাতে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কাজ করেন।

আসিয়ানে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করলে শ্রম গতিশীলতার ক্ষেত্রে আরও সুসংহত ও পারস্পরিকভাবে উপকারী পদ্ধতি তৈরি হবে এবং অঞ্চলজুড়ে শ্রম মান সমন্বয় করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এটি শ্রমিকদের জন্য উন্নত সুরক্ষা এবং আশ্রয়দানকারী দেশগুলোর জন্য আরও টেকসই মানবসম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

আসিয়ানের কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র যখন ক্রমবর্ধমান হারে বয়স্ক জনসংখ্যা এবং সংকুচিত কর্মশক্তির সম্মুখীন, তখন এই সমন্বয় আরও গুরুত্বপূর্ণ। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতে এরই মধ্যেই জনমিতিক পরিবর্তন ঘটছে, যা দীর্ঘমেয়াদি দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বাংলাদেশ বিশাল, তরুণ এবং ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত জনসংখ্যা দিয়ে এসব দেশে পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি শ্রম ঘাটতি পূরণে এবং অঞ্চলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

এ ছাড়া, বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয়ে) স্নাতক রয়েছেন। তাদের অনেকেই এখনো নিজেদের মেধা ও দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ পাননি। উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো যখন বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, তখন এই উদীয়মান প্রতিভা ভিত্তি আসিয়ানের সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কেবল আসিয়ানের উৎপাদন ও উদ্ভাবন ক্ষমতা বাড়াবে না, বরং বিনিয়োগ, আন্তসীমান্ত সহযোগিতা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য নতুন পথও তৈরি করবে।

ড. ইউনূস এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি জোরালো আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি জোটটিতে যোগদানের জন্য আসিয়ান দেশগুলো—বিশেষ করে মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের সক্রিয় সমর্থন চেয়েছেন। তবে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া এখনো খুব এক আশাব্যঞ্জক নয়। আনুষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা বা সমর্থনের ইঙ্গিত খুব একটা পাওয়া যায়নি। তবুও, এই প্রস্তাবটি আসিয়ান দেশগুলোর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার দাবি রাখে।

কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ নিঃশব্দে সামাজিক উদ্ভাবনের বৈশ্বিক ক্ষেত্রকে রূপ দিয়েছে। এর প্রভাব আসিয়ানসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রসারিত হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক আলোচনায় প্রায়শই উপেক্ষিত হলেও, বাংলাদেশ দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোতে প্রবেশাধিকারের মতো পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তৃণমূল পর্যায়ের, সম্প্রদায়-চালিত মডেল তৈরি করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তন দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের ধারণাকে বদলে দিয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণের বাইরেও, বাংলাদেশ সামাজিক উদ্যোগ, সমবায় এবং শিক্ষা উদ্যোগের এক বৈচিত্র্যময় ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে, যা জনসেবা এবং উদ্যোগের মধ্যকার সীমারেখা অস্পষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান এক ডজনেরও বেশি দেশে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করেছে। আসিয়ানেও তাদের মডেল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ফিলিপাইনে, তথাকথিত বিকল্প বিতরণ মডেল কর্মসূচির অধীনে শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে ব্র্যাকের সহযোগিতা সংঘাত-বিধ্বস্ত এবং দুর্গম এলাকায় মানসম্মত শিক্ষায় প্রবেশাধিকার প্রসারিত করতে সাহায্য করেছে। তাদের সামগ্রিক পদ্ধতি আসিয়ানের গ্রামীণ এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

ট্রাম্প প্রশাসন যখন ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) সাম্প্রতিক তহবিল স্থগিত করেছে, যার ফলে এশিয়াজুড়ে অসংখ্য সামাজিক কার্যক্রম স্থগিত বা বাতিল করেছে তখন বাংলাদেশের উদ্ভাবনভিত্তিক, আত্মনির্ভরশীল উন্নয়ন দর্শন একটি বিকল্প তুলে ধরে। আসিয়ান-বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে স্বল্প খরচের এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়নকারী প্রমাণিত সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করতে পারে।

এ ছাড়া, বাংলাদেশ ডিজিটাল এবং স্বল্প খরচের উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বল্প খরচের চিকিৎসা সরঞ্জাম, মোবাইল মানি এবং তৃণমূল পর্যায়ের জলবায়ু অভিযোজন কৌশল—এগুলো এমন সমাধান যা আসিয়ান দেশগুলো শিখতে এবং তাদের স্থানীয় প্রেক্ষাপটে মানিয়ে নিতে পারে। এই মডেলগুলো কেবল তাৎক্ষণিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে না, বরং ভবিষ্যৎ ধাক্কা, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন বা জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

আসিয়ানে বাংলাদেশকে একীভূত করা এই সংযোগগুলোকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেবে এবং গভীর করবে। যৌথ গবেষণা, পাইলট প্রোগ্রাম, আঞ্চলিক জ্ঞান কেন্দ্র এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক তহবিল ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক উদ্ভাবনে আন্তসীমান্ত সহযোগিতা সহজতর করবে। ব্লকটি যখন বাণিজ্য যুদ্ধের যুগের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গঠিত আসিয়ান আঞ্চলিক উন্নয়নের একটি আরও মানবকেন্দ্রিক মডেলকে এগিয়ে নিতে পারবে এবং সম্মিলিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও অনুকূল বাণিজ্য চুক্তি আলোচনা করতে পারবে।

লেখক: নিয়াজ আসাদুল্লাহ মালয়েশিয়ান থিংক ট্যাংক আইডিয়াসের সিনিয়র ফেলো এবং ডরিস লিউ একজন অর্থনীতিবিদ ও একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী গবেষণা ব্যবস্থাপক।

অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত