Ajker Patrika

দিনে শান্তির কথা রাতে গাজায় হামলা, ইসরায়েল কি আদৌ যুদ্ধবিরতি চায়

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৫৯
Thumbnail image
গাজায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর আনন্দ প্রকাশ করছেন গাজাবাসী। ছবি: আনাদোলু এজেন্সি

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছে ১৫ মাস ধরে। এই সময়ে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডে প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে; আহত হয়েছে লক্ষাধিক। আর পুরো গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় শতভাগই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ত্রিদেশীয় মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু রাত না গড়াতেই সে আশার গুঁড়ে বালি। আগামী রোববার থেকে চুক্তি কার্যকরের লক্ষ্য নিয়ে বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় তা পাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা স্থগিত করে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক হামলা চালাল। বিমান হামলায় প্রায় ৮০ জন নিহত হন। প্রশ্ন উঠেছে, গাজায় যুদ্ধবিরতিতে আদৌ কি রাজি ইসরায়েল? অথবা, এই যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ কী?

গত বুধবার কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় প্রস্তাবে সম্মতি জানায় বিবদমান দুই পক্ষ ইসরায়েল ও হামাস। এই যুদ্ধবিরতি আগামী রোববার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এই চুক্তির পক্ষে সম্মতি জানালেও ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় এখনো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে অভিযোগ করা হয়, হামাস শেষ মুহূর্তে অতিরিক্ত দাবি তুলেছে। যে কারণে গাজা অস্ত্রবিরতি চুক্তি কার্যকরে বিলম্ব হতে পারে।

নেতানিয়াহুর এক মুখপাত্র বলেন, হামাস শেষ মুহূর্তে অতিরিক্ত সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে। ইসরায়েল চুক্তির সব শর্ত মেনে নিয়েছে, তা মধ্যস্থতাকারীরা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা বৈঠক করবে না। আজ বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের পক্ষ থেকে চুক্তির গ্রহণযোগ্যতার জন্য মন্ত্রিসভা ও সরকারের অনুমোদন পেতে একটি ভোট হওয়ার কথা।

তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই চুক্তি লঙ্ঘন ও শেষ মুহূর্তে সংকট তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এক হামাস কর্মকর্তা। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ইজ্জত আল-রিশক বলেন, ‘চুক্তির কোনো শর্তে হামাসের পিছিয়ে আসার খবর মিথ্যা। মধ্যস্থতাকারীরা যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি ঘোষণা করেছেন, হামাস তাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে তা নিজের সুবিধায় ব্যবহারের পথ খুঁজতে পারেন নেতানিয়াহু। তিনি হয়তো ২০২২ সাল থেকে নির্ভর করে আসা কট্টর ডানপন্থী জোটের অংশীদারদের এড়িয়ে নতুন কৌশল নিতে পারেন। এ ছাড়া, এই চুক্তি সৌদি আরবের সঙ্গে বহুদিন ধরে প্রতীক্ষিত সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিরও পথ প্রশস্ত করতে পারে। এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীরণের সমীকরণের কারণে নেতানিয়াহু হয়তো নিজের মতো করেই খেলতে চাইতে পারেন। কিন্তু, তাতে কেবলই ফিলিস্তিনিদেরই প্রাণ বিপন্ন হবে। এই বিষয়ে তেল আবিবের বার-ইলান ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের প্রধান জোনাথন রিনহোল্ড বলেন, ‘মূল বিষয় পরিস্থিতি নয়, বরং খেলার কৌশল। আর এই খেলায় নেতানিয়াহু সেরা খেলোয়াড়।’

নেতানিয়াহু সেরা খেলোয়াড় হন আর যাই হন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য কট্টরপন্থী দলগুলোর সমর্থন প্রয়োজন। এই বিষয়ে ইসরায়েলের সম্প্রচার সংস্থা কানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদনে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সেটি অনুষ্ঠিত না হওয়ার কারণ কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ। কারণ, এখনও তিনি নেতানিয়াহুকে জানাননি যে, সরকার এই চুক্তি অনুমোদন করলে তাঁর দল নেতানিয়াহুর জোট সরকার ছেড়ে যাবে কি না।

এত কিছুর পরও বাইডেন প্রশাসন আশাবাদী যে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির অনুমোদন দিতে দেরি করলেও রোববারই এটি কার্যকর সম্ভব হবে। বৃহস্পতিবার মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ফাইনার বলেন, ‘যখন দুই পক্ষের মধ্যে আস্থা একেবারেই শূন্য এবং চুক্তি অত্যন্ত জটিল, তখন জটিলতা তো থাকবেই।’

জন ফাইনার আরও বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণভাবে আশা করছি যে, এই চুক্তি প্রেসিডেন্ট (জো বাইডেন) এবং মধ্যস্থতাকারী মিসর ও কাতারের বর্ণনা অনুযায়ী এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই কার্যকর হবে। আমরা এখন বাস্তবায়নের বিস্তারিত নিয়ে কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারী এবং ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে।’

এদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও আশা প্রকাশ করেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির কার্যক্রম রোববারই শুরু হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শেষ সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী এবং পুরোপুরি প্রত্যাশা করি যে, রোববার যুদ্ধবিরতির কার্যক্রম শুরু হবে।’ তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা এবং তিনি নিজে কাতারের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর সমাধানে টেলিফোনে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের জটিল ও চ্যালেঞ্জিং আলোচনার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমরা এখনই সেসব সমস্যার সমাধানে কাজ করছি।’

আন্তর্জাতিক দিকগুলো বাদ দিলে, মূলত এই চুক্তির ভবিষ্যৎ প্রকৃত অর্থেই নির্ভর করছে ইসরায়েলের ওপর। নেতানিয়াহুর সরকারে গৃহদাহ যে, এই চুক্তিটিকে প্রভাবিত করছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য, নিজের দায় এড়াতে নেতানিয়াহু হামাসকে দোষারোপের রাস্তা বেছে নিয়েছেন।

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গাভির বলেছেন, তিনি নেতানিয়াহুর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চান। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ এই চুক্তির ঘোরবিরোধী। তবে তিনি এখনও স্পষ্ট করেননি যে, তিনি সরকারের থেকে পদত্যাগ করবেন কিনা।

নেতানিয়াহুর দপ্তর জোর দিয়ে বলছে, আলোচনায় ইসরায়েলের স্বার্থ নিশ্চিত করতে তিনি খুব কঠোর। তারা জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী আলোচনাকারী দলকে নির্দেশ দিয়েছেন—চুক্তিতে সম্মত বিষয়গুলো মেনে চলতে এবং হামাসের শেষ মুহূর্তের ব্ল্যাকমেইল প্রচেষ্টা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে।’ কিন্তু হামাস আগেই জানিয়েছে, তারা মধ্যস্থতাকারীদের দেওয়া শর্ত মেনে চলছে।

এই আলোচনা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, নেতানিয়াহু তাঁর সরকার বাঁচাতে এবং নিজে প্রধানমন্ত্রীর পদে টিকে থাকতে এই চুক্তির আলোচনার মধ্যেও আবারও হামাস এবং ফিলিস্তিনি জনগণকেই বলির পাঠা বানানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে এই টুকু আশা করা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে চায়। সম্ভব হলে, ২০ জানুয়ারি বাইডেনের বিদায় ও ট্রাম্পের শপথের আগেই।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স, টাইমস অব ইসরায়েল ও বিবি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত