Ajker Patrika

জোহরান মামদানির নাম ভুল উচ্চারণের পেছনে ধ্বনিতত্ত্ব নাকি রাজনীতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ২০: ১৭
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

‘মি. মানদানি’, ‘মি. মানদামি’, ‘জোরহান মানদামি, ‘জোহরান মানদামি’—এগুলো নিউইয়র্ক সিটি মেয়র পদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জোহরান মামদানির নামের কিছু বহুল প্রচলিত সংস্করণ।

নিউইয়র্ক সিটি মেয়র পদের ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি থেকেই অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জোহরান মামদানির নামের উচ্চারণ নিয়ে বিতর্কের সূচনা। সে সময় নামের ভুল উচ্চারণ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমোকে এক কড়া জবাব দিয়েছিলেন মামদানি। গত সপ্তাহে মেয়র নির্বাচনের ত্রিমুখী বিতর্ক অনুষ্ঠানে বিষয়টি আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।

বিতর্কের এক ঘণ্টার বেশি সময় পরও সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু এম কুমো একবারও এই দৌড়ে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর নামটি উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি তাঁকে কেবল ‘অ্যাসেম্বলিম্যান’ ও সাবেক মেয়র বিল ডি ব্লাসিওর একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে আখ্যায়িত করে দায়িত্ব সারেন। নির্বাচনী প্রচারে বারবার ভুলভাবে উচ্চারণ করার পর একধরনের ‘আত্মসংযম’ দেখিয়ে বিতর্কেও তিনি সেই নাম বলা থেকে বিরত থাকেন। তাঁর উচ্চারণ এতটাই ভুল ছিল যে, গত জুনে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি বিতর্কে অ্যাসেম্বলিম্যান জোহরান মামদানি নিজেই তাঁকে এক উচিত জবাব দেন।

তবে শুধু কুমোই নন, নানা কারণে মামদানির প্রথম ও শেষ নামটি উচ্চারণের ক্ষেত্রে বেশ অদ্ভুত, এমনকি সৃজনশীল ভাষাগত বিভ্রাটের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া গত সপ্তাহে সাধারণ নির্বাচনের প্রথম বিতর্কে তাঁর নাম বলতে হিমশিম খেয়েছিলেন, তাঁকে ‘জোর-হান’ বলে ডেকেছিলেন। এমনকি নিউইয়র্কে অ্যাটর্নি জেনারেল ও মামদানির একজন প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী লেটিটিয়া জেমসও এ মাসে ওয়াশিংটন হাইটসে একটি বড় নির্বাচনী জনসভায় তাঁর নাম ভুলভাবে উচ্চারণ করেন, মঞ্চে আসার সময় তাঁকে উৎসাহের সঙ্গে ‘মানদামি’ বলে চিৎকার করে স্বাগত জানান।

মামদানির জন্য তাঁর নাম বিকৃত করা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ম্যানহাটনে একজন অভিবাসী হিসেবে বেড়ে ওঠার সময় তাঁর নামের ভুল উচ্চারণ ছিল একটি সাধারণ ঘটনা। তিনি বলেন, ‘এটা প্রায়ই ঘটত। তবে সত্যি বলতে, যাঁরা চেষ্টা করেন এবং ভুল করেন, তাঁদের প্রতি আমার কোনো বিরক্তি নেই। চেষ্টা করাটাই আমার কাছে সব।’

শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার দৌড়ে থাকা মামদানি অবশ্য মনে করেন, কুমোর মতো কিছু ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর নাম ভুল উচ্চারণ করছেন অথবা সঠিকভাবে বলার চেষ্টা করেন না। তিনি বলেন, ‘যাঁরা আমার নাম ভুল উচ্চারণ করার জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করেন, সেটা কোনো ভুল নয়, সেটা একধরনের বার্তা।’

সাবেক মেয়র ডি ব্লাসিও মামদানির আরও একজন সহযোগী, যিনি স্বীকার করেছেন যে—তিনিও মামদানির নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন। ডি ব্লাসিও বলেন, ‘আমি মনে করি, আমি এখন কাছাকাছি আছি, তবে আমার বেশ কিছুদিন লেগেছে!’ তিনি যোগ করেন, ‘আমার মনে হয়, আমেরিকান ইংরেজির কানে, এই নামের গঠন কিছুটা অপ্রত্যাশিত। এর ছন্দটা সঠিকভাবে ধরতে কিছু অনুশীলন লাগে।’

স্লিওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি ভালো করার চেষ্টা করছেন, ‘সময় লাগবে। এটা ইচ্ছাকৃত নয়।’ স্লিওয়ার নামও অনেকে ভুল উচ্চারণ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মামদানির কষ্ট বুঝি। গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলস প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৪৬ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৩ বছর আমার নাম ক্রমাগত ভুল উচ্চারণ করা হয়েছে। আমি এতে অবশ্য আপত্তি করি না।’

তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মামদানির নাম বলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়তো এতটাও উদারভাবে দেখা যেতে পারে না, কারণ, ট্রাম্প বারবার এ প্রার্থীর ওপর কথার আক্রমণ করে তাঁকে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছেন। তাঁর প্রেস সেক্রেটারি, ক্যারোলিন লিভিট, তাঁর প্রথম ও শেষ নামের অংশগুলোকে একত্র করে আরও অদ্ভুত উচ্চারণ ব্যবহার করেছিলেন।

তবে কিছু ভুল উচ্চারণ ইচ্ছাকৃত হলেও বেশ কয়েকজন ভাষাতত্ত্ববিদ দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, মামদানির প্রথম ও শেষ উভয় নামেই এমন অক্ষর বিন্যাস ও স্বরধ্বনি রয়েছে, যা ইংরেজিতে সাধারণত দেখা যায় না। তাই অনেকের পক্ষে এটি উচ্চারণে হিমশিম খাওয়াটা আশ্চর্যজনক কিছু নয়।

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক জিলিয়ান গ্যালাগার জানান, ইংরেজিতে ‘মড’-এর চেয়ে ‘নড’ ক্রমযুক্ত শত শত শব্দ বেশি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের ব্যঞ্জনবর্ণের গুচ্ছ ভুল উচ্চারণের কারণ হতে পারে। একটি প্রক্রিয়া, যা অ্যাসিমিলেশন নামে পরিচিত, তাতে মামদানির শেষ নামের দ্বিতীয় ‘ম’ অক্ষরটি ‘ন’-এ পরিবর্তিত হয়ে ‘মানদানি’র মতো শোনাতে পারে। অন্য একটি প্রক্রিয়া, যা সাবস্টিটিউশন নামে পরিচিত, তাতে বক্তারা মামদানির ‘ন’ অক্ষরটিকে অন্য একটি ‘ম’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে ফেলেন।

এ ধরনের কথার প্যাটার্ন এড়িয়ে চলা কঠিন হতে পারে। এনওয়াইইউ সোসিওলিঙ্গুইস্টিকস ল্যাবের সহপরিচালক অধ্যাপক লরেল ম্যাকেনজি বলেন, ‘মামদানিতে ‘‘ম’’-এর পাশে ‘‘দ’’ আছে, যা ইংরেজিভাষীদের জন্য কঠিন। আমাদের জিহ্বা এই নির্দিষ্ট ক্রমের ধ্বনি তৈরি করতে অভ্যস্ত নয়।’

প্রায়ই, ‘জোহরান’কে তীক্ষ্ণ ‘জোহর-অ্যান’ (Zohr-ANNE) হিসেবে উচ্চারণ করা হয়। সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের সহযোগী গবেষণা অধ্যাপক সুজান ভ্যান ডের ফিস্ট বলেন, এই ভুল উচ্চারণ ঘটে আমেরিকানাইজড ইংরেজিতে স্বরধ্বনি ভিন্নভাবে উচ্চারিত হওয়ার কারণে।

মামদানি জানান, একবার নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি ম্যানহাটনের একটি মসজিদে জুমার নামাজে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উপস্থিত মুসল্লিদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কি না যে, কেউ তাঁদের নাম ধারাবাহিকভাবে ভুল উচ্চারণ করেছেন। কক্ষের বেশির ভাগ মানুষই হাত তুলেছিলেন।

মামদানি বলেন, অগণিত অভিবাসী এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। যখন কেউ কারও নাম নিয়ে উপহাস করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে, তখন এর মানে হলো, কেউ যেন বলতে চায় যে, এই ব্যক্তি এখানে থাকার যোগ্য নয়।

মামদানি জানান, তিনি তাঁর নাম নিয়ে গর্বিত। তাঁর মা তাঁর প্রথম নামটি বেছে নিয়েছিলেন, যার অর্থ ‘আকাশের প্রথম তারা’। তাঁর বাবা তাঁর মাঝের নাম ‘কোয়ামে’ বেছে নিয়েছিলেন ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, সেই কোয়ামে নক্রুমার সম্মানে।

তবে মামদানি মনে করেন, তাঁর নাম উচ্চারণে ভুল করা বা বিকৃত করা ইচ্ছাকৃত। এর পেছনে কোনো রাজনীতি রয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, অ্যান্ড্রু কুমোর মতো মানুষদের ‘জন ক্যাটসিমাটিডিস’-এর মতো কঠিন নাম উচ্চারণে কোনো দিন ভুল হয় না। যিনি আসলে এক গ্রিক বিলিয়নিয়ার মুদি ব্যবসায়ী। কিন্তু মামদানি নামটা নাকি উচ্চারণ করা কঠিন! আসলে এটা পক্ষপাতের বিষয়।

অন্যরাও কুমোর এমন ভুলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিক আনন্দ গিরিধরদাস এমএসএনবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেন, ‘আপনি এমন এক বৃহৎ ও বৈচিত্র্যময় শহরকে নেতৃত্ব দিতে চান। অন্তত মানুষের নাম ঠিকভাবে উচ্চারণ করা শেখা উচিত।’

অন্যদিকে কুমোর মুখপাত্র রিচ অ্যাজোপার্ডি বলেছেন, ‘সাবেক গভর্নর কুমোর নামও প্রায়ই ভুল উচ্চারণ করা হয়। যেমন অনেকে ‘‘কুমো’’কে ‘‘কোমো’’ (ইতালির এক হ্রদের নামের মতো) বলেন। এটা ইচ্ছাকৃত নয়, তাই এতে বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই। আমাদের নামও মানুষ প্রায়ই ভুল বলে, কিন্তু আমরা তা নিয়ে কান্নাকাটি করি না।’

তবে ম্যাকেনজি ও অন্যরা বলেন, কঠিন নাম উচ্চারণ করা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। একটু অনুশীলন আর আগ্রহ থাকলেই সম্ভব। বিশেষ করে, নিউইয়র্কের মতো শহরে, যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্তের অভিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করে।

ম্যাকেনজি বলেন, ‘আমরা তো সবাই ‘‘গেম অব থ্রোনস’’-এর সময় ‘‘ডেনেরিস টার্গারিয়ান’’ নামটা ঠিকঠাক শিখেছিলাম, তাই না? তাহলে মানুষের নাম শেখা কেন নয়? আমরা পারব, শুধু একটু চেষ্টা করতে হবে, একটু অনুশীলন করতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাশিয়ার জব্দ ১৬২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইউক্রেনের জন্য কোথা থেকে অস্ত্র কেনা হবে, তা নিয়ে বিভক্ত ইইউ

প্রধান উপদেষ্টাকে সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব আবেগতাড়িত, রাষ্ট্র আবেগের ওপর চলে না: সালাহউদ্দিন

‎টঙ্গী থেকে নিখোঁজ ইমামকে পঞ্চগড়ে উদ্ধার

আসামিদের কোনো অনুশোচনা নেই, উল্টো সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে: চিফ প্রসিকিউটর

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

এলাকার খবর
Loading...