Ajker Patrika

বাইডেন ইসরায়েলকে অস্ত্র দেবেন, গাজায় ত্রাণও পাঠাবেন—   শান্তি তোলা থাক শিকায়

আবদুল বাছেদ
বাইডেন ইসরায়েলকে অস্ত্র দেবেন, গাজায় ত্রাণও পাঠাবেন—   শান্তি তোলা থাক শিকায়

হামাস–ইসরায়েল যুদ্ধ বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংকটের মধ্যে ফেলেছে। এক দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হামাসের বিরুদ্ধে লড়তে ইসরায়েলের জন্য যুদ্ধবিমান ও অস্ত্র পাঠাচ্ছেন, অন্য দিকে ইসরায়েলের বিমান হামলায় বিধ্বস্ত গাজাবাসীর জন্য ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন। বিষয়টি বাইডেনকে নৈতিক দিক থেকে দুর্বল ও ভঙ্গুর অবস্থানে নিয়ে গেছে। এটি তাঁর বক্তব্যেও ফুটে উঠছে। বাইডেনের জন্য এ ছাড়া কি কোনো পথ খোলা নেই?

গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বক্তব্য স্মরণকালের মধ্যে জোরালো ও বলিষ্ঠ ছিল। এদিন তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘সন্ত্রাসী সংগঠন হামাস দুনিয়ার সবচেয়ে ঘৃণ্য এক হামলা করেছে। তবে ইহুদিরা জানে, হয়তো সবার চেয়ে ভালো, যখন কেউ অন্যকে কষ্ট দিতে চায় তখন তার নিজের বঞ্চনারও শেষ থাকে না।’ 

গত ৭ অক্টোবরের হামলার ভয়াবহতা বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। একইভাবে ইসরায়েল এরপর যা শুরু করেছে গাজাবাসীর ওপর— দুই দেশেরই বেসামরিক নাগরিকদের বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে, এটি আরও কত দিন চলবে তার ইয়ত্তা নেই। 

গত বুধবার সিএনএনের সাংবাদিক অ্যান্ডারসন কুপার ২২ বছর বয়সী ইসরায়েলি চিকিৎসক অমিত মানের বোনদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। হামাস সেনারা যখন অমিতের প্রতিবেশীদের হত্যা করছিল তখন তিনি কিবুৎজের একটি ক্লিনিকে ছিলেন। তিনি সেখান থেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হোয়াটসঅ্যাপে পরিবারের সঙ্গে বার্তা আদান–প্রদান করেছেন। 

হামাস সেনাদের হাতে নিহত হওয়ার আগে অমিতকে তাঁর বোন বলেছিলেন, ‘মনে হয় না, আমি এখান থেকে বের হতে পারব। আমার কিছু হয়ে গেলে দয়া করে তোমরা শক্ত থেকো।’ 

অপরদিকে গাজায় ফিলিস্তিনিরা সন্তানদের নাম তাদের হাতের তালুতে বা পিঠে লিখবেন কি না তা নিয়ে আলোচনা করেছেন, যাতে ইসরায়েলি হামলায় মারা গেলে অন্তত তাদের লাশ সহজে খুঁজে পাওয়া যায় এবং পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে কবর দেওয়া যায়। 

মেলানি ওয়ার্ড অব মেডিকেল এইড ফর প্যালেস্টাইনের গাজা শাখার পরিচালক মাহমুদ শালাবি সন্তানদের কীভাবে চিহ্নিত করবেন তা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ক্রুকড মিডিয়াকে বলেন, ‘ইসরায়েলি হামলা দেখে মনে হচ্ছে, মানবতা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’ 

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকার কলামিস্ট রবিন অ্যাবক্যারিয়ান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে আমার জানাশোনা গড়পড়তা আমেরিকানদের মতোই। আমি যতটা পারি পড়ি ও দেখি। নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সাহায্যে দীর্ঘদিনের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে গভীরভাবে ভাবি। আমি উভয় পক্ষের চরমপন্থীদের সারকথা বের করার চেষ্টা করি। সেই বোঝাবুঝি থেকেই আমি আমেরিকান বাম এবং ডানপন্থীদের অযৌক্তিক সব প্রশ্ন এড়িয়ে যাই।’ 

রবিন অ্যাবক্যারিয়ান মনে করেন, পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই যা ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামাসের নৃশংসতার ন্যায্যতা দিতে পারে। এরপরও সিডনি অপেরা হাউসে গত সোমবার ইসরায়েল–বিরোধী বিক্ষোভে ‘ইহুদিদের গ্যাস দিয়ে মারো’ বলে স্লোগান শোনা গেছে। হামাসের হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে হার্ভার্ডের ছাত্ররা বিবৃতি দিয়েছে। এই সংঘাত এসব মানুষের মানবতা কেড়ে নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। 

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ডেভিড রথকফ আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সেলুনকে বলেছেন, ‘অনেকেই বিশ্বাস করতে পারে, ইসরায়েলিরা যেমন ফিলিস্তিনিদের অধিকার বহু বছর ধরে লঙ্ঘন করেছে, ঠিক তেমনি ফিলিস্তিনিদের একই আচরণ করার অধিকার রয়েছে। কেউ এমনটিও বিশ্বাস করতে পারে যে, গাজা বা পশ্চিম তীরে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা গুরুতর এবং বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের যোগ্য। কিন্তু আপনার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় মারা গেলে শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে গিয়ে আপনি কখনোই তার নিন্দা করবেন না। সে আপনার ক্ষতি করলেও অন্তত কয়েক দিন অপেক্ষা করবেন। তাই এটা সমালোচনা করার সময় নয়।’ 

‘তাই ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে কারওরই অধিকারকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। দুই জনগোষ্ঠীরই সুখে–শান্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করবার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের কখনোই ছাড় দেওয়া উচিত নয়।’ যোগ করেন ডেভিড রথকফ।

৯/১১–এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসী হতে গিয়ে বিরূপ ফল পাওয়ার কথা ইসরায়েলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশটিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর অতিমাত্রায় কঠোর না হতে সতর্ক করেছেন রথকফ। তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল বলেই মনে করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন করতে চায়, তবে আমাদের অবশ্যই ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা লাঘব করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে, যারা শক্তিশালী ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে, যেটিতে তাদের হাত নেই।’

এই মুহূর্তে, যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো বিকল্প আছে? রবিন মনে করেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর বাইডেন দিয়েছেন। ইহুদি–বিদ্বেষী ও ইসলাম–বিদ্বেষী উভয় গোষ্ঠীর নিন্দা করে বাইডেন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন ও অস্ত্র দেওয়া অব্যাহত রাখবে এবং ইসরায়েলের বিমান হামলার প্রভাব কমাতে এবং প্রসারিত করতে গাজায় মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা পাঠাবে। যেখানকার ২০ লাখেরও বেশি দরিদ্র বাসিন্দার খাদ্য, ওষুধ, জল এবং জ্বালানি বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল।’ 

ইসরায়েলের শান্তিতে থাকার এবং আত্মরক্ষার নিরঙ্কুশ অধিকার রয়েছে; ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার রয়েছে— এ কথার পুনরাবৃত্তি করে বাইডেন গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এই সংকট থেকে উত্তরণে আমরা দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশা ছেড়ে দিতে পারি না।’ 

তবে দ্য গার্ডিয়ানের কলামিস্ট মোস্তফা বায়োমি মনে করেন, ইসরায়েল–ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাইডেনের দ্বিমুখী আচরণ আমাদের নীতি–নৈতিকতাকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়েছে। 

বায়োমির ভাষায়, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টই নন, দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোও সত্যের অপলাপ করছে। তারা ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ‘দুটি রাষ্ট্রের’ সংঘাত বলে প্রচার করছে। কিন্তু আদতে ফিলিস্তিন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। এটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ! যদি তারা সত্যকেই তুলে ধরতে না পারে তবে তারা কী প্রচার করছে— প্রশ্ন রাখেন বায়োমি। 

দুই পক্ষের হতাহতই বায়োমিকে শোকাহত ও ভীত করে তোলে এ ভেবে যে, বিশ্বের কর্তাব্যক্তিদের দ্বিমুখী আচরণের কারণে আমরা ধীরে ধীরে এমন একটি যুগে প্রবেশ করছি যেখানে অস্ত্রের লড়াই–ই মুখ্য, রাজনৈতিক সমাধান নয়। যেখানে ফিলিস্তিনিরা জিতবে না কিন্তু তাদের ওপর নির্যাতনও শেষ হবে না। ইসরায়েলও টিকে থাকবে অতর্কিত হামলা আর রক্তপাতের ভয় নিয়ে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী আচরণই এর পেছনে দায়ী বলে মনে করেন বায়োমি। 

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে সেনাসদস্যের বাড়িতে হামলা-আগুন দেওয়ার অভিযোগ

ফেসবুকে কমেন্টের জেরে বাড়িতে গিয়ে হুমকি, পরদিন ঢাবি শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ

সরকারি অফিসে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ, নারীসহ গ্রেপ্তার ৩

বাংলাদেশ অধিনায়কের হাতে যে কারণে ‘তামিম নিখোঁজ’ প্ল্যাকার্ড

পশ্চিমবঙ্গের ভোটার জুলাই আন্দোলনে, ভারতে বিজেপি শিবিরে হইচই

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত