হুসাইন আহমদ
‘রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ’ বা পারস্পরিক শুল্ক ঘোষণা করে বিশ্বে বাণিজ্যযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর দাবি, এত দিন শিথিলতার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে বিপুল পরিমাণ শুল্ক আরোপ করেছে প্রধান প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশ বা অঞ্চল। এর ফলে সেই দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। সেই বাণিজ্য ঘাটতি শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে তিনি পারস্পরিক শুল্কহার ঘোষণা করেছেন। তবে ‘তিনি যেহেতু দয়ালু’, তাই নামে পারস্পরিক হলেও ওই দেশগুলো যে হারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক আরোপ করে, তিনি তাঁর ‘মাত্র অর্ধেক’ আরোপ করেছেন।
মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ট্রাম্পের অনুমোদিত ‘জটিল সূত্র’ অনুসরণ করে প্রতিটি দেশের জন্য এই শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে ট্রাম্পও বলেছেন, তাঁর প্রশাসন প্রতিটি দেশের জন্য কত শুল্কহার হবে, তা নির্ধারণ করছে। সেটা করতে গিয়ে কী পরিমাণ বেগ পেতে হয়েছে, তা বোঝাতে গ্রিক প্রতীকে দৃশ্যত জটিল এক ফর্মুলা বা সূত্রও হাজির করেছে তাঁরা। কিন্তু আদতে এটি জটিল নয়, অত্যন্ত সহজ হিসাব— মনগড়া বলা যায়। প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা শুল্কহার ধরতে হলে সুনির্দিষ্ট দেশে মার্কিন পণ্যের ওপর ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর এবং যত ধরনের অশুল্ক বাধা আছে, তা বিবেচনায় নিতে হতো। কিন্তু তাঁরা ভ্যাট বা অশুল্ক বাধা বিবেচনাই করেনি। বাস্তবে ট্রাম্প প্রশাসন সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে আছে কেবল আমদানি ও বাণিজ্য ঘাটতির হিসাব। ট্রাম্পের ‘রিসিপ্রক্যাল ট্যারিফে’ সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো গণনার সূত্র।
চলুন দেখি, কীভাবে এটি মিথ্যাচার। কোনো দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি মূল্য দিয়ে ভাগ করে সেটিকে শতাংশে রূপান্তর করা হয়েছে। আর এই সংখ্যাকে ওই দেশের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্কহার বলে দাবি করছে ট্রাম্প প্রশাসন। গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে তালিকা দেখিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের বাজারে যুক্তরাষ্ট্র ৭৪ শতাংশ শুল্ক দেয় বলে দাবি করা হয়েছে। একই ফর্মুলায় হিসাব করে চীন ৬৭ শতাংশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কিন পণ্যে ৩৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে বলে দেখানো হয়েছে। ট্রাম্পের দাবি, মার্কিন পণ্য বাংলাদেশে ৭৪ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হলেও তিনি ‘দরদ’ দেখিয়ে এর অর্ধেক শুল্ক আরোপ করছেন। একইভাবে অর্ধেক কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২০ ও চীনে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছেন।
কিন্তু এই হিসাব ট্রাম্প কোথা থেকে পেলেন, তার কোনো হদিস এখনো মেলেনি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যে গড় প্রযোজ্য শুল্কহার ছিল ১৪.১ শতাংশ। অথচ ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি ৭৪ শতাংশ। চীনে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইইউতে ৫ শতাংশ। সুতরাং, ডব্লিউটিওর তথ্যের সঙ্গে ট্রাম্পের দাবির আকাশ-পাতাল ফারাক। ট্রাম্প প্রশাসনের এই তথাকথিত জটিল শুল্কহার আসলে প্রতারণা।
এখন ট্রাম্প ডব্লিউটিওকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছামতো শুল্ক আরোপ করতে চাইতেই পারেন, সেটা প্রমাণের কিছু নাই। কিন্তু অন্য দেশে কত শতাংশ শুল্ক তাকে দিতে হয়, সেই হিসাব স্পষ্ট করতে হবে। কেবল বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি দিয়ে ভাগ করে সেই হার কীভাবে বের হয়, তা বোধগম্য নয়।
‘পারস্পরিক শুল্কহার’ বের করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন যে সূত্র তুলে ধরেছেন, তা বিশ্লেষণ করলেও এর অসারতার প্রমাণ মেলে। সূত্রে বিভাজকের ওপরে লব অংশে আছে নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি। নিচের হর অংশ কিছুটা জটিল দেখালেও আসলে খুব সহজ। সেখানে আমদানিকে শুল্ক সংবেদনশীলতা ও মূল্য সংবেদনশীলতার হার দিয়ে গুণ করা হয়েছে, যা আসলে আমদানি মূল্য ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, শুল্ক সংবেদনশীলতার মান ধরা হয়েছে ০.২৫ এবং মূল্য সংবেদনশীলতার মান ধরা হয়েছে ৪। এখন (০.২৫ × ৪) বা ১-এর সঙ্গে আপনি যা-ই গুণ করেন, ফলাফল সেটিই আসবে। সুতরাং সূত্রের নিচের অংশ নিছক আমদানির পরিমাণ, কিন্তু প্রকাশ করা হয়েছে জটিল করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৬২০ কোটি ডলার। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৮৪০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। ট্রাম্পের সূত্র মোতাবেক বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি দিয়ে ভাগ করে ০.৭৩৮০ পাওয়া যায়, শতাংশ হিসেবে যা ৭৩.৮০ বা ৭৪।
চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ফর্মুলা প্রয়োগ করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে বা ঘাটতি সামান্য, সেগুলোর জন্য সর্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তাঁদের হিসাবে নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা অশুল্ক বাধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেই তাকে ‘অন্যায্য বাণিজ্যনীতি, প্রতারণা ও কারসাজি’ হিসেবে ধরে নিয়ে তৈরি ট্রাম্প প্রশাসনের এই মডেল। কিন্তু এই ধারণা ভিত্তিহীন। শুধু প্রতারণার কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি হয় না, বরং অর্থনৈতিক নানা কারণ ও বাজার পরিস্থিতিও এতে ভূমিকা রাখে।
মার্কিন নথি অনুসারে সমন্বিত এই শুল্কহার নির্ধারণে পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করার কথা। এক. যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর সংশ্লিষ্ট দেশ কী ধরনের শুল্ক আরোপ করেছে। দুই. যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য, শ্রমিক ও ভোক্তাদের ওপর ভ্যাটসহ অন্যায্য বা বৈষম্যমূলক কর। তিন. অশুল্ক বাধা, ভর্তুকি ও কঠোর নীতিমালা। চার. মার্কিনদের জন্য ক্ষতিকর মুদ্রা বিনিময় নীতি, সস্তা শ্রমসহ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপ্রতিযোগিতামূলক সুবিধা। পাঁচ. অন্য যেকোনো ধরনের ‘অন্যায্য’ বাণিজ্যচর্চা।
এসব বিবেচনায় নিলে ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে প্রায় যেকোনো দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করা হতো। কিন্তু বাস্তবে এই নীতি প্রয়োগ করা হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন এমনকি প্রতিটি দেশের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা পরিমাপের চেষ্টাও করেনি।
ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, ‘আমি খুব শিগগির এমন এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছি, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করবে। পারস্পরিক মানে তারা আমাদের সঙ্গে যা করে, আমরাও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করব। এটি খুব সহজ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের সব শুল্ক, অশুল্ক বাধা ও প্রতারণামূলক কার্যক্রমের হিসাব বের করব। তবে আমরা দয়ালু বলে তাদের যা দিই, তার মাত্র অর্ধেক শুল্ক বসাব।’
কিন্তু বুধবার রাতে ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কের যে সূত্রটির মডেল প্রকাশ করেছে, তাতে অর্ধেক শুল্ক ধরা হলেও শুল্ক নির্ধারণের পদ্ধতিই যে বিভ্রান্তিকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পারস্পরিক শুল্ক নির্ধারণের এই পদ্ধতি যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ‘ইলাস্টিসিটি’ বা মূল্য সংবেদনশীলতা ও ‘পাস-থ্রু’ অর্থাৎ, উৎপাদন ব্যয়ের প্রভাবে পণ্য বা সেবার দাম বৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক ধারণা ব্যবহারের কারণে এটিকে দৃশ্যত জোরালো মনে হলেও বাণিজ্য ঘাটতিকে সরাসরি শুল্ক ও অশুল্ক বাধার প্রতিফলন হিসেবে ধরার ভুল সেখানে রয়েছে।
বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি দিয়ে ভাগ করে বের করা সরলীকৃত সূত্রটি প্রকৃত বাণিজ্য বাধাগুলো আড়াল করে এবং বাণিজ্যের জটিল গতিশীলতা উপেক্ষা করে। পাশাপাশি এই প্রবণতা ভোক্তার পণ্য বা সেবার আকাশচুম্বী দাম ও বাণিজ্য অংশীদারদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির ঝুঁকি সৃষ্টি করে। নিছক পণ্য বাণিজ্যে মনোযোগ, নির্বিচার প্যারামিটার বাছাই এবং বিস্তৃত অর্থনৈতিক উপাদান উপেক্ষার কারণে এই পদ্ধতির যৌক্তিক ভিত্তি অনেক দুর্বল। বাণিজ্য ঘাটতির কার্যকর সমাধানের জন্য আরও সূক্ষ্ম ও প্রমাণভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
জেমস সুরোউইকি ও নেট সিলভার মতো মার্কিন পরিসংখ্যানবিদেরা ট্রাম্পের এই ‘অতিসরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনার’ সমালোচনা করেছেন। নেট সিলভার এক্সে (টুইটার) লিখেছেন, ‘এটি (ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কের সূত্র) একেবারেই হাস্যকর! এটি এমন একাডেমিক গবেষণার মতো, যেখানে মিথ্যা দাবি আড়াল করতে গ্রিক অক্ষর ব্যবহার করা হয়।’
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
‘রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ’ বা পারস্পরিক শুল্ক ঘোষণা করে বিশ্বে বাণিজ্যযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর দাবি, এত দিন শিথিলতার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে বিপুল পরিমাণ শুল্ক আরোপ করেছে প্রধান প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশ বা অঞ্চল। এর ফলে সেই দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। সেই বাণিজ্য ঘাটতি শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে তিনি পারস্পরিক শুল্কহার ঘোষণা করেছেন। তবে ‘তিনি যেহেতু দয়ালু’, তাই নামে পারস্পরিক হলেও ওই দেশগুলো যে হারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক আরোপ করে, তিনি তাঁর ‘মাত্র অর্ধেক’ আরোপ করেছেন।
মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ট্রাম্পের অনুমোদিত ‘জটিল সূত্র’ অনুসরণ করে প্রতিটি দেশের জন্য এই শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে ট্রাম্পও বলেছেন, তাঁর প্রশাসন প্রতিটি দেশের জন্য কত শুল্কহার হবে, তা নির্ধারণ করছে। সেটা করতে গিয়ে কী পরিমাণ বেগ পেতে হয়েছে, তা বোঝাতে গ্রিক প্রতীকে দৃশ্যত জটিল এক ফর্মুলা বা সূত্রও হাজির করেছে তাঁরা। কিন্তু আদতে এটি জটিল নয়, অত্যন্ত সহজ হিসাব— মনগড়া বলা যায়। প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা শুল্কহার ধরতে হলে সুনির্দিষ্ট দেশে মার্কিন পণ্যের ওপর ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর এবং যত ধরনের অশুল্ক বাধা আছে, তা বিবেচনায় নিতে হতো। কিন্তু তাঁরা ভ্যাট বা অশুল্ক বাধা বিবেচনাই করেনি। বাস্তবে ট্রাম্প প্রশাসন সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে আছে কেবল আমদানি ও বাণিজ্য ঘাটতির হিসাব। ট্রাম্পের ‘রিসিপ্রক্যাল ট্যারিফে’ সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো গণনার সূত্র।
চলুন দেখি, কীভাবে এটি মিথ্যাচার। কোনো দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি মূল্য দিয়ে ভাগ করে সেটিকে শতাংশে রূপান্তর করা হয়েছে। আর এই সংখ্যাকে ওই দেশের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্কহার বলে দাবি করছে ট্রাম্প প্রশাসন। গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে তালিকা দেখিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের বাজারে যুক্তরাষ্ট্র ৭৪ শতাংশ শুল্ক দেয় বলে দাবি করা হয়েছে। একই ফর্মুলায় হিসাব করে চীন ৬৭ শতাংশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কিন পণ্যে ৩৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে বলে দেখানো হয়েছে। ট্রাম্পের দাবি, মার্কিন পণ্য বাংলাদেশে ৭৪ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হলেও তিনি ‘দরদ’ দেখিয়ে এর অর্ধেক শুল্ক আরোপ করছেন। একইভাবে অর্ধেক কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২০ ও চীনে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছেন।
কিন্তু এই হিসাব ট্রাম্প কোথা থেকে পেলেন, তার কোনো হদিস এখনো মেলেনি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যে গড় প্রযোজ্য শুল্কহার ছিল ১৪.১ শতাংশ। অথচ ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি ৭৪ শতাংশ। চীনে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইইউতে ৫ শতাংশ। সুতরাং, ডব্লিউটিওর তথ্যের সঙ্গে ট্রাম্পের দাবির আকাশ-পাতাল ফারাক। ট্রাম্প প্রশাসনের এই তথাকথিত জটিল শুল্কহার আসলে প্রতারণা।
এখন ট্রাম্প ডব্লিউটিওকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছামতো শুল্ক আরোপ করতে চাইতেই পারেন, সেটা প্রমাণের কিছু নাই। কিন্তু অন্য দেশে কত শতাংশ শুল্ক তাকে দিতে হয়, সেই হিসাব স্পষ্ট করতে হবে। কেবল বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি দিয়ে ভাগ করে সেই হার কীভাবে বের হয়, তা বোধগম্য নয়।
‘পারস্পরিক শুল্কহার’ বের করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন যে সূত্র তুলে ধরেছেন, তা বিশ্লেষণ করলেও এর অসারতার প্রমাণ মেলে। সূত্রে বিভাজকের ওপরে লব অংশে আছে নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি। নিচের হর অংশ কিছুটা জটিল দেখালেও আসলে খুব সহজ। সেখানে আমদানিকে শুল্ক সংবেদনশীলতা ও মূল্য সংবেদনশীলতার হার দিয়ে গুণ করা হয়েছে, যা আসলে আমদানি মূল্য ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, শুল্ক সংবেদনশীলতার মান ধরা হয়েছে ০.২৫ এবং মূল্য সংবেদনশীলতার মান ধরা হয়েছে ৪। এখন (০.২৫ × ৪) বা ১-এর সঙ্গে আপনি যা-ই গুণ করেন, ফলাফল সেটিই আসবে। সুতরাং সূত্রের নিচের অংশ নিছক আমদানির পরিমাণ, কিন্তু প্রকাশ করা হয়েছে জটিল করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৬২০ কোটি ডলার। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৮৪০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। ট্রাম্পের সূত্র মোতাবেক বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি দিয়ে ভাগ করে ০.৭৩৮০ পাওয়া যায়, শতাংশ হিসেবে যা ৭৩.৮০ বা ৭৪।
চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ফর্মুলা প্রয়োগ করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে বা ঘাটতি সামান্য, সেগুলোর জন্য সর্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তাঁদের হিসাবে নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা অশুল্ক বাধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেই তাকে ‘অন্যায্য বাণিজ্যনীতি, প্রতারণা ও কারসাজি’ হিসেবে ধরে নিয়ে তৈরি ট্রাম্প প্রশাসনের এই মডেল। কিন্তু এই ধারণা ভিত্তিহীন। শুধু প্রতারণার কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি হয় না, বরং অর্থনৈতিক নানা কারণ ও বাজার পরিস্থিতিও এতে ভূমিকা রাখে।
মার্কিন নথি অনুসারে সমন্বিত এই শুল্কহার নির্ধারণে পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করার কথা। এক. যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর সংশ্লিষ্ট দেশ কী ধরনের শুল্ক আরোপ করেছে। দুই. যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য, শ্রমিক ও ভোক্তাদের ওপর ভ্যাটসহ অন্যায্য বা বৈষম্যমূলক কর। তিন. অশুল্ক বাধা, ভর্তুকি ও কঠোর নীতিমালা। চার. মার্কিনদের জন্য ক্ষতিকর মুদ্রা বিনিময় নীতি, সস্তা শ্রমসহ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপ্রতিযোগিতামূলক সুবিধা। পাঁচ. অন্য যেকোনো ধরনের ‘অন্যায্য’ বাণিজ্যচর্চা।
এসব বিবেচনায় নিলে ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে প্রায় যেকোনো দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করা হতো। কিন্তু বাস্তবে এই নীতি প্রয়োগ করা হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন এমনকি প্রতিটি দেশের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা পরিমাপের চেষ্টাও করেনি।
ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, ‘আমি খুব শিগগির এমন এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছি, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করবে। পারস্পরিক মানে তারা আমাদের সঙ্গে যা করে, আমরাও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করব। এটি খুব সহজ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের সব শুল্ক, অশুল্ক বাধা ও প্রতারণামূলক কার্যক্রমের হিসাব বের করব। তবে আমরা দয়ালু বলে তাদের যা দিই, তার মাত্র অর্ধেক শুল্ক বসাব।’
কিন্তু বুধবার রাতে ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কের যে সূত্রটির মডেল প্রকাশ করেছে, তাতে অর্ধেক শুল্ক ধরা হলেও শুল্ক নির্ধারণের পদ্ধতিই যে বিভ্রান্তিকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পারস্পরিক শুল্ক নির্ধারণের এই পদ্ধতি যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ‘ইলাস্টিসিটি’ বা মূল্য সংবেদনশীলতা ও ‘পাস-থ্রু’ অর্থাৎ, উৎপাদন ব্যয়ের প্রভাবে পণ্য বা সেবার দাম বৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক ধারণা ব্যবহারের কারণে এটিকে দৃশ্যত জোরালো মনে হলেও বাণিজ্য ঘাটতিকে সরাসরি শুল্ক ও অশুল্ক বাধার প্রতিফলন হিসেবে ধরার ভুল সেখানে রয়েছে।
বাণিজ্য ঘাটতিকে আমদানি দিয়ে ভাগ করে বের করা সরলীকৃত সূত্রটি প্রকৃত বাণিজ্য বাধাগুলো আড়াল করে এবং বাণিজ্যের জটিল গতিশীলতা উপেক্ষা করে। পাশাপাশি এই প্রবণতা ভোক্তার পণ্য বা সেবার আকাশচুম্বী দাম ও বাণিজ্য অংশীদারদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির ঝুঁকি সৃষ্টি করে। নিছক পণ্য বাণিজ্যে মনোযোগ, নির্বিচার প্যারামিটার বাছাই এবং বিস্তৃত অর্থনৈতিক উপাদান উপেক্ষার কারণে এই পদ্ধতির যৌক্তিক ভিত্তি অনেক দুর্বল। বাণিজ্য ঘাটতির কার্যকর সমাধানের জন্য আরও সূক্ষ্ম ও প্রমাণভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
জেমস সুরোউইকি ও নেট সিলভার মতো মার্কিন পরিসংখ্যানবিদেরা ট্রাম্পের এই ‘অতিসরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনার’ সমালোচনা করেছেন। নেট সিলভার এক্সে (টুইটার) লিখেছেন, ‘এটি (ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্কের সূত্র) একেবারেই হাস্যকর! এটি এমন একাডেমিক গবেষণার মতো, যেখানে মিথ্যা দাবি আড়াল করতে গ্রিক অক্ষর ব্যবহার করা হয়।’
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রবাদ আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। চলুন দেখি, এই দুই রাজার যুদ্ধে কার প্রাণ যায়! ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজ দেশে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যে ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক আর
১৫ ঘণ্টা আগেদখলকৃত অর্থনীতিতে প্রতিভা এবং সাফল্যের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই এমন দক্ষ কর্মীরা দেশ ছেড়ে চলে যান এবং সক্ষম সংস্থাগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়। অন্যদিকে, ভালো যোগাযোগ আছে এমন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবন বা মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করা ছাড়াই (বা কখনো কখনো পণ্য সরবরাহ না করেও)
১ দিন আগেআরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সমান নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। এটি বরাবরই তীব্র বিতর্কের বিষয় ছিল। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও তৎপরতা এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে।
২ দিন আগেমিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের অধিকাংশ এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। বলতে গেলে মিয়ানমারের অধিকাংশ এলাকাই এখন বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। জান্তা সরকার অনেকখানিই দুর্বল। ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়টি এখন আর শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয় নয়। খোদ সরকারি কর্মকর্তারাও এই...
২ দিন আগে