Ajker Patrika

প্রথম বিশ্ব ভ্রমণকারী নারী, ওমরাহ করেছিলেন পুরুষের বেশে

জাহাঙ্গীর আলম
Thumbnail image

নাম তাঁর ইদ্রিস গ্যালসিয়া হল। ১৯০৬ সালের ১৩ অক্টোবর কানাডার উইনিপেগ শহরে জন্ম। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হার্বার্ট হল এবং মার্গারেট হেডলি হল দম্পতির কন্যা। পরবর্তীতে অবশ্য অ্যালোহা ওয়ান্ডারওয়েল নামেই বিখ্যাত হয়েছেন। 

 ১৯১৭ সালের জুনে যুদ্ধক্ষেত্রে বাবার মৃত্যুর পর মা ইদ্রিস গ্যালসিয়া ও তাঁর ছোট বোনকে নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে আগে ইদ্রিস ফ্রান্সের একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। 

বাবার মৃত্যু ইদ্রিসের কচি মনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। অত্যন্ত অস্থির প্রকৃতির ছিলেন। স্কুলে সিনিয়রদের সঙ্গে প্রায়ই ঝামেলায় জড়াতেন। ৬ ফুট উচ্চতার উচ্ছল প্রাণময় কিশোরী ইদ্রিসকে তারা ‘টমবয়’ বলে সম্বোধন করত। শান্ত সৌম্য সামাজিক কিশোরীতে রূপান্তরিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন স্কুলের সিনিয়র শিক্ষার্থী ও মুরব্বিরা। কিন্তু ইদ্রিস এসব কখনোই গায়ে মাখেননি। বরং বাবার ছেলেবেলার প্রিয় সংগ্রহ থেকে চমৎকার গল্পের বইগুলোতে বুঁদ হয়ে থাকতেন। সেসব গল্প ছিল ‘পুরুষালি’ অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর। ইদ্রিস সেসব গল্পে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন। তখন থেকেই পৃথিবীর দূর প্রান্তে ভ্রমণে যাওয়া, অ্যাডভেঞ্চার আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। 

১৯২২ সালে ইদ্রিসের বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর, প্যারিস হেরাল্ড পত্রিকার রিভেরা সংস্করণে একটি বিজ্ঞাপন তার নজর কাড়ে: ‘বুদ্ধি, সৌন্দর্য এবং পাজামা—ভাগ্যবান যুবতীর জন্য বিশ্ব ভ্রমণের সুযোগ...অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দিতে চান...এশিয়া, আফ্রিকা...।’ 

কিশোরী ইদ্রিসের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে এই বিজ্ঞাপন। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ‘ক্যাপ্টেন’ ওয়াল্টার ওয়ান্ডারওয়েলের নেতৃত্বে একটি উচ্চাভিলাষী বিশ্ব ভ্রমণের জন্য সেক্রেটারি এবং ড্রাইভার পদে আবেদন করেন ইদ্রিস। ক্যাপ্টেন ওয়াল্টারের প্রকৃত নাম ভ্যালেরিয়ান জোহানেস পিসিনস্কি। পোল্যান্ডের নাগরিক তিনি। 

ক্যাপ্টেন ওয়াল্টার ওয়ান্ডারওয়েল।একজন সাবেক নাবিক, বিশ্বমানের পর্বতারোহী এবং ভ্রমণকারী ক্যাপ্টেন ওয়াল্টার। যুদ্ধের সময় গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের জেলে কাটিয়েছেন কিছুদিন। বিশ্ব শান্তি ও লিগ অব নেশনসের (বর্তমানে জাতিসংঘ) প্রচারের অংশ হিসেবে ১৯১৯ সালে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। 

ওয়ার্ক অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড এডুকেশনাল ক্লাব (ডব্লিউএডব্লিউই) নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন ওয়াল্টার এবং তাঁর তৎকালীন স্ত্রী নেল। ‘মিলিয়ন ডলারের বাজির’ আয়োজন করেন তাঁরা। 

নেল এবং ওয়াল্টার বিশ্বভ্রমণ অভিযানে প্রতিযোগী দলগুলোর নেতৃত্ব দিতেন। কোন দল সবচেয়ে বেশি মাইল ভ্রমণ করতে পারে—এটাই ছিল প্রতিযোগিতা। আর এই ভ্রমণের অর্থ জোগাড় করা হতো স্যুভেনির প্যাম্ফলেট বিক্রি, বক্তৃতা, রাস্তায় শুট ও সম্পাদনা করা চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শন থেকে পাওয়া আয় দিয়ে। 

 ১৯২২ সাল নাগাদ ইদ্রিস প্যারিস হেরাল্ডের বিজ্ঞাপনটির যখন জবাব দেন, তার অনেক আগেই ওয়াল্টার এবং নেল আলাদা হয়ে হয়ে গেছেন। নেলের দল তখন যুক্তরাষ্ট্রে সফর করছিল। ওয়াল্টার একটি কাস্টমাইজ করা ফোর্ড গাড়িতে ইউরোপ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর দরকার ছিল ফরাসি ভাষায় সাবলীল একজন নতুন ক্রু মেম্বার। 

ইদ্রিসের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁর উচ্ছলতা, আগ্রহ ও সাহস দেখে অভিভূত হন ওয়াল্টার। এক কথায় তাঁকে ক্রু হিসেবে নেন। ওই সময়ই ইদ্রিসের একটি নতুন মঞ্চ নাম দেন ওয়াল্টার: অ্যালোহা ওয়ান্ডারওয়েল। 

মায়ের অনুমতি নিয়ে ওয়াল্টারের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন অ্যালোহা। দ্রুতই সবার আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসেন। রাতারাতি তারকা বনে যান তিনি। 

রাস্তায় রাস্তায় জীবনের কঠোরতার সঙ্গে সহজেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন অ্যালোহা। ভ্রমণের বিবরণ নির্মাণেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। অভিনেত্রী, ফটোগ্রাফার, সিনেমাটোগ্রাফার, ড্রাইভার, সেলাই, লন্ড্রি, চলচ্চিত্র সম্পাদনা, বিচিত্রানুষ্ঠানের পারফরমার, বিক্রয়কর্মী, দোভাষী, আলোচক, মেকানিক...এবং ক্যাপ্টেন ওয়াল্টারের চাপিয়ে দেওয়া অন্য যে কোনো কাজ দক্ষতার সঙ্গে করেছেন তিনি। 

চারটি মহাদেশের ৪৩টি দেশের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেছেন ওয়াল্টার-অ্যালোহা। ভয়ংকর দুঃসাহসিক কাজ ছিল সেটি। 

তাঁরা ফ্রান্স এবং দেশটির যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছিলেন...মুসোলিনি এবং ফ্যাসিবাদীরা যখন শক্তি সুসংহত করছিল ঠিক তখনই ইতালির ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। এ ছাড়া জার্মানিতে তখন খাদ্য সংকট নিয়ে দাঙ্গা এবং উগ্র আগ্রাসী জনতার দাপট, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্ররা তখন ক্ষতিপূরণ দাবি করছে—এ পরিস্থিতিতে জার্মানির ভেতর দিয়ে যাত্রা.মিসরেররের রাজাদের উপত্যকায় গ্রেট স্ফিংক্সের পাদদেশে তাঁরা শিবির স্থাপন করেছিলেন…ফিলিস্তিন যেখানে ইহুদিরা বসতি গড়ার চেষ্টা করছে… ভারতের বিস্তীর্ণ বালুময় এলাকা, তাঁদের ফোর্ড গাড়িটি নদী পার করিয়ে দিয়েছিল জল মহিষ। 

গাড়িতে চালিয়ে বিশ্ব ভ্রমণে অ্যালোহা। ছবি: অ্যালোহা ওয়ান্ডারওয়েল ডটকমঅ্যালোহা পর্তুগিজ উপনিবেশ-পূর্ব আফ্রিকার ভূমি পেরিয়েছিলেন এবং সুদানের মরুভূমিতে তৃষ্ণায় প্রায় মরতে বসেছিলেন…এর মধ্যে পুরুষের ছদ্মবেশে মক্কায় গিয়েছিলেন, সেখানে ওমরাহ পালন করেন… ইন্দো-চীনে হাতি শিকার করেছিলেন, চীনা দস্যুদের সঙ্গে ভাব করেছিলেন এবং এমনকি সাইবেরিয়ার রেড আর্মিতে অনারারি কর্নেল উপাধি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে...হলিউড সফরের সময় মেরি পিকফোর্ড এবং ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কসের সঙ্গে গলায়-গলায় সম্পর্ক হয়েছিল। 

অ্যালোহা পুরুষের বেশে মক্কায় ওমরাহ পালন করেন, কারণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী কোনো নারী একা সফর করতে পারেন না। 

এই দীর্ঘ ভ্রমণের মধ্যে অ্যালোহা ক্যাপ্টেন ওয়াল্টারের প্রেমে পড়েন। তখনো কিন্তু ওয়াল্টার তাঁর প্রথম স্ত্রী নেলের কাছ থেকে ডিভোর্স পাননি। যুক্তরাষ্ট্রে আগমনের পর, ওয়াল্টারকে ‘শ্বেতাঙ্গ দাসত্বের’ অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। বিবাহ বিচ্ছেদে সুবিধা আদায়ের জন্য নেলই যে এই চক্রান্ত করেছিলেন, সেটি পরে প্রমাণিত হয়। 

অবশেষে অ্যালোহা এবং ওয়াল্টার ক্যালিফোর্নিয়ায় বিয়ে করেন। তাঁদের দুটি সন্তান হয়—নিল এবং ভ্যালরি। 

অ্যালোহা ওয়ান্ডারওয়েল ও ক্যাপ্টেন ওয়াল্টার ওয়ান্ডারওয়েল দম্পতি। ১৯২৯ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে প্রাথমিক অভিযাত্রা শেষ করেন ওয়াল্টার-অ্যালোহা জুটি। তাঁদের তথ্যচিত্র ‘উইথ কার অ্যান্ড ক্যামেরা অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশের পর আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। 

প্রাথমিক অভিযানটি আমাজন অববাহিকার মাটা গ্রোসো অঞ্চলের গভীরে একটি অসাধারণ দুঃসাহসিক কাজ ছিল। তাঁদের বহনকারী বিমানটি অজানা জঙ্গলে অবতরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। অ্যালোহাকে একটি আদিবাসীর সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। আর ওয়াল্টার ধীরে ধীরে সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের উপায় বের করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে তাঁদের কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। 

চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী অ্যালোহা নেটিভদের মুগ্ধ করেছিলেন। সেখানে তিনি প্রচুর ছবি তোলেন, তাঁদের জীবনযাপন নথিভুক্ত করেন। তাঁর চলচ্চিত্র—ফ্লাইট টু দ্য স্টোন এজ বোরোরোস, ছিল বোরোরো উপজাতির প্রথম চিত্রিত রেকর্ড। এটি এখন স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের মানব স্টাডিজ আর্কাইভের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক সম্পদ। 

১৯৩১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পর ওয়াল্টার আরও অভিযান ও চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু এর আগেই ঘটে যায় এক ট্যাজেডি।

অ্যালোহা ওয়ান্ডারওয়েল বেকার। প্রথম স্বামীর মৃত্যু ও দ্বিতীয় বিয়ের পর। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচে অ্যালোহা দম্পতির ‘দ্য কারমা’ নামের প্রমোদতরীতে আততায়ী হামলা করে। ক্যাপ্টেন ওয়াল্টার গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। সন্দেহভাজন একজনকে আটকও করা হয়। কিন্তু পরে তিনি খালাস পান। ওয়াল্টার হত্যাকাণ্ড পশ্চিম উপকূলে সবচেয়ে বিখ্যাত অমীমাংসিত অপরাধগুলোর একটি।

ওয়াল্টারের মৃত্যুর পর অ্যালোহা ১৯৩৩ সালে ওয়াল্টার বেকারকে বিয়ে করেন। তিনি ডব্লিউএডব্লিউসি-এর সাবেক ক্যামেরাম্যান। 

নতুন স্বামীর সঙ্গে ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন অ্যালোহা। প্রচুর অনুসন্ধানী কাজ, তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেন। ‘আলোহা ওয়ান্ডারওয়েল, দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ট্রাভেলড গার্ল’ নামে খ্যাতি পান। তাঁর সময় একজন নারীর এমন দুঃসাহসিক কাজ ও বহুমুখী প্রতিভা একটি বিরল ঘটনা। 

আমাজনে বোরোরো আদিবাসীর সঙ্গে অ্যালোহা ওয়ান্ডারওয়েল। পরবর্তী বছরগুলোতে অ্যালোহা ভ্রমণের নেশা ত্যাগ করে চলচ্চিত্র, ফটো, জার্নাল এবং অমূল্য শিল্পকর্ম সংগ্রহের দিকে ঝোঁকেন। তাঁর বেশিরভাগ কাজ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন জাদুঘর এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আছে। 

১৯৯৬ সালের ৪ জুন ক্যালিফোর্নিয়ার নিউপোর্ট বিচে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অ্যালোহা ওয়ান্ডারওয়েল ওরফে ইদ্রিস হল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত