ইজাজুল হক

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:
ইজাজুল হক

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:

ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক সম্রাট কে? হয়তো আপনি পাবলো এস্কোবার বা এল চ্যাপোর নাম বলবেন, কিন্তু আপনি ভুল! তাঁদের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে এমন একজন অবিশ্বাস্য ক্ষমতাধর নারী ছিলেন, যিনি বিশাল এক মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কাছে একালের এস্কোবার এবং এল চ্যাপোকে ছ্যাঁচড়া মাদককারবারি মনে হবে।
১ দিন আগে
শিশুসাহিত্যে চিলড্রেনস বুকার পুরস্কার চালু করেছে বুকার পুরস্কার ফাউন্ডেশন। আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার চালু হবে এবং প্রথম বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে ২০২৭ সালের শুরুর দিকে। ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী পাঠকদের জন্য লেখা সেরা কথাসাহিত্যের জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৫ টাকা) দেওয়া
১ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকায় খুব কম দোকানেই মিলত গ্রিল চিকেন। এ তালিকার শীর্ষে হয়তো অনেকে রাখতে পারেন সায়েন্স ল্যাবের ছায়ানীড় কনফেকশনারি অ্যান্ড ফাস্ট ফুড নামের রেস্তোরাঁটিকে। এখন তো বহু রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায় খাবারটি। কিন্তু ছায়ানীড়ের গ্রিল চিকেন কিংবা চিকেন শর্মার কাছে হয়তো স্বাদে হেরে যেতে...
২ দিন আগে
আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, কবি-লেখক চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ নামেই বিখ্যাত। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন শচীমোহন গোপ, যিনি পঞ্চাশের দশকে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক মোড়ে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক সম্রাট কে? হয়তো আপনি পাবলো এস্কোবার বা এল চ্যাপোর নাম বলবেন, কিন্তু আপনি ভুল! তাঁদের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে এমন একজন অবিশ্বাস্য ক্ষমতাধর নারী ছিলেন, যিনি বিশাল এক মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কাছে একালের এস্কোবার এবং এল চ্যাপোকে ছ্যাঁচড়া মাদককারবারি মনে হবে। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে কিন্তু কখনো গহিন অরণ্যের আস্তানায় সশস্ত্র রক্ষীবেষ্টিত হয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়নি। তাঁর মাদক কারবারের আয় গোটা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখত। আর তাঁকে কখনো জেলে যাওয়ার চিন্তা করতে হয়নি। কারণ, মাদক-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা যাঁদের ছিল, তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁর বেতনভুক্ত কর্মচারী!
তিনি আর কেউ নন, তিনি রানি ভিক্টোরিয়া। তাঁর হাতে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দণ্ড।
রানি ভিক্টোরিয়া শুধু সাম্রাজ্য পরিচালনাতেই মাদক ব্যবহার করেননি, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন বিভিন্ন ধরনের ড্রাগের ভক্ত। সিংহাসনে আরোহণের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।
ভিক্টোরিয়ার অন্যতম প্রিয় মাদক ছিল আফিম। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে আফিম সেবনের ফ্যাশনেবল উপায় ছিল—অ্যালকোহলের সঙ্গে মিশিয়ে লডেনাম আকারে পান করা। তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি দূর করতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এমনকি দাঁত ওঠার সময় শিশুদের জন্যও এটি সুপারিশ করতেন চিকিৎসকেরা। রানি ভিক্টোরিয়াও প্রতিদিন সকালে এক ঢোক লডেনাম পান করে দিন শুরু করতেন।
এ ছাড়া তিনি সেবন করতেন কোকেন। এটি তখন ছিল সম্পূর্ণ নতুন এবং বৈধ। দাঁতের ব্যথা উপশম এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য রানি কোকেন মিশ্রিত চুইংগাম ও ওয়াইন পছন্দ করতেন। প্রসবের সময় অসহনীয় যন্ত্রণা কমাতে তিনি সানন্দে ক্লোরোফর্ম গ্রহণ করেন এবং এই অভিজ্ঞতাটিকে ‘স্বর্গীয়’ বলে বর্ণনা করেছেন।
১৮৩৭ সালে যখন ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে বসেন, উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বড় সংকটের বোঝা তাঁর ঘাড়ে চাপে—ব্রিটিশরা চীন থেকে বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করত। এর ফলে ব্রিটেনের সব অর্থ চীনে চলে যাচ্ছিল। আর ওই সময় ব্রিটিশদের হাতে চীনে রপ্তানি করার মতো কিছু ছিল না। ব্রিটেন মরিয়া হয়ে এমন একটি পণ্যের সন্ধান করছিল, যা চীনের লোকেরা চাইবে।
এ সমস্যার সমাধান ছিল আফিম। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতে প্রচুর আফিম উৎপাদিত হতো। এটি ছিল অত্যন্ত কার্যকর ব্যথানাশক এবং মারাত্মকভাবে আসক্তি সৃষ্টিকারী। ফলে চীনের লোকেরা এর জন্য প্রচুর দাম দিতে প্রস্তুত ছিল। রানি ভিক্টোরিয়ার শাসন শুরু হওয়ার পর, চীনে আফিমের চালান দ্রুত বাড়তে থাকে। আফিমের কল্যাণে রাতারাতি বাণিজ্য ভারসাম্য বদলে যায়। চীনই ব্রিটিশদের কাছে ঋণী হতে শুরু করে। মাদক কারবার থেকে আসা অর্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মোট বার্ষিক আয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশে দাঁড়ায়।
চীন সরকার মরিয়া হয়ে আফিমের প্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করে। চীনের সম্রাট এই কাজের জন্য প্রশাসক লিন জেক্সুকে নিয়োগ করেন। জেক্সু রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে একটি চিঠি লিখে ব্রিটিশদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন—চীন যেখানে চা, রেশম ও মৃৎপাত্রের মতো উপকারী পণ্য পাঠাচ্ছে, সেখানে ব্রিটেন কেন তার বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষকে ক্ষতিকর মাদক পাঠাচ্ছে?
রানি সেই চিঠি পড়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি। ফলে ১৮৩৯ সালের বসন্তে লিন জেক্সু ব্রিটিশ জাহাজ বহর আটক করেন এবং প্রায় আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড আফিম দক্ষিণ চীন সাগরে ফেলে দেন।
মাত্র ২০ বছর বয়সী রানি ভিক্টোরিয়া এই ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। যেকোনো ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যবাদী কিশোরীর মতো তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিতই—তিনি চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটিই ইতিহাসে প্রথম ‘আফিম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
ব্রিটিশ বাহিনী চীনা সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে এবং হাজার হাজার চীনা নাগরিককে হত্যা করে। সম্রাট বাধ্য হয়ে একটি অসম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে হংকংকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে হয়। চীনে আফিম ঢোকার জন্য আরও বন্দর খুলে দেওয়া হয় এবং চীনে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকেরা আইনি সুরক্ষা পান।
এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে চীন সাম্রাজ্যের অজেয় ভাবমূর্তি ভেঙে দেয়। এভাবেই একজন একগুঁয়ে কিশোরী রানি একটি প্রাচীন, মর্যাদাপূর্ণ সভ্যতাকে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করেন। এই নির্মম, নির্লজ্জ আত্মস্বার্থই রানি ভিক্টোরিয়াকে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মাদক সম্রাট বানিয়ে তোলে!
তথ্যসূত্র: টাইম

ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক সম্রাট কে? হয়তো আপনি পাবলো এস্কোবার বা এল চ্যাপোর নাম বলবেন, কিন্তু আপনি ভুল! তাঁদের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে এমন একজন অবিশ্বাস্য ক্ষমতাধর নারী ছিলেন, যিনি বিশাল এক মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কাছে একালের এস্কোবার এবং এল চ্যাপোকে ছ্যাঁচড়া মাদককারবারি মনে হবে। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে কিন্তু কখনো গহিন অরণ্যের আস্তানায় সশস্ত্র রক্ষীবেষ্টিত হয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়নি। তাঁর মাদক কারবারের আয় গোটা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখত। আর তাঁকে কখনো জেলে যাওয়ার চিন্তা করতে হয়নি। কারণ, মাদক-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা যাঁদের ছিল, তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁর বেতনভুক্ত কর্মচারী!
তিনি আর কেউ নন, তিনি রানি ভিক্টোরিয়া। তাঁর হাতে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দণ্ড।
রানি ভিক্টোরিয়া শুধু সাম্রাজ্য পরিচালনাতেই মাদক ব্যবহার করেননি, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন বিভিন্ন ধরনের ড্রাগের ভক্ত। সিংহাসনে আরোহণের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।
ভিক্টোরিয়ার অন্যতম প্রিয় মাদক ছিল আফিম। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে আফিম সেবনের ফ্যাশনেবল উপায় ছিল—অ্যালকোহলের সঙ্গে মিশিয়ে লডেনাম আকারে পান করা। তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি দূর করতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এমনকি দাঁত ওঠার সময় শিশুদের জন্যও এটি সুপারিশ করতেন চিকিৎসকেরা। রানি ভিক্টোরিয়াও প্রতিদিন সকালে এক ঢোক লডেনাম পান করে দিন শুরু করতেন।
এ ছাড়া তিনি সেবন করতেন কোকেন। এটি তখন ছিল সম্পূর্ণ নতুন এবং বৈধ। দাঁতের ব্যথা উপশম এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য রানি কোকেন মিশ্রিত চুইংগাম ও ওয়াইন পছন্দ করতেন। প্রসবের সময় অসহনীয় যন্ত্রণা কমাতে তিনি সানন্দে ক্লোরোফর্ম গ্রহণ করেন এবং এই অভিজ্ঞতাটিকে ‘স্বর্গীয়’ বলে বর্ণনা করেছেন।
১৮৩৭ সালে যখন ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে বসেন, উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বড় সংকটের বোঝা তাঁর ঘাড়ে চাপে—ব্রিটিশরা চীন থেকে বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করত। এর ফলে ব্রিটেনের সব অর্থ চীনে চলে যাচ্ছিল। আর ওই সময় ব্রিটিশদের হাতে চীনে রপ্তানি করার মতো কিছু ছিল না। ব্রিটেন মরিয়া হয়ে এমন একটি পণ্যের সন্ধান করছিল, যা চীনের লোকেরা চাইবে।
এ সমস্যার সমাধান ছিল আফিম। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতে প্রচুর আফিম উৎপাদিত হতো। এটি ছিল অত্যন্ত কার্যকর ব্যথানাশক এবং মারাত্মকভাবে আসক্তি সৃষ্টিকারী। ফলে চীনের লোকেরা এর জন্য প্রচুর দাম দিতে প্রস্তুত ছিল। রানি ভিক্টোরিয়ার শাসন শুরু হওয়ার পর, চীনে আফিমের চালান দ্রুত বাড়তে থাকে। আফিমের কল্যাণে রাতারাতি বাণিজ্য ভারসাম্য বদলে যায়। চীনই ব্রিটিশদের কাছে ঋণী হতে শুরু করে। মাদক কারবার থেকে আসা অর্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মোট বার্ষিক আয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশে দাঁড়ায়।
চীন সরকার মরিয়া হয়ে আফিমের প্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করে। চীনের সম্রাট এই কাজের জন্য প্রশাসক লিন জেক্সুকে নিয়োগ করেন। জেক্সু রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে একটি চিঠি লিখে ব্রিটিশদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন—চীন যেখানে চা, রেশম ও মৃৎপাত্রের মতো উপকারী পণ্য পাঠাচ্ছে, সেখানে ব্রিটেন কেন তার বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষকে ক্ষতিকর মাদক পাঠাচ্ছে?
রানি সেই চিঠি পড়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি। ফলে ১৮৩৯ সালের বসন্তে লিন জেক্সু ব্রিটিশ জাহাজ বহর আটক করেন এবং প্রায় আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড আফিম দক্ষিণ চীন সাগরে ফেলে দেন।
মাত্র ২০ বছর বয়সী রানি ভিক্টোরিয়া এই ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। যেকোনো ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যবাদী কিশোরীর মতো তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিতই—তিনি চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটিই ইতিহাসে প্রথম ‘আফিম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
ব্রিটিশ বাহিনী চীনা সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে এবং হাজার হাজার চীনা নাগরিককে হত্যা করে। সম্রাট বাধ্য হয়ে একটি অসম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির ফলে হংকংকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে হয়। চীনে আফিম ঢোকার জন্য আরও বন্দর খুলে দেওয়া হয় এবং চীনে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকেরা আইনি সুরক্ষা পান।
এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে চীন সাম্রাজ্যের অজেয় ভাবমূর্তি ভেঙে দেয়। এভাবেই একজন একগুঁয়ে কিশোরী রানি একটি প্রাচীন, মর্যাদাপূর্ণ সভ্যতাকে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করেন। এই নির্মম, নির্লজ্জ আত্মস্বার্থই রানি ভিক্টোরিয়াকে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মাদক সম্রাট বানিয়ে তোলে!
তথ্যসূত্র: টাইম

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
শিশুসাহিত্যে চিলড্রেনস বুকার পুরস্কার চালু করেছে বুকার পুরস্কার ফাউন্ডেশন। আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার চালু হবে এবং প্রথম বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে ২০২৭ সালের শুরুর দিকে। ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী পাঠকদের জন্য লেখা সেরা কথাসাহিত্যের জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৫ টাকা) দেওয়া
১ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকায় খুব কম দোকানেই মিলত গ্রিল চিকেন। এ তালিকার শীর্ষে হয়তো অনেকে রাখতে পারেন সায়েন্স ল্যাবের ছায়ানীড় কনফেকশনারি অ্যান্ড ফাস্ট ফুড নামের রেস্তোরাঁটিকে। এখন তো বহু রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায় খাবারটি। কিন্তু ছায়ানীড়ের গ্রিল চিকেন কিংবা চিকেন শর্মার কাছে হয়তো স্বাদে হেরে যেতে...
২ দিন আগে
আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, কবি-লেখক চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ নামেই বিখ্যাত। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন শচীমোহন গোপ, যিনি পঞ্চাশের দশকে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক মোড়ে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

শিশুসাহিত্যে চিলড্রেনস বুকার পুরস্কার চালু করেছে বুকার পুরস্কার ফাউন্ডেশন। আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার চালু হবে এবং প্রথম বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে ২০২৭ সালের শুরুর দিকে। ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী পাঠকদের জন্য লেখা সেরা কথাসাহিত্যের জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৫ টাকা) দেওয়া হবে।
বুকার পুরস্কারের ইতিহাসে এই প্রথমবার বিচারক প্যানেলে থাকবে শিশুরাও। বর্তমান চিলড্রেনস লরিয়েট শিশুসাহিত্যিক ফ্রাঙ্ক কটরেল-বয়েস বিচারকদের উদ্বোধনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন প্রাপ্তবয়স্ক বিচারক থাকবেন, যাঁরা প্রথমে আটটি বইয়ের একটি শর্টলিস্ট তৈরি করবেন। এরপর বিজয়ী নির্ধারণে সহায়তা করার জন্য তিনজন শিশু বিচারক নির্বাচিত হবেন।
বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, প্রতিবছর চিলড্রেনস বুকার প্রাইজের জন্য শর্টলিস্টেড হওয়া এবং বিজয়ী বইগুলোর ৩০ হাজার কপি শিশুদের উপহার দেওয়া হবে। ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্ট, দ্য রিডিং এজেন্সি, বুকব্যাংকস এবং চিলড্রেনস বুক প্রজেক্টসহ বিভিন্ন সহযোগী সংস্থাদের মাধ্যমে এ বইগুলো দেওয়া হবে। গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে শিশুদের ‘আনন্দ নিয়ে পড়া’র প্রবণতা। এমন সময় বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশন এ উদ্যোগটি নিল।
কটরেল-বয়েস বলেন, এই পুরস্কার শিশুদের উপভোগ করার মতো বই খুঁজে বের করা সহজ করে তুলবে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি শিশুরই বইয়ের জগতে ডুব দেওয়ার যে আনন্দ, তা উপভোগ করার সুযোগ পাওয়া উচিত। বিচারক প্যানেলে তাদের আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে এবং মনোনীত বইগুলো উপহার দেওয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার শিশুকে বই পড়ার চমৎকার দুনিয়ায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এটা বেশ দারুণ আয়োজন হতে যাচ্ছে।’ তিনি মজা করে বলেন, ‘চলুন, হইচই শুরু করা যাক!’
শিশুসাহিত্য জগতের শীর্ষ লেখকদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে এ ঘোষণা। সাবেক শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত মালরি ব্ল্যাকম্যান, জ্যাকলিন উইলসন, মাইকেল মরপুরগো, ক্রেসিডা কাউয়েল, অ্যান ফাইন এবং জোসেফ কোয়েলোরা—সবাই নতুন এই পুরস্কারকে স্বাগত জানিয়েছেন।
ইংরেজিতে লেখা বা ইংরেজিতে অনূদিত এবং যুক্তরাজ্য বা আয়ারল্যান্ডে প্রকাশিত সমসাময়িক শিশুসাহিত্যগুলোতে এ পুরস্কার দেওয়া হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের বুকার এবং আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের মতোই বিজয়ী লেখক ৫০ হাজার পাউন্ড এবং শর্টলিস্টেড লেখকেরা প্রত্যেকে ২ হাজার ৫০০ পাউন্ড পাবেন।
প্রথম চিলড্রেনস বুকার পুরস্কারের জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু হবে ২০২৬ সালের বসন্তে। বিচারক হতে শিশুদের আবেদন প্রক্রিয়াও এই সময়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। সেই বছরের নভেম্বরে ঘোষণা করা হবে শর্টলিস্ট এবং শিশু বিচারকদের নাম। বিজয়ীর নাম প্রকাশ করা হবে ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরুণ পাঠকদের জন্য আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে। ২০২৭ সালের পুরস্কারের জন্য ২০২৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে প্রকাশিত বই হতে হবে।
শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিল্পকলায় সমর্থন এবং জলবায়ু-সংকট মোকাবিলায় কাজ করা দাতব্য সংস্থা একেও ফাউন্ডেশনের (AKO Foundation) সহযোগিতায় এ পুরস্কার পরিচালিত হবে।
বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) গ্যাবি উড বলেন, ‘২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ চালুর পর গত ২০ বছরে আমাদের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ চিলড্রেনস বুকার। এর একাধিক লক্ষ্য রয়েছে। একদিকে এটি শিশুদের জন্য লেখা ভবিষ্যৎ ক্লাসিক সাহিত্যকে সম্মান জানাবে, অন্যদিকে এটি এমন একটি সামাজিক উদ্যোগ, যা তরুণদের আরও বেশি করে পড়াশোনায় অনুপ্রাণিত করবে। এর মাধ্যমেই আমরা এমন এক বীজ রোপণ করতে চাই, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আজীবন পাঠকেরা বিকশিত হবে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, শিশুদের বিশেষ করে শিশুসাহিত্যের আসল বিচারকদের মতামত শোনার জন্য।
একেও ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ফিলিপ ল-ফোর্ড বলেন, ‘এই অংশীদারত্ব ফাউন্ডেশনের সাক্ষরতা বৃদ্ধি ও সামাজিক গতিশীলতা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। আমরা গর্বিত যে এমন একটি প্রকল্পে অবদান রাখতে পারছি, যা তরুণ পাঠকদের অনুপ্রাণিত ও ক্ষমতায়িত করবে।’
বিনো ব্রেইন নামের একটি যুব গবেষণা সংস্থা ও ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্টের সহযোগিতায় নিয়মিত পরামর্শ সেশনের মাধ্যমে শিশুরা এই পুরস্কারের গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্ট শিশুদের পড়ার অভ্যাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা মূল্যায়নে সহায়তা করবে।
বুকার ফাউন্ডেশনের মতে, এই নতুন পুরস্কারটি শিশুসাহিত্যকে ‘সংস্কৃতির কেন্দ্রে স্থাপন’ করার একটি প্রচেষ্টা। সিইও গ্যাবি উড বলেন, ‘এই উদ্যোগের লক্ষ্য শুধু শিশুসাহিত্যে উৎকর্ষকে স্বীকৃতি দেওয়া নয়, বরং আরও বেশি তরুণকে এমন গল্প ও চরিত্র আবিষ্কারে সহায়তা করা ‘যারা তাদের সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।’
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সাহিত্য পুরস্কার বুকার প্রাইজ প্রথম প্রদান করা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। যুক্তরাজ্য বা আয়ারল্যান্ডে প্রকাশিত ইংরেজিতে রচিত অসাধারণ কথাসাহিত্যকে সম্মান জানাতে এই পুরস্কার প্রবর্তিত হয়।

শিশুসাহিত্যে চিলড্রেনস বুকার পুরস্কার চালু করেছে বুকার পুরস্কার ফাউন্ডেশন। আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার চালু হবে এবং প্রথম বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে ২০২৭ সালের শুরুর দিকে। ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী পাঠকদের জন্য লেখা সেরা কথাসাহিত্যের জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৫ টাকা) দেওয়া হবে।
বুকার পুরস্কারের ইতিহাসে এই প্রথমবার বিচারক প্যানেলে থাকবে শিশুরাও। বর্তমান চিলড্রেনস লরিয়েট শিশুসাহিত্যিক ফ্রাঙ্ক কটরেল-বয়েস বিচারকদের উদ্বোধনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন প্রাপ্তবয়স্ক বিচারক থাকবেন, যাঁরা প্রথমে আটটি বইয়ের একটি শর্টলিস্ট তৈরি করবেন। এরপর বিজয়ী নির্ধারণে সহায়তা করার জন্য তিনজন শিশু বিচারক নির্বাচিত হবেন।
বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, প্রতিবছর চিলড্রেনস বুকার প্রাইজের জন্য শর্টলিস্টেড হওয়া এবং বিজয়ী বইগুলোর ৩০ হাজার কপি শিশুদের উপহার দেওয়া হবে। ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্ট, দ্য রিডিং এজেন্সি, বুকব্যাংকস এবং চিলড্রেনস বুক প্রজেক্টসহ বিভিন্ন সহযোগী সংস্থাদের মাধ্যমে এ বইগুলো দেওয়া হবে। গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে শিশুদের ‘আনন্দ নিয়ে পড়া’র প্রবণতা। এমন সময় বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশন এ উদ্যোগটি নিল।
কটরেল-বয়েস বলেন, এই পুরস্কার শিশুদের উপভোগ করার মতো বই খুঁজে বের করা সহজ করে তুলবে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি শিশুরই বইয়ের জগতে ডুব দেওয়ার যে আনন্দ, তা উপভোগ করার সুযোগ পাওয়া উচিত। বিচারক প্যানেলে তাদের আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে এবং মনোনীত বইগুলো উপহার দেওয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার শিশুকে বই পড়ার চমৎকার দুনিয়ায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এটা বেশ দারুণ আয়োজন হতে যাচ্ছে।’ তিনি মজা করে বলেন, ‘চলুন, হইচই শুরু করা যাক!’
শিশুসাহিত্য জগতের শীর্ষ লেখকদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে এ ঘোষণা। সাবেক শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত মালরি ব্ল্যাকম্যান, জ্যাকলিন উইলসন, মাইকেল মরপুরগো, ক্রেসিডা কাউয়েল, অ্যান ফাইন এবং জোসেফ কোয়েলোরা—সবাই নতুন এই পুরস্কারকে স্বাগত জানিয়েছেন।
ইংরেজিতে লেখা বা ইংরেজিতে অনূদিত এবং যুক্তরাজ্য বা আয়ারল্যান্ডে প্রকাশিত সমসাময়িক শিশুসাহিত্যগুলোতে এ পুরস্কার দেওয়া হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের বুকার এবং আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের মতোই বিজয়ী লেখক ৫০ হাজার পাউন্ড এবং শর্টলিস্টেড লেখকেরা প্রত্যেকে ২ হাজার ৫০০ পাউন্ড পাবেন।
প্রথম চিলড্রেনস বুকার পুরস্কারের জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু হবে ২০২৬ সালের বসন্তে। বিচারক হতে শিশুদের আবেদন প্রক্রিয়াও এই সময়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। সেই বছরের নভেম্বরে ঘোষণা করা হবে শর্টলিস্ট এবং শিশু বিচারকদের নাম। বিজয়ীর নাম প্রকাশ করা হবে ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরুণ পাঠকদের জন্য আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে। ২০২৭ সালের পুরস্কারের জন্য ২০২৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে প্রকাশিত বই হতে হবে।
শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিল্পকলায় সমর্থন এবং জলবায়ু-সংকট মোকাবিলায় কাজ করা দাতব্য সংস্থা একেও ফাউন্ডেশনের (AKO Foundation) সহযোগিতায় এ পুরস্কার পরিচালিত হবে।
বুকার প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) গ্যাবি উড বলেন, ‘২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ চালুর পর গত ২০ বছরে আমাদের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ চিলড্রেনস বুকার। এর একাধিক লক্ষ্য রয়েছে। একদিকে এটি শিশুদের জন্য লেখা ভবিষ্যৎ ক্লাসিক সাহিত্যকে সম্মান জানাবে, অন্যদিকে এটি এমন একটি সামাজিক উদ্যোগ, যা তরুণদের আরও বেশি করে পড়াশোনায় অনুপ্রাণিত করবে। এর মাধ্যমেই আমরা এমন এক বীজ রোপণ করতে চাই, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আজীবন পাঠকেরা বিকশিত হবে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, শিশুদের বিশেষ করে শিশুসাহিত্যের আসল বিচারকদের মতামত শোনার জন্য।
একেও ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ফিলিপ ল-ফোর্ড বলেন, ‘এই অংশীদারত্ব ফাউন্ডেশনের সাক্ষরতা বৃদ্ধি ও সামাজিক গতিশীলতা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। আমরা গর্বিত যে এমন একটি প্রকল্পে অবদান রাখতে পারছি, যা তরুণ পাঠকদের অনুপ্রাণিত ও ক্ষমতায়িত করবে।’
বিনো ব্রেইন নামের একটি যুব গবেষণা সংস্থা ও ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্টের সহযোগিতায় নিয়মিত পরামর্শ সেশনের মাধ্যমে শিশুরা এই পুরস্কারের গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্ট শিশুদের পড়ার অভ্যাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা মূল্যায়নে সহায়তা করবে।
বুকার ফাউন্ডেশনের মতে, এই নতুন পুরস্কারটি শিশুসাহিত্যকে ‘সংস্কৃতির কেন্দ্রে স্থাপন’ করার একটি প্রচেষ্টা। সিইও গ্যাবি উড বলেন, ‘এই উদ্যোগের লক্ষ্য শুধু শিশুসাহিত্যে উৎকর্ষকে স্বীকৃতি দেওয়া নয়, বরং আরও বেশি তরুণকে এমন গল্প ও চরিত্র আবিষ্কারে সহায়তা করা ‘যারা তাদের সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।’
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সাহিত্য পুরস্কার বুকার প্রাইজ প্রথম প্রদান করা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। যুক্তরাজ্য বা আয়ারল্যান্ডে প্রকাশিত ইংরেজিতে রচিত অসাধারণ কথাসাহিত্যকে সম্মান জানাতে এই পুরস্কার প্রবর্তিত হয়।

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক সম্রাট কে? হয়তো আপনি পাবলো এস্কোবার বা এল চ্যাপোর নাম বলবেন, কিন্তু আপনি ভুল! তাঁদের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে এমন একজন অবিশ্বাস্য ক্ষমতাধর নারী ছিলেন, যিনি বিশাল এক মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কাছে একালের এস্কোবার এবং এল চ্যাপোকে ছ্যাঁচড়া মাদককারবারি মনে হবে।
১ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকায় খুব কম দোকানেই মিলত গ্রিল চিকেন। এ তালিকার শীর্ষে হয়তো অনেকে রাখতে পারেন সায়েন্স ল্যাবের ছায়ানীড় কনফেকশনারি অ্যান্ড ফাস্ট ফুড নামের রেস্তোরাঁটিকে। এখন তো বহু রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায় খাবারটি। কিন্তু ছায়ানীড়ের গ্রিল চিকেন কিংবা চিকেন শর্মার কাছে হয়তো স্বাদে হেরে যেতে...
২ দিন আগে
আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, কবি-লেখক চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ নামেই বিখ্যাত। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন শচীমোহন গোপ, যিনি পঞ্চাশের দশকে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক মোড়ে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন।
৪ দিন আগেসম্পাদকীয়

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকায় খুব কম দোকানেই মিলত গ্রিল চিকেন। এ তালিকার শীর্ষে হয়তো অনেকে রাখতে পারেন সায়েন্স ল্যাবের ছায়ানীড় কনফেকশনারি অ্যান্ড ফাস্ট ফুড নামের রেস্তোরাঁটিকে। এখন তো বহু রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায় খাবারটি। কিন্তু ছায়ানীড়ের গ্রিল চিকেন কিংবা চিকেন শর্মার কাছে হয়তো স্বাদে হেরে যেতে পারে অন্য জায়গার এসব খাবার। অন্তত ছায়ানীড়ের নিয়মিত ভক্ত-গ্রাহকেরা এমন দাবি করতেই পারেন। তাতে দোষের কিছু নেই।
তাই হয়তো এখনো রেস্তোরাঁটির সামনে ভিড় লেগে থাকে। ব্যস্ত সড়কের পাশ থেকে যখন মুরগি পোড়ার সুঘ্রাণ পাওয়া যায়, তখন পথে যেতে অনেকেই হয়তো বিরতি নিয়ে কিনে নেন ছায়ানীড়ের শর্মা বা গ্রিল চিকেন। ভেতরে বসে খেতে হলে লম্বা লাইনে যেমন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, আবার পার্সেল নিতে গেলেও অপেক্ষা করতে হয়। প্রাত্যহিক এ দৃশ্য ছায়ানীড়ের জনপ্রিয়তার প্রমাণ। বিরিয়ানি ও অন্যান্য ফাস্ট ফুড খাবারও পাওয়া যায় এখানে।
ছবি: ওমর ফারুক

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকায় খুব কম দোকানেই মিলত গ্রিল চিকেন। এ তালিকার শীর্ষে হয়তো অনেকে রাখতে পারেন সায়েন্স ল্যাবের ছায়ানীড় কনফেকশনারি অ্যান্ড ফাস্ট ফুড নামের রেস্তোরাঁটিকে। এখন তো বহু রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায় খাবারটি। কিন্তু ছায়ানীড়ের গ্রিল চিকেন কিংবা চিকেন শর্মার কাছে হয়তো স্বাদে হেরে যেতে পারে অন্য জায়গার এসব খাবার। অন্তত ছায়ানীড়ের নিয়মিত ভক্ত-গ্রাহকেরা এমন দাবি করতেই পারেন। তাতে দোষের কিছু নেই।
তাই হয়তো এখনো রেস্তোরাঁটির সামনে ভিড় লেগে থাকে। ব্যস্ত সড়কের পাশ থেকে যখন মুরগি পোড়ার সুঘ্রাণ পাওয়া যায়, তখন পথে যেতে অনেকেই হয়তো বিরতি নিয়ে কিনে নেন ছায়ানীড়ের শর্মা বা গ্রিল চিকেন। ভেতরে বসে খেতে হলে লম্বা লাইনে যেমন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, আবার পার্সেল নিতে গেলেও অপেক্ষা করতে হয়। প্রাত্যহিক এ দৃশ্য ছায়ানীড়ের জনপ্রিয়তার প্রমাণ। বিরিয়ানি ও অন্যান্য ফাস্ট ফুড খাবারও পাওয়া যায় এখানে।
ছবি: ওমর ফারুক

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক সম্রাট কে? হয়তো আপনি পাবলো এস্কোবার বা এল চ্যাপোর নাম বলবেন, কিন্তু আপনি ভুল! তাঁদের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে এমন একজন অবিশ্বাস্য ক্ষমতাধর নারী ছিলেন, যিনি বিশাল এক মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কাছে একালের এস্কোবার এবং এল চ্যাপোকে ছ্যাঁচড়া মাদককারবারি মনে হবে।
১ দিন আগে
শিশুসাহিত্যে চিলড্রেনস বুকার পুরস্কার চালু করেছে বুকার পুরস্কার ফাউন্ডেশন। আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার চালু হবে এবং প্রথম বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে ২০২৭ সালের শুরুর দিকে। ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী পাঠকদের জন্য লেখা সেরা কথাসাহিত্যের জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৫ টাকা) দেওয়া
১ দিন আগে
আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, কবি-লেখক চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ নামেই বিখ্যাত। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন শচীমোহন গোপ, যিনি পঞ্চাশের দশকে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক মোড়ে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন।
৪ দিন আগেসম্পাদকীয়

আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, কবি-লেখক চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ নামেই বিখ্যাত। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন শচীমোহন গোপ, যিনি পঞ্চাশের দশকে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক মোড়ে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন। বলা হয়, চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনদর্শনে প্রভাবিত হয়েই শচীমোহন রেস্তোরাঁটির নাম দেন ‘দেশবন্ধু সুইটমিট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। এর উল্টো দিকে তখন ছিল ইত্তেফাক পত্রিকার অফিস।
সেখানকার সাংবাদিকেরা দেশবন্ধুর পরোটা-লুচি-ভাজি-হালুয়া খেতে যেতেন নিয়মিত। কবি-সাহিত্যিক-অভিনয়শিল্পীরাও পছন্দ করতেন এই রেস্তোরাঁর খাবার। এমনকি এফডিসিতে ফরমাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো দেশবন্ধুর নাশতা। এখন হয়তো মানিক মিয়া, রাজ্জাক, কবরী কিংবা শাবানাদের মতো বিখ্যাতরা সেখানে যান না কিন্তু তাতে দেশবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখনো ঢাকাবাসীর ভিড় দেখা যায় এই রেস্তোরাঁয়। ভাবা যায়, সারা দিনই এখানকার পরোটা-ভাজি বিক্রি হতে থাকে! দুপুরে অবশ্য খাবারের তালিকায় ভাত-মাছ-মাংসও আছে। ছবি: মেহেদী হাসান

আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, কবি-লেখক চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ নামেই বিখ্যাত। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন শচীমোহন গোপ, যিনি পঞ্চাশের দশকে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দুধ, দই আর মাঠা। ১৯৫৮ সালে হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক মোড়ে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন। বলা হয়, চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনদর্শনে প্রভাবিত হয়েই শচীমোহন রেস্তোরাঁটির নাম দেন ‘দেশবন্ধু সুইটমিট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। এর উল্টো দিকে তখন ছিল ইত্তেফাক পত্রিকার অফিস।
সেখানকার সাংবাদিকেরা দেশবন্ধুর পরোটা-লুচি-ভাজি-হালুয়া খেতে যেতেন নিয়মিত। কবি-সাহিত্যিক-অভিনয়শিল্পীরাও পছন্দ করতেন এই রেস্তোরাঁর খাবার। এমনকি এফডিসিতে ফরমাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো দেশবন্ধুর নাশতা। এখন হয়তো মানিক মিয়া, রাজ্জাক, কবরী কিংবা শাবানাদের মতো বিখ্যাতরা সেখানে যান না কিন্তু তাতে দেশবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখনো ঢাকাবাসীর ভিড় দেখা যায় এই রেস্তোরাঁয়। ভাবা যায়, সারা দিনই এখানকার পরোটা-ভাজি বিক্রি হতে থাকে! দুপুরে অবশ্য খাবারের তালিকায় ভাত-মাছ-মাংসও আছে। ছবি: মেহেদী হাসান

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মাদক সম্রাট কে? হয়তো আপনি পাবলো এস্কোবার বা এল চ্যাপোর নাম বলবেন, কিন্তু আপনি ভুল! তাঁদের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে এমন একজন অবিশ্বাস্য ক্ষমতাধর নারী ছিলেন, যিনি বিশাল এক মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কাছে একালের এস্কোবার এবং এল চ্যাপোকে ছ্যাঁচড়া মাদককারবারি মনে হবে।
১ দিন আগে
শিশুসাহিত্যে চিলড্রেনস বুকার পুরস্কার চালু করেছে বুকার পুরস্কার ফাউন্ডেশন। আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার চালু হবে এবং প্রথম বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে ২০২৭ সালের শুরুর দিকে। ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী পাঠকদের জন্য লেখা সেরা কথাসাহিত্যের জন্য ৫০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৫ টাকা) দেওয়া
১ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকায় খুব কম দোকানেই মিলত গ্রিল চিকেন। এ তালিকার শীর্ষে হয়তো অনেকে রাখতে পারেন সায়েন্স ল্যাবের ছায়ানীড় কনফেকশনারি অ্যান্ড ফাস্ট ফুড নামের রেস্তোরাঁটিকে। এখন তো বহু রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায় খাবারটি। কিন্তু ছায়ানীড়ের গ্রিল চিকেন কিংবা চিকেন শর্মার কাছে হয়তো স্বাদে হেরে যেতে...
২ দিন আগে