Ajker Patrika

যাঁরা বদলে দিয়েছেন জনপদের পরিচিতি

অভিজিৎ সাহা, নালিতাবাড়ী (শেরপুর)
যাঁরা বদলে  দিয়েছেন জনপদের পরিচিতি

অঘ্রানের শেষ রোববার। শীতের তেজ শুরু হয়েছে। কুয়াশা কিছুটা ঘোলাটে করে রেখেছে পরিবেশ। চলেছি নলিতাবাড়ীর সোহাগপুরে। এই নামে গ্রামটিকে চিনতে অনেকের কষ্ট হয় এখন। কিন্তু শেরপুরে নেমে যে কাউকে বললে দেখিয়ে দেয় বিধবাপল্লি। একটি ঘটনা আর কিছু মানুষের আত্মত্যাগ বদলে দিয়েছে পুরো জনপদের পরিচিতি।

সোহাগপুরের বিধবাপল্লির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানি বাহিনী ও দেশীয় রাজাকারেরা সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে ১৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনায় ৬২ জন নারী বিধবা হন। এরপর থেকে ওই গ্রাম বিধবাপল্লি নামে পরিচিতি পায়।

গুমোট শীতের দুপুরে আমাদের যুদ্ধদিনের স্মৃতি শোনান জবেদা বেওয়া। তাঁর বয়স এখন ৭২ বছর। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই তাঁর বিয়ের বয়স ছিল মাত্র আড়াই মাস। জবেদার চোখের সামনে স্বামীসহ তাঁর পরিবারের আটজন পুরুষ সদস্যকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। তিনিও পাশবিকতা থেকে রেহাই পাননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘ সময় তিনি লজ্জায় কারও সামনে আসতেন না। এখন সময় বদলেছে। রাষ্ট্র তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে। ফলে শারীরিক নির্যাতনের ক্লেদ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। জবেদার মতো করফুলি বেওয়াও (৭৫) চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছেন স্বামীকে। পরে হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের অত্যাচারে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বহু কষ্টে দিন পার করতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৭১ সালে বিধবা হওয়া ৬২ জনের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন ২৩ জন। তাঁদের মধ্যে নির্যাতনের শিকার ১৪ জনকে নারী মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল আগেই। গত ১৪ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন আরও ছয় নারী। সোহাগপুরে এখন মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়া নারীর সংখ্যা ২০। তাঁদের মধ্যে আটজন মারা গেছেন।

সোহাগপুর গণহত্যায় নিহত প্রথম ব্যক্তির নাম রমেন্দ্র রিছিল। রমেন্দ্র শহীদ হওয়ার পর ঝর্ণার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে গত নভেম্বরে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে গত ১৪ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত গেজেটে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পান ঝর্ণা দিওসহ আরও ছয় নারী। একই সময়ে স্বীকৃতি পাওয়া অন্যরা হলেন মালতী রাকসাম, হাজেরা বেওয়া, ছাহেরা খাতুন, সমিলা রাকসাম ও লাকজান বেওয়া। তবে সমিলা রাকসাম ও লাকজান বেওয়া গেজেট প্রকাশের আগে মারা গেছেন। ঝর্ণার মেয়ে লিন্ডা দিও বলেন, ‘একটাই কষ্ট, আমার মা মৃত্যুর আগে স্বীকৃতির কথা জানতে পারলেন না।’

স্বীকৃতি পাওয়া সবাই এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। তবে এর আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রত্যেক নারীকে প্রতি মাসে ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে দুই হাজার, বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক থেকে ৪০০ এবং সরকারি বিধবা ভাতা হিসেবে ৫০০ টাকা করে পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।  

২০১৮ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন’ প্রকল্পের আওতায় সোহাগপুর গ্রামের গণহত্যায় স্বামী-স্বজন হারানো ও নির্যাতনের শিকার ৩০ নারীর জন্য ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সোহাগপুর বিধবাপল্লিতে ১০ শতাংশ জমি কিনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তার পাশে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ৬ শতাংশ জমি কিনে ‘সৌরজায়া স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামের তালিকা লিখে রাখা হয়েছে।

নালিতাবাড়ী পৌরসভার মেয়র আবু বক্কর সিদ্দিকের সঙ্গে সোহাগপুর বিধবাপল্লির নারীরাস্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান তালুকদার বলেন, ‘যখন সরকারি স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলছিল, তখন অনেকে এলাকায় ছিলেন না। তবে দেরিতে হলেও নতুন করে ৬ জনসহ এখন মোট ২০ জন মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন।’

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সংগঠক হাকাম হীরা জানালেন, সোহাগপুর বিধবাপল্লির নির্যাতিত নারীরা একসময় লজ্জায় মানুষের সামনে আসতেন না। বহু চেষ্টা করতে হয়েছে তাঁদের সহজ করতে। স্থানীয় সাংবাদিক এবং বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় এক যুগের প্রচেষ্টায় তাঁরা স্বীকৃতিও পেয়েছেন। জীবনে ‘সব হারানোর’ কষ্ট তাঁরাই বোঝেন, যাঁদের সব হারায়। সরকারি স্বীকৃতি হয়তো খানিক স্বস্তি দেয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইলিশায় রিছিল বলেন, ‘নতুন করে যাঁরা স্বীকৃতি পেলেন, তাঁদের সব সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রশাসন কাজ করছে।’ তাঁর এ কথায় আমরা আশ্বস্ত হই। যে রাষ্ট্রের জন্য ঝর্ণা দিও, মালতী রাকসাম, হাজেরা বেওয়া, ছাহেরা খাতুন, সমিলা রাকসাম কিংবা লাকজান বেওয়ারা জীবনের সর্বস্ব হারিয়েছেন, সেই রাষ্ট্র যদি তাঁদের মতো আরও অনেকের খোঁজ রাখে, তাতে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

ইয়ামাল কি তাহলে এভাবেই হারিয়ে যাবেন

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

এলাকার খবর
Loading...